আল্লাহ্র কৃপায় জামাতে আহমদীয়ার অগ্রগতি ও উন্নতির আংশিক চিত্র
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
০৭-আগস্ট, ২০২০
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৭ই আগস্ট, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় গত এক বছরে আল্লাহ্র কৃপায় জামাতে আহমদীয়া যে অগ্রগতি ও উন্নতি লাভ করেছে, এর আংশিক চিত্র তুলে ধরেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা আস্ সাফের ৯-১০ নং আয়াত পাঠ করেন যার বঙ্গানুবাদ হল: ‘তারা নিজেদের মুখের ফুৎকার দ্বারা আল্লাহ্র নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ্ স্বীয় নূরকে পূর্ণরূপে প্রকাশিত করবেন-ই, এতে কাফিররা যত অসন্তুষ্টই হোক না কেন। তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়েত ও সত্যধর্ম সহ প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি একে সকল ধর্মের ওপর জয়যুক্ত করেন, মুশরিকরা এতে যত অসন্তুষ্টই হোক না কেন।’
হুযূর (আই.) বলেন, আজ ৭ই আগস্ট এবং যুক্তরাজ্য জামাতের দিন পঞ্জিকা অনুযায়ী এটি যুক্তরাজ্য জলসার উদ্বোধনী দিন। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীর কারণে এ বছর বার্ষিক জলসার আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা অবস্থা দ্রুত স্বাভাবিক করে দিন এবং আমরা যেভাবে পূর্বে জলসা করতাম, সেভাবে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার সাথে যেন আমরা জলসা করতে পারি এবং পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করতে পারি ও জলসার অনুষ্ঠানাদি শুনে নিজেদের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি সাধন করতে পারি (আমীন)। জলসার এই ঘাটতি আংশিকভাবে দূর করার জন্য এমটিএ গত বছর বিভিন্ন দেশের বার্ষিক জলসায় প্রদত্ত হুযূরের ভাষণগুলো সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে; একইসাথে কিছু লাইভ অনুষ্ঠানও তারা করবে এবং এভাবে জামাতের সদস্যদের ধর্মীয় জ্ঞানপিপাসা নিবারণের চেষ্টা করা হবে। হুযূর (আই.) জামাতের সদস্যদেরকে এমটিএ’র এই অনুষ্ঠানমালা দেখার নির্দেশনা দেন। রীতি অনুসারে জলসায় যেভাবে প্রতিবছর জামাতের উন্নতির চিত্র তুলে ধরা হয় একইভাবে আজ এবং আগামী রবিবার একটি বিশেষ অধিবেশনে হুযূর এ বছরের অগ্রগতি ও উন্নতির রিপোর্ট উপস্থাপন করবেন, যেন তা জামাতের সদস্যদের ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়- যে কীভাবে বৈশ্বিক করোনা মহামারীর মধ্যেও খোদার কৃপায় জামাত ক্রমশ উন্নতি করছে। সাধারণতঃ জলসার দ্বিতীয় দিনে হুযূর বিশ্বব্যাপী জামাতের উন্নতির রিপোর্ট তুলে ধরতেন, কিন্তু সময়-স্বল্পতার কারণে তা সবসময়ই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। এ বছর যেহেতু একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেজন্য হুযূর ঠিক করেছেন, আংশিক রিপোর্ট আজকের খুতবায় উপস্থাপন করবেন, আর কিছু অংশ রবিবার বিকেলে সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তৃতায় তুলে ধরবেন।
রিপোর্ট উপস্থাপনের পূর্বে হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখা হতে দু’টি উদ্ধৃতি পাঠ করেন, যাতে খুতবার শুরুতে পাঠকৃত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা বিবৃত হয়েছে এবং যাতে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই স্পষ্ট ও প্রকাশ্য ঘোষণা দৃষ্টিগোচর হয় যে, এই যুগ ইসলামের পুনর্জাগরণের যুগ এবং এখন ইসলামের তবলীগ বা প্রচার একমাত্র তাঁর (আ.) সাথেই সম্পৃক্ত, আর যাবতীয় বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর (আ.) জামাত ফুলে-ফলে সুশোভিত হবে এবং বিস্তৃত হবে (ইনশাআল্লাহ্), কেননা এটিই আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মসীহ্ মওউদ ও ইমাম মাহদী হবার দাবীর অনেক বছর পূর্বেই তাঁর প্রতি ইলহাম হয়েছিল هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ অর্থাৎ ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়েত ও সত্যধর্ম সহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি এটিকে সকল ধর্মের ওপর জয়যুক্ত করেন।’ উম্মতে মুসলিমার সকল গবেষক ও আলেমের মতে এই বিজয় প্রতিশ্রুত মসীহ্র মাধ্যমে হওয়া অবশ্যম্ভাবী। অথচ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর পূর্বে কেউ-ই নিজেকে এই ভবিষ্যদ্বাণীর বিকাশস্থল হবার দাবী করে নি। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা তাঁর (আ.) প্রতি এই ইলহাম করেছেন এবং তাঁকে জানিয়েছেন যে, তিনি-ই এই ভবিষ্যদ্বাণীর বিকাশস্থল।
হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় এই বছর পৃথিবীজুড়ে পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশে যেসব নতুন জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা ২৮৮টি; আর এই নতুন জামাতগুলো ছাড়াও ১০৪০টি নতুন স্থানে আহমদীয়াতের চারা রোপিত হয়েছে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিয়েরালিওন, কঙ্গো কিনশাসা, ঘানা প্রভৃতি দেশ। হুযূর (আই.) নতুন নতুন জামাত প্রতিষ্ঠিত হবার বেশ কিছু ঈমানবর্ধক ঘটনাও উল্লেখ করেন। কোন স্থানে এফএম রেডিওতে জামাতের তবলীগি অনুষ্ঠান শুনে মানুষ আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন, কোথাও বা আহমদীদের তবলীগি প্রতিনিধিদলকে দেখে সাধারণ মুসলমানরা আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন- কারণ তারা এই তবলীগি কার্যক্রমের সাথে মহানবী (সা.) ও সাহাবীদের তবলীগের মিল দেখতে পেয়েছেন। কোন স্থানে একটি গ্রামের মানুষজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এবং নিজেদের মসজিদ থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র বড় মৌলভীর জাগতিক লোভের কারণে জুমুআ পড়তে পারছিল না; আহমদীয়া জামাতের মুবাল্লিগের সহায়তায় তারা মৌলভীর ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়েছে এবং নিজেদের মসজিদে জুমুআ পড়তে সক্ষম হচ্ছে, পরবর্তীতে সেখানকার অধিকাংশই আহমদীয়াত গ্রহণ করেছে। কোথাও আবার বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা এবং কোথাও অন্য দুই ফিরকার মধ্যে রেশারেশি দেখে সাধারণ মুসলমানরা আহমদীয়াতের সত্যতা উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। আহমদীয়া জামাতের ইসলামের সেবা ও কুরআন প্রচার দেখেও অনেক স্থানে মানুষ আহমদীয়াতের সত্যতা উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। এমনকি ফিলিস্তিনের আল্ খালীল নামক স্থানেও জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান।
বিগত এক বছরে জামাত ২১৭টি নতুন মসজিদ লাভ করেছে, যার মধ্যে ১২৪টি নবনির্মিত মসজিদ এবং ৯৩টি পূর্বনির্মিত স্থাপনাকে জামাত মসজিদে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছে। এর মধ্যে গুয়েতেমালায় ৩১ বছর পর জামাত দ্বিতীয় মসজিদ নির্মাণের সৌভাগ্য লাভ করেছে, যার নাম মসজিদে নূর। তানজানিয়ায় আমাদের বিরোধীরা আক্রমণ করে মসজিদের নির্মাণ-সামগ্রী ছিনিয়ে নিয়ে গেলে প্রশাসন মসজিদ নির্মাণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অথচ পরবর্তীতে অ-আহমদী গ্রামবাসীরাও সেই মসজিদকে নিজেদের গ্রামের জন্য কল্যাণকর আখ্যা দিয়ে নিজেরাই পাহারা দেয়ার উদ্যোগ নেয় এবং আল্লাহ্র কৃপায় মসজিদ নির্মিত হয়। আর মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর আহমদীদের ইবাদতের মান দেখে গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের ভ্রান্তি দূর হয় এবং তারা স্বীকার করে যে, তাদেরকে আহমদীদের সম্পর্কে ভুল বুঝানো হয়েছিল; তারা এখন বুঝতে পেরেছে- আহমদীরাই খাঁটি ও সত্যিকার মুসলমান। কোন স্থানে আমাদের মসজিদ নির্মাণে বাধা প্রদানকারী গ্রামের চিফ ও কাউন্সিল আহমদীদের অগাধ ধৈর্য দেখে জামাতের সত্যতা উপলদ্ধি করতে পারেন এবং নিজেরা ক্ষমা চেয়ে আমাদের মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন। মোটকথা, আমাদের মসজিদগুলো মানুষের জন্য সুপথ প্রাপ্তির কারণ হয়েছে। হুযূর (আই.) আরও জানান, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় জামাত এ বছর ৯৭টি নতুন মিশন হাউজ নির্মাণের সৌভাগ্য লাভ করেছে। এসব মিশন হাউজও কীভাবে মানুষকে সত্যের দিশা দিয়েছে- এর কিছু উদাহরণ হুযূর উপস্থাপন করেন। হুযূর আরও বলেন, ওয়াকারে আমল বা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে মসজিদ ও মিশন হাউজ নির্মাণ আহমদীয়া জামাতের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য; এ বছর ১১৪টি দেশে মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণে জামাতের সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ৫২ লাখ ১৩ হাজার ইউএস ডলার সাশ্রয় হয়েছে, যা অন্যদের জন্য অকল্পনীয়।
রাকীম প্রেস, ওকালত এশায়াত, ওকালত তসনীফ এবং ওকালত এশায়াত তারসীল বিভাগের বরাতে প্রকাশনার ক্ষেত্রে জামাতের অগ্রগতির কিছু চিত্র হুযূর (আই.) তুলে ধরেন এবং কুরআনের টেক্সটের জন্য জামাতের নতুন উদ্ভাবিত ফন্ট, যার নাম মঞ্জুর ফন্ট রাখা হয়েছে এবং যা কায়দা ‘ইয়াসসারনাল কুরআন’-এর লিপি অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছে- সে বিষয়ে হুযূর জামাতকে অবগত করেন। তিনি লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত জামাতের পুস্তকাদির পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। জামাতের প্রকাশিত কুরআন ও বই-পুস্তকের মাধ্যমে তবলীগের কিছু চিত্রও হুযূর উপস্থাপন করেন। বিশেষভাবে ইউক্রেনের এক বন্ধু সের্গেই দিমিত্রিভ সাহেবের কথা হুযূর উল্লেখ করেন, যিনি ধর্মীয় দর্শনশাস্ত্রেরে একজন বিশেষজ্ঞ; হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কালজয়ী পুস্তক ‘ইসলামী নীতিদর্শন’ পড়ে তিনি একান্ত অভিভূত হয়ে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা হুযূর উল্লেখ করেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশের বই মেলায় জামাতের স্টলে এসে অন্যান্য ফির্কার মুসলমান ও বিধর্মীরা কীভাবে ইসলামের সত্যিকার শিক্ষামালা সম্পর্কে জেনে অভিভূত হয়েছেন সে সম্পর্কিত কতিপয় ঘটনাও হুযূর তুলে ধরেন। হুযূর বলেন, জামাতের ওপর আল্লাহ্ তা’লার বর্ষিত কৃপাবারির অজস্র ঘটনাবলীর মধ্য থেকে গুটিকতক মাত্র তুলে ধরা হল; এই রিপোর্টের অবশিষ্টাংশ রবিবার ইসলামাবাদের হল থেকে প্রদত্ত ভাষণে হুযূর তুলে ধরবেন, ইনশাআল্লাহ্- সবাইকে তা দেখা ও শোনার আমন্ত্রণ রইল।