প্রতিশ্রুত মসীহ্‌’র আগমনের উদ্দেশ্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩১-জুলাই, ২০২০

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩১শে জুলাই, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় উদ্ধৃতির আলোকে তাঁর (আ.) আগমনের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ সকালেই আমরা ঈদের নামায পড়েছি, একইসাথে আজ জুমুআর দিনও বটে। ঈদ ও জুমুআ একই দিনে অনুষ্ঠিত হলে মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘যাদের ইচ্ছা তারা জুমুআর পরিবর্তে যোহরের নামাযও পড়তে পারে।’ কিন্তু সেইসাথে তিনি (সা.) একথাও বলেছেন, ‘আমরা তো জুমুআই পড়ব।’ এজন্য যাদের ব্যস্ততা রয়েছে, তারা চাইলে জুমুআর পরিবর্তে যোহরের নামাযও পড়তে পারেন, তবে হুযূর (আই.) মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসারে জুমুআই পড়ছেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর খিলাফতকালে একবার যখন জুমুআর দিনেই ঈদুল আযহা হয়েছিল এবং অনেকেই জুমুআর পরিবর্তে যোহরের নামায পড়ার স্বপক্ষে মতামত দিচ্ছিলেন ও যোহরের নামায পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করছিলেন, তখন মুসলেহ্ মওউদ (রা.) খুব সুন্দরভাবে তাদেরকে এই উত্তর দিয়েছিলেন- “আমাদের আল্লাহ্ কত মহানুভব যে, তিনি আমাদেরকে একই দিনে দু’টো ঈদ দান করেছেন। যে ব্যক্তি দু’দুটো ঘিয়ে ভাজা রুটি পায়, সে কেন একটা ফেলে দেবে, যদি না সে নিতান্তই কোন সমস্যায় নিপতিত হয়? এজন্যই মহানবী (সা.) বলেছেন, যদি কেউ কোন বাধ্য-বাধকতার কারণে জুমুআ না পড়ে যোহরের নামায পড়ে, তবে অন্যদের তাকে তিরস্কার করা উচিত নয়। একইভাবে যারা ঈদ ও জুমুআ দু’টোই পড়ার সুযোগ পায়, অন্যরা যেন তাদের ওপর আপত্তি না তোলে আর এটি না বলে যে ‘এরা অবকাশের সুযোগটি গ্রহণ করে নি’।”
হুযূর (আই.) বলেন, তাই আজ আমরা জুমুআ পড়ছি, তবে খুতবা সংক্ষিপ্ত করব; খুতবার জন্য আমি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় উদ্ধৃতি বেছে নিয়েছি যাতে তিনি (আ.) নিজের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.)-কে খাতামান্ নবীঈন মান্য করার এবং সত্যিকার অর্থে জীবন্ত নবী গণ্য করার ব্যাপারে নিজ জামাতকে গভীর প্রজ্ঞার সাথে নির্দেশ দিয়েছেন, আর মহানবী (সা.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
হুযূর (আই.) বলেন, বিরুদ্ধবাদীরা আমাদের ওপর এই মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে যে, আমরা নাকি মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মান্য করে মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা ও মাহাত্ম্যকে খর্ব করি (নাউযুবিল্লাহ্)। তারা পাকিস্তানের সংসদে মহানবী (সা.)-এর নামের সাথে সর্বদা ‘খাতামান্ নবীঈন’ শব্দ লেখা বাধ্যতামূলক করার আইন পাস করে মনে করে- তারা বুঝি আহমদীদেরকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। অথচ এই নির্বোধরা এটা জানেও না, আহমদীরা তো মহানবী (সা.)-এর খাতামান্ নবীঈন পদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি অনুধাবনকারী, আর তা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ই তাদেরকে শিখিয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি কর্ম হযরত খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও প্রেমের পরিচায়ক- যা তাদের কল্পনারও অতীত।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের সম্বোধন করে একস্থানে বলেছেন, “তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য দু’টি; মুসলমানদের জন্য উদ্দেশ্য হল তারা যেন প্রকৃত অর্থে তাক্ওয়া ও পবিত্রতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা যেন এমন খাঁটি মুসলমান হয় যা আল্লাহ্ তা’লা মুসলমান শব্দের মধ্যে অন্তর্নিহিত রেখেছেন। আর অপর উদ্দেশ্য হল, খ্রিস্টানদের জন্য যেন ক্রুশভঙ্গ হয়, তাদের মনগড়া খোদার বিশ্বাস যেন ধ্বংস হয়, পৃথিবীবাসী যেন তাকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে এক-অদ্বিতীয় খোদার ইবাদত করে। তাঁর এই উদ্দেশ্য দেখেও কেন বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর (আ.) বিরোধিতা করে? যদি তিনি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকেন, তবে তাঁর ধ্বংস হওয়ার জন্য তাঁর মিথ্যাই যথেষ্ট! কেননা পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতে মিথ্যাবাদী কখনোই সফল হয় না, বরং ধ্বংস হয়। কিন্তু যেহেতু তিনি সত্যবাদী এবং তাঁর উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লার প্রতাপ ও মহানবী (সা.)-এর মহিমা ও আশিস প্রকাশ করা, এবং তাঁর জামাত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’লার স্বহস্তে রোপিত বৃক্ষ- এজন্য ফিরিশ্তারা তাঁর ও তাঁর মিশনের সুরক্ষা বিধানে নিয়োজিত। আর জগৎ এটি-ই দেখেছে- যতই আহমদীয়া জামাতের বিরোধিতা করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় জামাত ততই উন্নতি লাভ করেছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বিরুদ্ধবাদীদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, “মনে রেখ আমার এই জামাত প্রতিষ্ঠা যদি ধর্মব্যবসা হয়ে থাকে, তবে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এটি খোদা তা’লার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, আর অবশ্যই এটি খোদা তা’লার পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত, তবে সারা পৃথিবীও যদি এর বিরোধিতা করে- তবুও এটি বড় হবে, বিস্তৃত হবে এবং ফিরিশ্তারা এর সুরক্ষা বিধান করবে। যদি একজন মানুষও আমাদের পক্ষে না থাকে এবং কেউ-ই সাহায্য না করে, তবুও আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, এই জামাত সফল হবে।” তিনি (আ.) আরও বলেন, বিরোধিতা তাঁর জামাতের উন্নতির জন্য আবশ্যক, কেননা এটি আল্লাহ্‌র বিধান যে বিরোধিতা ছাড়া সত্য জামাতের উন্নতি সম্ভব নয়। হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নির্দেশমত সঠিক ইসলামী শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করার প্রতি জামাতের আপামর সদস্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বারংবার আল্লাহ্ তা’লার কসম খেয়ে নিজের ও তাঁর জামাতের মু’মিন মুসলমান হওয়ার এবং মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত আনুগত্য করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি (আ.) এ-ও বলেছেন, ‘ইসলামের বাইরে একটি পদক্ষেপও আমি ধ্বংসের কারণ জ্ঞান করি।’ তিনি (আ.) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যতটা আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও আশিস লাভ করতে পারে এবং যতটা আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জন করতে পারে- তা কেবল এবং কেবলমাত্র মহানবী (সা.)-এর খাঁটি আনুগত্য ও পরিপূর্ণ রসূলপ্রেমের মাধ্যমেই অর্জন করতে পারে, নতুবা নয়!’ একইসাথে তিনি (আ.) নিজ বিশ্বাসের এই বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন, তিনি কোন অবস্থাতেই হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবিতাবস্থায় স্বশরীরে আকাশে গমনে বিশ্বাসী নন; তিনি এর স্বপক্ষে আমাদের নেতা ও মনীব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুবরণের বিষয়টি প্রমাণরূপে উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁর (সা.) মৃত্যুর পর সাহাবীদের প্রথম ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন। সাহাবীদের প্রথম ইজমা এটি-ই ছিল যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বের সকল রসূল-ই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাছাড়া পৃথিবীতে রসূল প্রেরণের যে উদ্দেশ্য, তার নিরিখে যদি দৈহিকভাবে কারও জীবিত থাকা আবশ্যক হয়- তবে তা হল মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সত্তার। কুরআনের শিক্ষার বিপরীতে গিয়ে ঈসা (আ.)-কে জীবিত মনে করা মহানবী (সা.)-এর চরম অমর্যাদা ও অবমাননার নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিকভাবে চিরঞ্জীব একমাত্র রসূল হলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা ও মাহাত্ম্য এত সুন্দর ও উচ্চাঙ্গীণভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এত অসাধারণ শব্দচয়নের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত পরিচয় জগদ্বাসীর সামনে তুলে ধরেছেন যে, এর কোন তুলনাই হয় না। আল্লাহুম্মা সাল্লি ও সাল্লিম ওয়া বারিক আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাঈন।
হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সর্বদা মহানবী (সা.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অনুধাবন করার এবং সেমতে তাঁর (সা.) প্রতি দরূদ প্রেরণের সৌভাগ্য দান করুন; আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার প্রতি পূর্বের চেয়ে অধিক বিনত হই; আর আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতার জবাব নিজেদের কর্মের মাধ্যমে দেয়ার এটি-ই পদ্ধতি যে,আমরা যেন নিজেদের যাপিত জীবনের আলোকে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিই; আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই সৌভাগ্য দান করুন। (আমীন)