শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-জুলাই, ২০২০

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৭ই জুলাই, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.) এবং হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, বিগত খুতবায় হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.)’র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল। আহযাবের যুদ্ধ ও হযরত সা’দ বিন মুআযের বিষয়ে সীরাত খাতামান নবীঈন পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে যে, এই যুদ্ধে মুসলমানদের প্রাণের তেমন কোন ক্ষতি হয় নি, পাঁচ-ছয়জন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন; কিন্তু এই যুদ্ধে সা’দ বিন মুআয (রা.) এরূপ গুরুতর আহত হন যে, পরিণামে সেই আঘাতই তার শাহাদতের কারণ হয়, তার মৃত্যু মুসলমানদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। অন্যদিকে কাফিরদের যদিও মাত্র তিনজন নিহত হয়েছিল, কিন্তু এই যুদ্ধের পর তারা মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, পরবর্তীতে কুরাইশরা আর কখনও এভাবে দলবেঁধে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার সাহস পায় নি। আর এর মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছিল অর্থাৎ ‘এখন থেকে কাফিররা আর আমাদের ওপর আক্রমণ করবে না।’ হাদীস ও ইতিহাসগ্রন্থসমূহের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত সা’দের হাতের কব্জিতে বা বাহুর শিরায় একটি তীর বিঁধেছিল; তীর ছুঁড়েছিল হুব্বান বিন আরেকাহ্ নামক এক কুরাইশ। যুগের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুযায়ী মহানবী (সা.) নিজহাতে তীরের ফলা বের করে সেই ক্ষতটির রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ছ্যাঁকা দেন। এতে রক্তপাত বন্ধ হয়ে ক্ষতস্থানটি ফুলে যায়। মহানবী (সা.) তখন পুনরায় ক্ষতস্থানটি কেটে আবারও ছ্যাঁকা দেন, তখন রক্তপাত বন্ধ হয়। মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণেই একটি তাঁবুতে সা’দের চিকিৎসার আয়োজন করেন, যেন তিনি (সা.) স্বয়ং চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে পারেন। রাফিদা নাম্নী একজন মুসলিম নারী, যিনি সেবিকা হিসেবে সাহাবীদের সেবা-শুশ্রূষা করতেন, তাকেই হযরত সা’দের সেবায় নিয়োজিত করা হয়।
হযরত সা’দ (রা.) আহত হওয়ার পর দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! বনু কুরায়যার বিষয়ে তুমি আমাকে আশ্বস্ত না করা পর্যন্ত তুমি আমাকে মৃত্যু দিও না।’ এরপর বনু কুরায়যার দাবী অনুসারে তাদের বিচারের জন্য হযরত সা’দ আহত অবস্থাতেই ছুটে যান। তাদের বিচারকার্য শেষে ফেরার পর হযরত সা’দ আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্, তুমি জান, যারা তোমার রসূল (সা.)-কে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দেশান্তরিত করেছে তোমার পথে সেই কুরাইশদের সাথে জিহাদ করার চাইতে আর কোন কিছুই আমার অধিক প্রিয় নয়। হে আল্লাহ্, আমি মনে করি, তুমি তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের ইতি টেনে দিয়েছ। যদি কুরাইশদের সাথে আরও কোন যুদ্ধ অবশিষ্ট থাকে, তবে আমাকে জীবিত রাখ যেন আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারি। আর যদি তা না হয়, তবে আমার এই ধমনী উন্মুক্ত করে দাও এবং এই আঘাতকে আমার শাহাদতের কারণ বানিয়ে দাও।’ আল্লাহ্ তা’লা হযরত সা’দের এই দোয়া কবুল করেন এবং তার এই ক্ষত আবারও ফেটে গিয়ে প্রবল রক্তপাত শুরু হয়, এমনকি রক্ত গড়িয়ে তাঁবুর বাইরে চলে আসে। খবর পেয়ে মহানবী (সা.) সা’দের কাছে ছুটে আসেন ও পরম মমতায় তার মাথা নিজের কোলে তুলে নেন; হযরত সা’দের রক্তে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মুখমণ্ডল ও দাড়ি রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। মহানবী (সা.) এ অবস্থাতেই দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! সা’দ তোমার পথে জিহাদ করেছে ও তোমার রসূলের সত্যায়ন করেছে এবং তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সে পালন করেছে; তুমি তার আত্মাকে সেই কল্যাণের সাথে গ্রহণ কর, যেভাবে তুমি আত্মাদের গ্রহণ করে থাক।’ অতঃপর এই সৌভাগ্যবান সাহাবী মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কোলে মাথা রেখেই মৃত্যুবরণ করেন।
সা’দ বিন মুআয (রা.)’র মৃত্যুতে তার বৃদ্ধা মা আরবের রীতি অনুসারে তার প্রশংসা করে বিলাপ করেন। সাহাবীরা তাকে বাধা দিতে চাইলেও মহানবী (সা.) তাকে এরূপ করতে দেন এবং বলেন, ‘বিলাপকারিনীরা সাধারণত মিথ্যা প্রশংসা করে থাকে, কিন্তু সা’দের মা সম্পূর্ণ সত্য বলছে।’ হযরত সা’দ স্থূলকায় ও বিশালবপুর অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তার জানাযা ওঠানোর সময় তা অনেক হালকা মনে হচ্ছিল। এতে মুনাফিকরা তির্যক মন্তব্য করে, বনু কুরায়যার সাথে অন্যায় বিচার করার কারণে সা’দ এর সাথে এমনটি হয়েছে। একথা শুনে মহানবী (সা.) বলেন, আসলে সা’দের জানাযা ফিরিশ্তারা বহন করেছেন, এজন্য তা হালকা মনে হয়েছে। তিনি (সা.) এ-ও বলেছিলেন, ‘সা’দের মৃত্যুতে আরশও দুলে উঠেছে।’ এর প্রকৃত মর্মার্থ ছিল, হযরত সা’দের আত্মার সম্মানে আল্লাহ্ তা’লার আরশও আন্দোলিত হয়েছিল। শাহাদতের সময় হযরত সা’দ বিন মুআযের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৭ বছর। তাকে জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত করা হয়। হযরত সা’দ বলতেন যে তিনি খুব দুর্বল মানুষ, কিন্তু তিনটি বিষয় তিনি খুব দৃঢ়ভাবে পালন করেছেন। প্রথমতঃ তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে যা শুনেছেন, সেটিকে নিঃসংশয়ে সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন; দ্বিতীয়তঃ নামায পড়ার সময় নামায ছাড়া অন্য কোন চিন্তা করেন নি, পূর্ণ মনোযোগের সাথে নামায পড়েছেন; তৃতীয়তঃ যখনই তিনি কারও জানাযা পড়ার জন্য দাঁড়াতেন, নিজেকে মৃত ব্যক্তির স্থানে জ্ঞান করে ভাবতেন, এখন কী কী প্রশ্নোত্তর হবে, অর্থাৎ পরকালের কথা চিন্তা করতেন।
এরপর হুযূর (আই.) হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র স্মৃতিচারণ করেন। হযরত সা’দের ডাকনাম ছিল আবু ইসহাক। তার পিতার নাম ছিল মালেক বিন উহায়েব; অবশ্য তার পিতা ‘আবু ওয়াক্কাস’ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তার মাতার নাম ছিল হামনা বিনতে সুফিয়ান। হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) কুরাইশদের বনু যুহরা গোত্রভুক্ত ছিলেন। হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ‘আশারায়ে মুবাশ্‌শারাহ্’ বা সেই দশজন সাহাবীর অন্যতম ছিলেন, যাদেরকে মহানবী (সা.) নিজের জীবদ্দশাতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন; তিনি তাদের মধ্যে সবার শেষে মৃত্যুবরণ করেন। হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) একেবারে শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; তার নিজের বর্ণনামতে তিনি প্রথম তিনজন মুসলমানের একজন ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি নামায ফরয হওয়ার পূর্বেই মুসলমান হয়েছিলাম।’ হযরত সা’দ স্বপ্ন দেখে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার মেয়েকে বলেছিলেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি অন্ধকারে রয়েছি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমি দেখি যে চাঁদ উঠেছে আর আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি আমার আগেই হযরত যায়েদ বিন হারসা, হযরত আলী ও হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহুম চাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কখন আসলেন?’ তারা উত্তরে বলেন, ‘আমরাও এখনই এলাম।’ এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র সতের বছর।
হযরত সা’দের মা তাকে ইসলাম ত্যাগ করার জন্য অনেক চাপ প্রয়োগ করেছিল এবং পবিত্র কুরআনে প্রদত্ত পিতা-মাতার নির্দেশ মানার দোহাই দিয়েও তাকে ইসলাম ত্যাগ করতে বলেছিল; এমনকি আমৃত্যু উপোস করারও হুমকি দিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই আল্লাহ্ তা’লা সূরা লোকমানে এই নির্দেশ দেন, পিতা-মাতা শিরকের আদেশ দিলে তা মানা যাবে না। মহানবী (সা.) হযরত সা’দকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করতেন, কারণ মহানবী (সা.)-এর মা হযরত আমিনা ও হযরত সা’দ দু’জনই বনু যুহরা গোত্রভুক্ত ছিলেন। হযরত সা’দ সেই ব্যক্তি, যিনি ইসলামের পক্ষে প্রথম কোন মুশরিকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন। মক্কায় অবস্থানকালীন কুরাইশদের বয়কটের শিকার হয়ে সাহাবীরা যখন আবু তালিবের উপত্যকায় দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ ছিলেন, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসও সেখানে ছিলেন। একদিন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় তিনি পায়ের নিচে নরম-ভেজা কিছু অনুভব করলে তা তুলে মুখে পুরে দেন, তিনি জানতেনও না তা কী ছিল। হযরত সা’দ প্রথমদিকে হিজরতকারীদের একজন ছিলেন। মহানবী (সা.) হযরত মুসআব বিন উমায়েরের সাথে তার ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন; অপর এক বর্ণনামতে তার ধর্মভাই ছিলেন হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.)।
হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) অত্যন্ত সাহসী ও বীরপুরুষ ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময় মহানবী (সা.)-এর সুরক্ষায় নিবেদিত থাকতেন। হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি-ই ইরাক জয় করেন। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পরে যখন কুরাইশদের আক্রমণের খুব আশংকা থাকতো, তখন হযরত সা’দ মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তায় আত্মনিবেদন করেছিলেন; এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রহরায় থাকতেন। মহানবী (সা.) তার জন্য দোয়া করেছিলেন, আল্লাহ্ তা’লা যেন সা’দের সব দোয়া কবুল করেন; এ কারণে হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস যে দোয়াই করতেন, তা দ্রুত কবুল হয়ে যেত। হুযূর বলেন, হযরত সা’দের অবশিষ্ট স্মৃতিচারণ পরবর্তীতে করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) তিনটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা রাবওয়া নিবাসী শ্রদ্ধেয় মাস্টার আব্দুস সামী খান সাহেবের, যিনি তালীমুল ইসলাম স্কুলে হুযূর (আই.)-এরও শিক্ষক ছিলেন; দ্বিতীয় জানাযা লন্ডন-প্রবাসী শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজিবুল্লাহ্ সাদেক সাহেবের। হুযূর (আই.) উভয়ের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তাদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তাদের দু’জনের গায়েবানা জানাযার সাথে হুযূর মরহুম রানা নঈমউদ্দীন সাহেবের গায়েবানা জানাযাও অন্তর্ভুক্ত করেন, যার স্মৃতিচারণ ইতোপূর্বেই হুযূর করেছেন।