শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
১০-জুলাই, ২০২০
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১০ই জুলাই, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায়ও তিনি হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত খুতবায় যেমনটি বলেছিলাম, আহযাবের যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকার শাস্তির বিষয়ে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-এর কাছে নির্দেশ এসেছিল এবং এর প্রেক্ষাপটে তাদের সাথে যুদ্ধ হয় ও এক পর্যায়ে বনু কুরায়যা যুদ্ধ বন্ধ করে হযরত সা’দ (রা.)’র মাধ্যমে মীমাংসা করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে; এরপর ইহুদীদের শিক্ষানুসারে হযরত সা’দ মীমাংসা করেন। এই ঘটনাটির যে বিবরণ হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) ও সাহেবযাদা মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) দিয়েছেন হুযূর (আই.) আজ সেগুলোই স্ববিস্তারে আলোচনা করেন।
দীর্ঘ বিশদিন পর আহযাবের যুদ্ধ সমাপ্ত হলে মুসলমানরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু মদীনায় ফেরার পথেই বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিকার করার সিদ্ধান্ত চলে আসে এবং সাহাবীদেরকে সন্ধ্যার পূর্বেই বনু কুরায়যার এলাকায় পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে হযরত আলী (রা.) ইহুদীদেরকে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে গেলে তারা কোনরূপ অনুতাপ প্রকাশের পরিবর্তে উল্টো দুর্ব্যবহার শুরু করে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে সবরকম চুক্তি অস্বীকার করে, মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য শুরু করে। মহানবী (সা.) ইহুদীদের সাথে কথা বলার জন্য অগ্রসর হলে তারা দূর্গের ফটক বন্ধ করে দেয় ও মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করে। বাধ্য হয়েই মুসলমানরা তাদের দূর্গ অবরোধ করেন। কিছুদিন অবরুদ্ধ থেকে ইহুদীরা রণে ভঙ্গ দিলেও তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে দূত মারফত আবু লুবাবা আনসারীকে তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য পাঠাতে অনুরোধ করে। যদিও মহানবী (সা.) তখনও পর্যন্ত বনু কুরায়যার শাস্তির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেন নি, কিন্তু তাদের অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে আবু লুবাবা তাদের সাথে আলোচনার সময় ইঙ্গিতে বলেন, মহানবী (সা.) নিশ্চয়ই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেবেন। এতে বনু কুরায়যা গোঁয়ার্তুমি করে বলে, তারা মহানবী (সা.)-এর বিচার মানতে প্রস্তুত নয়, বরং তারা তাদের মিত্র অওস গোত্রের নেতা সা’দ বিন মুআযের বিচার মেনে নেবে। যুদ্ধাহত হযরত সা’দ (রা.) তখন চিকিৎসাধীন ছিলেন, মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ পেয়ে তিনি দ্রুত ছুটে যান। অওস গোত্রের অন্য সদস্যরা হযরত সা’দকে বারংবার অনুরোধ করেন তিনি যেন বনু কুরায়যার সাথে পুরনো মিত্রতা বিবেচনা করে তাদেরকে গুরুদ- না দেন। কিন্তু সা’দ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি সঠিক ও ন্যায় মীমাংসা করতে বদ্ধপরিকর। উল্লেখ্য যে, বনু কুরায়যার নেতৃবৃন্দ যখন মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত না মানার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, তখন বেশ কয়েকজন ইহুদী নেতা তাদের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে। তারা বলেছিল, যেহেতু তাদের গোত্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং ইসলাম-ই সত্য ধর্ম প্রতীয়মান হচ্ছে, তাই হয় এখন তারা মুসলমান হয়ে যাক, নতুবা জিযিয়া বা কর দিতে সম্মত হোক। কিন্তু বাকিরা গোঁ ধরে যে, তারা এরূপ করবে না। তখন সেই সত্যনিষ্ঠ ইহুদীরা তাদের ব্যাপারে নিজেদের দায়মুক্তি ঘোষণা করেন। তাদের কয়েকজন বিশুদ্ধচিত্তে ইসলাম গ্রহণ করেন ও তাদের একজন ইসলাম গ্রহণ না করলেও দূর্গ ছেড়ে বেরিয়ে যান; দূর্গের প্রহরায় রত মুসলিম বাহিনীর নেতা মুহাম্মদ বিন মাসলামা তাকে সসম্মানে যেতে দেন, কারণ সেই ইহুদী নিজ জাতির দুষ্কৃতিতে লজ্জিত ছিলেন। আর এ কাজে মহানবীরও সম্মতি ছিল।
হযরত সা’দ (রা.) প্রথমে স্বজাতির লোকদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেন যে, তারা সা’দের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও অবশ্য পালনীয় বলে মানবেন, একইভাবে মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকেও অনুরূপ অঙ্গীকার নেন। সবাই অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে তিনি ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তওরাতে প্রদত্ত শিক্ষানুসারে মীমাংসা দেন- বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধবাজ নেতাদের হত্যা করা হোক, তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করা হোক এবং তাদের সব সহায়-সম্পত্তি মুসলমানদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হোক। সা’দের এই সিদ্ধান্ত শুনে মহানবী (সা.)-এর মুখ থেকে আপনা-আপনি এই বাক্য নিসৃত হয়- ‘তোমার এই সিদ্ধান্ত এমন এক ঐশী নিয়তি যা খণ্ডন করা সম্ভব নয়।’ কারণ ইতিহাস সাক্ষী, মহানবী (সা.) এরূপ দয়ার্দ্রচিত্ত ও কোমলমতি ছিলেন যে, এই একটি ঘটনা ছাড়া যতবার শত্রুরা নিজেদেরকে মহানবী (সা.)-এর সমীপে সমর্পণ করেছে- তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, বড়জোর তাদেরকে দেশান্তরের শাস্তি দিয়েছেন। বনু কুরায়যার হযরত আবু লুবাবাকে ডেকে তার সাথে পরামর্শ করা ও আবু লুবাবার মুখ থেকে এমন কথা বের হওয়া যে, মহানবী তোমাদের মৃত্যুদণ্ড দিবেন- যা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, আর মহানবী (সা.)-কে বিচারক মানতে বনু কুরায়যার অস্বীকৃতি এবং তাদের এমনটি মনে করা যে, ‘অওস গোত্র আমাদের মিত্র, তাই তারা আমাদের প্রতি দয়া দেখাবে’ এবং এই ধারণার বশবর্তী হয়ে অওস গোত্রের নেতা সা’দ বিন মুআযকে নিজেদের বিচারক মানা, এরপর ন্যায়বিচার ও সঠিক মীমাংসা করার ব্যাপারে সা’দের এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের পূর্বে মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নেয়া যে অবশ্যই তার সিদ্ধান্ত মানতে হবে ও সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে- এ সবগুলো বিষয় একসাথে সংঘটিত হওয়া কোন কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না; নিঃসন্দেহে এর পেছনে ঐশী তকদীর বা নিয়তি কাজ করছিল। বস্তুতঃ বনু কুরায়যার জঘন্য অপরাধের কারণে এটি আল্লাহ্র অমোঘ সিদ্ধান্ত ছিল।
হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.)’র সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর মহানবী (সা.) ব্যথিতহৃদয়ে মদীনায় ফিরে আসেন, ইহুদীদেরকেও মদীনায় এনে নারী-পুরুষ-শিশুদের পৃথক পৃথক স্থানে রাখা হয়। মজার ব্যাপার হল, সাহাবীরা তাদের জন্য উন্নত খাবারেরও আয়োজন করেন, অথচ স্বয়ং তাদের অনেকেই তখনও অভুক্ত ছিলেন। পরদিন একে একে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়; মহানবী (সা.) নিজেও কাছেই বসে থাকেন যেন বিশেষ কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বা যদি কারও শাস্তি তিনি মওকুফ করতে চান, তবে তা করতে পারেন। এ-ও জানা যায়, যারা অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেছিল, মহানবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, এমনকি তাদের স্ত্রী-সন্তান ও সহায়-সম্পত্তিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
যদিও গবেষণায় সাব্যস্ত হয় যে, সর্বসাকুল্যে ১৬/১৭ জন ইহুদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রাচ্যবীদ অমুসলমান লেখকরা সত্যের অপলাপ করে বলে, মহানবী (সা.) নয়শ’ বা হাজার সংখ্যক ইহুদীকে হত্যা করেছেন, যেখানে তাদের সাকুল্য সংখ্যাই ছিল শ’চারেক। তারা অনুযোগ করে যে, মহানবী (সা.) চরম অত্যাচার করেছেন; অথচ সংখ্যা যা-ই হোক, এই শাস্তির দায় কোনভাবেই মহানবী (সা.)-এর ওপর বা মুসলমানদের ওপর বর্তায় না। প্রথমতঃ ঘটনার পরম্পরা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, এটি অমোঘ ঐশী তকদীর ছিল; উপরন্তু সিদ্ধান্ত মহানবী (সা.) দেন নি, দিয়েছিলেন হযরত সা’দ। আর বনু কুরায়যার অপরাধ বিবেচনা করলে এই শাস্তি মোটেও অযৌক্তিক ছিল না, বরং তা যথার্থ ও উপযুক্ত ছিল; খোদ অপরাধীরাই বিনাবাক্যব্যয়ে এই বিচার মেনে নিয়েছিল। প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ মার্গুলিস, যিনি মোটেও ইসলামের পক্ষের লোক নন, তিনি নিজেও বনু কুরায়যার এই শাস্তিকে যুক্তিসংগত বলে প্রমাণ করেছেন। আর হযরত সা’দ যেহেতু তার সিদ্ধান্ত মানার ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, সেজন্য মহানবী (সা.)-এর পক্ষে তা পরিবর্তন করাও সম্ভবপর ছিল না। এগুলো বাদ দিলেও সবাই একথা মানতে বাধ্য যে, হযরত সা’দের মীমাংসা মহানবী (সা.)-এর ইচ্ছানুযায়ী কিংবা কুরআনের শিক্ষাসম্মত ছিল না। বাইবেলের ‘দ্বিতীয় বিবরণ’-এ যে শিক্ষা মূসা (আ.) আল্লাহ্র কাছ থেকে লাভ করে তার জাতিকে বহু পূর্বেই দিয়ে গিয়েছিলেন এবং যে শিক্ষা হাজার বছর ধরে ইহুদীরা স্বয়ং পালন করে আসছে- হযরত সা’দ কেবল সেই শিক্ষারই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। কাজেই, অত্যাচার যদি কেউ করেই থাকে, তবে ইহুদীরা স্বয়ং নিজেদের প্রাণের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল! যদি এটি অত্যাচার হয়েই থাকে, তবে খ্রিস্টান লেখকদের উচিত তারা মূসা (আ.)-কে অত্যাচারী আখ্যা দিক; কিংবা মূসা (আ.)-এর খোদাকে অত্যাচারী আখ্যা দিক- যিনি তওরাতে এই শিক্ষা প্রদান করেছেন। বনু কুরায়যার বিচার নিয়ে হযরত সা’দ সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা শেষে হুযূর (আই.) বলেন, হযরত সা’দ বিন মুআযের যেটুকু স্মৃতিচারণ অবশিষ্ট রয়েছে- তা পরবর্তীতে করা হবে (ইনশাআল্লাহ্)।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) কয়েকজন পুণ্যবান আহমদীর সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন, যারা সম্প্রতি ইহধাম ত্যাগ করেছেন। তাদের মধ্যে প্রথম হলেন, ঘানার লাজনা ইমাইল্লাহ্র সদর শ্রদ্ধেয়া হাজিয়া রুকাইয়া খালেদ সাহেবা; দ্বিতীয় অবসরপ্রাপ্ত মুবাল্লিগ মওলানা শেখ মোবারক আহমদ সাহেবের সহধর্মিনী শ্রদ্ধেয়া সুফিয়া বেগম সাহেবা; তৃতীয় অবসরপ্রাপ্ত মুয়াল্লিম ওয়াকফে জাদীদ জনাব আলী আহমদ সাহেব, চতুর্থ জনাব বশীর আহমদ ডোগর সাহেবের সহধর্মিনী রফিকা বিবি সাহেবা। হুযূর তাদের রূহের মাগফিরাতের জন্য ও তাদের পদমর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য দোয়া করেন। এদের পাশাপাশি হুযূর ইতোপূর্বে করোনা ভাইরাসের কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় যাদের জানাযা পড়াতে পারেন নি, কেবল স্মৃতিচারণ করেছিলেন- তাদেরও গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং সবার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করেন। (আমীন)