শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৮-মে, ২০২০

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৮ই মে, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত খাব্বাব বিন আল্ আরত (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি বদরী সাহাবী হযরত খাব্বাব বিন আল্ আরত (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করব। হযরত খাব্বাব বনু সা’দ বিন যায়দ গোত্রভুক্ত ছিলেন; তার পিতার নাম ছিল আরত বিন জানাদালাহ, হযরত খাব্বাবের ডাকনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্, কোন কোন বর্ণনায় তার ডাকনাম আবু মুহাম্মদ বা আবু ইয়াহ্ইয়াও বর্ণিত হয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগে তাকে কৃতদাসরূপে মক্কায় বিক্রি করে দেয়া হয়, তিনি উতবা বিন গাযওয়ানের কৃতদাস ছিলেন; কারও কারও মতে তিনি উম্মে আনমার খুযাইয়ার দাস ছিলেন। তিনি বনু যোহরা গোত্রের সাথে মৈত্রী-চুক্তিতে আবদ্ধ হন। তিনি প্রথমদিকের মুসলমানদের মধ্যে ষষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন এবং সেই মুসলমানদের একজন ছিলেন- যারা নিজেদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি প্রকাশ করার ফলে ঘোর বিরোধিতা ও চরম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। হযরত খাব্বাব মহানবী (সা.)-এর দ্বারে আরকাম থেকে তবলীগি কার্যক্রম আরম্ভ করার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
মুজাহিদ লিখেছেন, মহানবী (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথম যারা ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি প্রকাশ করেন তারা হলেন- হযরত আবু বকর, হযরত খাব্বাব, হযরত সুহায়ব, হযরত বেলাল, হযরত আম্মার ও হযরত আম্মারের মা হযরত সুমাইয়া (রা.)। মহানবী (সা.)-কে তো আল্লাহ্ তা’লা তাঁর চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে নিরাপদ রাখেন। কুরাইশের রোষানল থেকে আবু বকর (রা.)-কে তার গোত্র নিরাপদ রাখে, কিন্তু বাকিরা চরম অত্যাচারের সম্মুখীন হন; তাদেরকে লোহার পোশাক পরানো হয়, সূর্যের তপ্ত রোদে তাদেরকে ঝলসানো হয়, আর আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় তারা লোহা ও সূর্যের এই দহন সহ্য করেন। শা’বী বলেন, কাফিররা হযরত খাব্বাবের পিঠের ওপর উত্তপ্ত পাথর রেখে দিতো, যার ফলে তার পিঠের মাংস ঝলসে যেত; কোন কোন বর্ণনা থেকে এটিও জানা যায় যে, হযরত খাব্বাব (রা.)-কে জ¦লন্ত অঙ্গারের ওপর শুইয়ে দেয়া হতো, যার ফলে তার পিঠের চামড়া ও মাংস পুড়ে গিয়ে কুষ্ঠের মত সাদা সাদা দাগ হয়ে গিয়েছিল। মুজাহিদের বর্ণনা প্রসঙ্গে হুযূর (আই.) বলেন, তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি বর্ণনা দিয়েছেন, যদিও ইতিহাস থেকে প্রমাণিত বিষয় হল- মহানবী (সা.) স্বয়ং এবং হযরত আবু বকর (রা.)ও বিভিন্ন সময় কুরাইশদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন; এমনকি তাঁর (সা.) চাচা আবু তালিবও চরম নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন।
হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের চমকপ্রদ ঘটনাটি, যা প্রায় সব মুসলমানেরই জানা, তাতেও হযরত খাব্বাব (রা.)’র নাম যুক্ত আছে। হযরত উমর (রা.) এমনিতেই কঠোর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, ইসলামের শত্রুতায় তিনি আরও কঠোর ছিলেন। একদিন তিনি ভাবেন- এই যাবতীয় সমস্যা ও বিশৃঙ্ক্ষলার শেকড়টা উপড়ে ফেললেই তো মিটে যায়; একথা ভেবে তিনি মহানবী (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে কেউ একজন তার এই সংকল্পের কথা শুনে বলেন- ‘আগে নিজের ঘর সামলাও, তোমার বোন আর ভগ্নিপতিও মুসলমান হয়ে গিয়েছে।’ একথা শুনে উমর (রা.) খুব রেগে বোন ফাতেমার বাড়িতে যান, সেখানে গিয়ে তিনি ঘরের ভেতর থেকে সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠের শব্দ শুনতে পান, যা হযরত খাব্বাব (রা.) তিলাওয়াত করছিলেন। ঘটনার এক পর্যায়ে হযরত উমর (রা.) নিজে কুরআনের সেই আয়াতগুলো পড়ে আশ্চর্য হয়ে যখন এর সত্যতার কথা স্বীকার করেন, তখন হযরত খাব্বাব (রা.) আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন ও বলেন, ‘এটি তো মহানবী (সা.)-এর দোয়ারই ফল; আল্লাহ্‌র কসম! গতকালই আমি তাঁকে এই দোয়া করতে শুনেছি- ‘হে আল্লাহ্! উমর বিন খাত্তাব বা উমর বিন হিশাম (অর্থাৎ, আবু জাহল) এর মধ্য থেকে একজনকে অবশ্যই ইসলামের সেবায় দান কর।’
হযরত খাব্বাব (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন আমি মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হই যখন তিনি (সা.) একটি গাছের নিচে শুয়ে ছিলেন; আমি নিবেদন করি- ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কি সেই জাতির বিরুদ্ধে আমাদের জন্য দোয়া করবেন না, যাদের নিয়ে আমরা শংকিত- তারা আবার আমাদেরকে আমাদের ধর্ম থেকে বিমুখ না করে ফেলে?’ তিনি (সা.) আমার দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। আমি বারবার একথা বলছিলাম আর তিনি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন; এরকম তিনবার হয়। তৃতীয়বারে তিনি (সা.) উঠে বসেন এবং বলেন, ‘হে লোকেরা, আল্লাহ্‌ তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং ধৈর্য ধর! আল্লাহ্‌ কসম! তোমাদের পূর্বে এমন মানুষ গত হয়েছে, যাদের মাথায় করাত চালিয়ে তাদেরকে দু’টুকরো করে ফেলা হতো, তবুও তারা তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় নি।’
হযরত খাব্বাব (রা.) কামারের কাজ করতেন; আস বিন ওয়ায়েল নামক এক কাফিরের কাছে তিনি কিছু টাকা পাওনা ছিলেন। একদিন তিনি তার কাছে পাওনা টাকা চাইতে গেলে সে বলে, মুহাম্মদকে (সা.) অস্বীকার না করা পর্যন্ত তোমাকে তোমার পাওনা দেব না; হযরত খাব্বাব তা করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সূরা মরিয়মের ৭৮-৮১ নং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়, যাতে পরকালে সেই ব্যক্তির জন্য কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে।
একদা হযরত খাব্বাব (রা.) হযরত উমর (রা.)’র দরবারে যান। তিনি (রা.) তাকে ডেকে নিজের কাছে বসান আর বলেন, তার কাছে বসার অধিকার হযরত খাব্বাবের চেয়ে বেশি আর কারও নেই, শুধুমাত্র একজন ছাড়া। খাব্বাব (রা.) জানতে চান, ‘হে আমীরুল মুমিনীন, তিনি কে?’ হযরত উমর (রা.) হযরত বেলাল (রা.)’র নাম উল্লেখ করলে হযরত খাব্বাব (রা.) বলেন, তার অধিকার আমার চেয়ে বেশি হতে পারে না; কারণ তিনি যখন মুশরিকদের অধীনে ছিলেন, তখন কারও না কারও মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা তাকে অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতেন। কিন্তু আমাকে বাঁচানোর কেউ ছিল না। খাব্বাব (রা.) একদিনের ঘটনার উল্লেখ করেন যেদিন তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয় এবং জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর শুইয়ে তার বুকের ওপর পাড়া দিয়ে রাখা হয়; তিনি নিজের জামা সরিয়ে সেই ক্ষতের দাগগুলো হযরত উমর (রা.)-কে দেখান।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) হযরত খাব্বাব (রা.)’র উল্লেখ করতে গিয়ে এ বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনি যে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং ঈমানে অবিচল ছিলেন, এর পরিণতিতে ইসলামের বিজয়ের যুগে আল্লাহ্ তা’লা তাকে ও তার মত অন্যান্য দরিদ্র আর কৃতদাস সাহাবীদের সম্মানিতও করেছেন। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার হুযূর উল্লেখ করেন। হযরত উমর (রা.) খলীফা হবার পর একবার মক্কায় আসেন; তার সাথে দেখা করার জন্য মক্কার সব সম্ভ্রান্ত নেতারা উপস্থিত হয়। তারা এসে হযরত উমর (রা.)’র সাথে আলাপ করছিল, এমন সময় হযরত বেলাল (রা.) এসে উপস্থিত হন, একটু পরে হযরত খাব্বাব (রা.) উপস্থিত হন; এভাবে একে একে প্রথম দিকের ঈমান আনয়নকারী দাসেরা আসতে থাকেন। তারা একসময় সেই নেতাদের বা তাদের পূর্বপুরুষদের কৃতদাস ছিলেন। যখনই তারা সভায় আসছিলেন, হযরত উমর (রা.) সসম্মানে তাদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন এবং নেতাদেরকে বলছিলেন, ‘আপনারা একটু পিছিয়ে বসুন’। এভাবে পেছাতে পেছাতে সেই নেতারা একসময় দরজার কাছে জুতোর উপর গিয়ে পৌঁছে। পরে হযরত উমর (রা.)’র নির্দেশে তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন এবং পিতৃপুরুষদের অপরাধের ঋণ শোধ করে অন্তর্জালা থেকে মুক্তি লাভ করেন।
হযরত খাব্বাব ও হযরত মিকদাদ বিন আমর যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন হযরত কুলসুম বিন হিদমের বাড়িতে তারা অবস্থান করেন, হযরত কুলসুমের মৃত্যু পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করেন। বদরের যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে হযরত কুলসুমের মৃত্যু হয়েছিল, তখন তারা হযরত সা’দ বিন উবাদার কাছে থাকতে শুরু করেন; ৫ম হিজরিতে বনু কুরায়যার ওপর বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করেন। মহানবী (সা.) হযরত খাব্বাব ও হযরত খিরাশ বিন সিম্মাহ্‌র মুক্তকৃত দাস হযরত তামীমের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক স্থাপন করেন; অপর এক বর্ণনামতে হযরত জাবের বিন আতিক ছিলেন তার ধর্মভাই। হযরত খাব্বাব বদর, উহুদ, খন্দকসহ অন্যান্য সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেন।
আবু খালেদ বর্ণনা করেন, একদিন আমরা মসজিদে বসে ছিলাম; হযরত খাব্বাব (রা.) মসজিদে আসেন ও নীরবে বসে পড়েন। সবাই তাকে অনুরোধ করেন, আপনি আমাদের কোন উপদেশ দিন। হযরত খাব্বাব (রা.), যিনি অত্যন্ত খোদাভীরু ব্যক্তি ছিলেন, তাদেরকে বলেন- আমি কী উপদেশ দিব? পাছে এমন না হয় যে আমি এমন উপদেশ দিয়ে বসি, যা আমি নিজেই পালন করি না! হযরত খাব্বাব (রা.) মৃত্যুর পূর্বে দীর্ঘদিন প্রচন্ড অসুস্থতায় ভুগেছিলেন। একদিন তিনি তাকে দেখতে আসা একজন সাহাবীকে বলেন, আমি যদি মহানবী (সা.)-কে একথা বলতে না শুনতাম যে ‘মৃত্যু কামনা করা কারও জন্য সঙ্গত নয়’, তাহলে আমি নিজের মৃত্যু কামনা করতাম। তিনি হযরত হামযা, হযরত মুসআব বিন উমায়ের প্রমুখদের স্মরণ করে এ-ও বলেন, তাদের মৃত্যুর সময় যথেষ্ট কাফনের কাপড়ও ছিল না; অথচ আজ তার ঘরের কোণে সিন্দুকে চল্লিশ হাজার দিরহাম পড়ে রয়েছে। তিনি বেদনার্ত হয়ে বলেন, আমার শংকা হয়- আমাদের পুণ্যের প্রতিদান এই পৃথিবীতেই দেয়া হয়ে যাচ্ছে না তো!
হযরত আলী (রা.) সিফফিনের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে যখন কুফার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন, তখন ডানদিকে সাতটি কবর দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, প্রথম কবরটি হযরত খাব্বাব (রা.)’র। হযরত আলী (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ্ খাব্বাবের প্রতি কৃপা করুন। তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, এরপর আনুগত্যের নিমিত্তে হিজরত করেন, তিনি একজন মুজাহিদের মত জীবন যাপন করেছেন এবং দৈহিক কষ্ট সহ্য করেছেন (অর্থাৎ তিনি দীঘদির্ন রোগ-ভোগ করেছেন); যে ব্যক্তি পুণ্যকর্ম করে, আল্লাহ্ তার প্রতিদান বিনষ্ট করেন না!’ তিনি তার কবরের কাছে গিয়েও দীর্ঘ দোয়া করেন। হযরত খাব্বাব ৩৭ হিজরিতে ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।