শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-এপ্রিল, ২০২০

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩রা এপ্রিল, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায়ও তিনি হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের হুযূর (আই.) বলেন, সম্প্রতি সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীর কারণে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রণীত নিয়মানুসারে মুক্তাদিদের উপস্থিতিতে, তাদেরকে সামনে বসিয়ে জুমুআর খুতবা দেয়া বারণ, সেই নির্দেশের গণ্ডিতে থেকেই আজ আমি মসজিদ থেকেই খুতবা দিচ্ছি; কেননা যদিও এখন আমার সামনে কেউ বসে নেই, কিন্তু পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ আহমদী খুতবা শুনছেন। এই ঐক্য সর্বদা বজায় রাখার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত এবং দোয়াও করতে থাকা উচিত যেন আল্লাহ্ তা’লা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটান এবং এই মহামারী দূরীভূত করেন এবং মসজিদের সৌন্দর্য যাতে আবারও ফিরে আসে।
এরপর হুযূর খুতবার মূল বিষয়বস্তুর দিকে ফিরে আসেন এবং বলেন, দুই শুক্রবার পূর্বের খুতবায় হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্‌র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল এবং জঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধে তার শাহাদতবরণ প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, এটি পরবর্তীতে বর্ণনা করা হবে, যেন সেই যুদ্ধ সম্পর্কে মনে যেসব প্রশ্ন জাগ্রত হয়, সেগুলোরও কিছুটা উত্তর সবাই পেয়ে যায়। হযরত উমর (রা.) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে খিলাফতের নির্বাচনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে গিয়েছিলেন, যার একটি দীর্ঘ বর্ণনা সহীহ্ বুখারীতে লিপিবদ্ধ হয়েছে, হুযূর (আই.) তার অংশবিশেষ খুতবায় উদ্ধৃত করেন। হযরত উমর (রা.) সেই কমিটিতে ছয়জনকে রেখেছিলেন, যাদের প্রতি মহানবী (সা.) তাঁর মৃত্যুর সময় সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা হলেন হযরত আলী, হযরত উসমান, হযরত তালহা, হযরত যুবায়ের, হযরত সা’দ ও হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ, সান্ত্বনাস্বরূপ তিনি (রা.) আব্দুল্লাহ্ বিন উমরকেও সেই কমিটিতে রাখেন, কিন্তু শর্ত আরোপ করেন যে, তিনি খলীফা হতে পারবেন না। পরবর্তী খলীফার জন্য তিনি ওসীয়্যতও করে যান যেন প্রথম যুগের মুহাজির, আনসার, বিভিন্ন শহরের বাসিন্দা ও বেদুঈন মুসলমানদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা হয়, বিশেষভাবে তিনি যেন হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের পরামর্শ নেন। তাঁর মৃত্যুর পর কমিটির অনেক দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হযরত উসমান খলীফা নির্বাচিত হন এবং হযরত আলীসহ সবাই তাঁর হাতে বয়আত করেন। ইতিহাস থেকে এ-ও জানা যায়, যখন হযরত উমর (রা.) এই কমিটি গঠন করেন তখন হযরত তালহা মদীনায় ছিলেন না, তার আসার পূর্বেই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যখন হযরত উসমান (রা.) শহীদ হন তখন সবাই হযরত আলী (রা.)-এর কাছে এসে উপস্থিত হন এবং তাকে আমীরুল মু’মিনীন ঘোষণা দিয়ে বয়আত নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু হযরত আলী বলেন, খিলাফতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হলেন বদরী সাহাবীগণ। বদরী সাহাবীগণ এসে অনুরোধ জানালে হযরত আলী প্রথমে হযরত তালহা ও যুবায়ের (রা.)’র খোঁজ করেন। অতঃপর প্রথমে হযরত তালহা, এরপর পর্যায়ক্রমে হযরত যুবায়ের এবং অন্য সবাই তাঁর হাতে বয়আত করেন। খাজা কামালউদ্দীন সাহেব, যিনি খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)’র হাতে বয়আত করেন নি, তিনি মনে করতেন, হযরত আয়েশা, হযরত তালহা ও হযরত যুবায়ের (রা.)ও খলীফা হযরত আলীর হাতে বয়আত করেন নি, তার কতিপয় আপত্তির জবাবে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এক বক্তৃতায় বলেন, তাদের বয়আত না করাটাকে যেন খাজা সাহেব দলিল হিসেবে উত্থাপন না করেন, কারণ তারা হযরত আলীর খিলাফতের অস্বীকারকারী ছিলেন না, বরং তাদের আপত্তি ছিল হযরত উসমানের হত্যাকারীদের বিষয়ে। আর এই ধারণাও ভ্রান্ত যে তারা আলীর হাতে বয়আত করেন নি। হযরত আয়েশা (রা.) তো নিজের ভুল স্বীকার করে মদীনায় ফেরত চলে যান, আর হযরত তালহা ও যুবায়ের মৃত্যুর পূর্বেই পুনরায় বয়আত করেন। প্রমাণস্বরূপ হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) কতিপয় ঐতিহাসিক বর্ণনাও উত্থাপন করেন। খাসায়েসুল কুবরাতে বর্ণিত হয়েছে, উটের যুদ্ধের দিন হযরত তালহা মৃত্যুশয্যায় সংজ্ঞা হারানোর পূর্বেই হযরত সাওর বিন মাজযার হাত ধরে বয়আত করেন, কেননা তিনি হযরত আলীর পক্ষে ছিলেন। এটি যখন হযরত আলী জানতে পারেন তখন তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করে বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কথা সত্য প্রতিপন্ন হল; আল্লাহ্ তা’লা চান নি যে, তালহা আমার বয়আত না করে জান্নাতে যান। হযরত আয়েশা (রা.)-কে একবার ‘জঙ্গে জামাল’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি (রা.) পরিতাপ করে উত্তর দেন, “হায়, যদি আমিও অন্য আরও অনেকের মত এই যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতাম!”
এই যুদ্ধের উৎপত্তি বা সূচনা কীভাবে হল সে ইতিাহাসও হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তুলে ধরেছেন। হযরত উসমান (রা.)’র হত্যাকারীরা জঘন্য সেই অপকর্মের পর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজেরা দোষ থেকে বাঁচার জন্য অন্যদের ওপর দোষ চাপাতে শুরু করে। যখন তারা দেখতে পায় যে, হযরত আলী (রা.) খলীফা হিসেবে বয়আত গ্রহণ করেছেন, তখন তারা তার ওপরে এই দোষ চাপানোর একটি সুযোগ পেয়ে যায়। আর এটিও সত্য যে, হযরত উসমানের কতিপয় হত্যাকারী হযরত আলীর আশেপাশে এসে ভিড়েছিল; এই সুযোগে হত্যাকারীদের যে দলটি মক্কা অভিমুখে পালিয়েছিল, তারা এসে হযরত আয়েশা (রা.)’র কান ভারী করে এবং তাকে হযরত উসমানের হত্যার প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধ-ঘোষণায় প্ররোচিত করে। হযরত আয়েশা (রা.) যুদ্ধ-ঘোষণা করেন এবং সাহাবীদের সাহায্য চান। তালহা ও যুবায়ের (রা.) এই শর্তে হযরত আলীর হাতে বয়আত করেছিলেন যে, তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে হযরত উসমানের হত্যাকারীদের বিচার করবেন; কিন্তু দ্রুততম সময়ের যে অর্থ তারা করেছিলেন, হযরত আলী (রা.)’র বিবেচনায় সেটি সঙ্গত ছিল না। হযরত আলী চেয়েছিলেন সর্বত্র আগে ইসলাম সুসংহত হোক, তারপর হত্যাকারীদের বিচার হবে; তাছাড়া কারা সেই হত্যাকান্ডে জড়িত- সেটি নিয়েও বিতর্ক ছিল। কিছু হত্যাকারী তো নিপাট ভালমানুষ সেজে হযরত আলী (রা.)’র কাছে উপস্থিত হয়েছিল এবং ইসলামের মধ্যে দলাদলির আশংকা প্রকাশ করছিল, ফলে হযরত আলী ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে, আসলে এরাই ইসলামের শত্রু। এভাবে হযরত আলীর সাথে তালহা ও যুবায়েরের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, তারা নিজেদেরকে বয়আত থেকে মুক্ত মনে করেন এবং পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে গড়ায়। কিন্তু যুদ্ধ বাঁধার পূর্বেই হযরত আলী হযরত আয়েশার কাছে একজন দূত পাঠান, তিনি হযরত আয়েশা, তালহা ও যুবায়েরকে বোঝাতে সমর্থ হন যে, এভাবে কেবল বিশৃঙ্খলাই বাড়বে; আর যেহেতু তাদেরও উদ্দেশ্য ইসলামের মঙ্গল বৈ কিছু নয়, তাই অবিলম্বে যুদ্ধের প্রস্তুতি বন্ধ করা দরকার। হযরত আলীও এসে তাদের সাথে সাক্ষাত করতে রাজি হন। হযরত যুবায়ের স্পষ্ট বলে দেন যে, তিনি আলীর সাথে যুদ্ধ করবেন না, তালহাও তার সাথে একমত ছিলেন। কিন্তু এই খবর আব্দুল্লাহ্ বিন সাবা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা পেয়ে যায়, যারা হযরত উসমানের হত্যাকারী ছিল। তারা ধরা পড়ে যাবার ভয়ে রাতের আঁধারে উভয় শিবিরেই আক্রমণ করে বসে, ফলে উভয় দলই মনে করে অপরদল তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে, এভাবে কপটদের ষড়যন্ত্র সফল হয় এবং যুদ্ধের অবতারণা হয়। যুদ্ধ-শেষে যখন নিহতদের মাঝে তালহার লাশও পাওয়া যায়, তখন হযরত আলী (রা.) খুবই মর্মাহত হন। তালহা ও যুবায়েরের হত্যাকারীদের ওপর তিনি অভিসম্পাত করেন। হযরত তালহা যখন রণক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক হতভাগা পেছন থেকে ছুরিকাঘাতে তাকে শহীদ করে। সেই হতভাগা খুশিমনে এই খবর হযরত আলীকে শোনাতে গেলে হযরত আলী তাকে মহানবীর বরাতে নিশ্চিত জাহান্নামের খবর শুনিয়ে দেন। সেই যুদ্ধের দিন হযরত তালহার মৃত্যুর পর হযরত আলীর শিবিরে কেউ একজন এসে বলে, ‘নুলোটা মরেছে!’ একথা শুনে একজন সাহাবী তাকে তৎক্ষণাৎ শাসিয়ে বলেন, ‘হতভাগা! জান সে কীভাবে নুলো হয়েছিল?’ তারপর উহুদের যুদ্ধের দিনের সেই ঘটনা শুনিয়ে বলেন, ‘যাকে তুমি তাচ্ছিল্যভরে নুলো বলছ, তার বিকলাঙ্গ হওয়াটা এমন এক নিয়ামত, যার আকাঙ্ক্ষায় আমরা প্রত্যেকে ব্যাকুলচিত্ত।’ বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত আলী হযরত তালহার মৃত্যুর পর তার কথা স্মরণ করে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন। তিনি (রা.) দুঃখ করে এ-ও বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এই ঘটনার বিশ বছর আগেই মারা যেতাম!’
হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্ (রা.)’র স্মৃতিচারণ শেষ করে হুযূর (আই.) বর্তমানে চলমান মহামারী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন, যাতে তিনি (আ.) বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার, ধুঁপ জালানোর এবং আলোকিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, পোশাক-পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও উপদেশ দিয়েছেন; মহামারীতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে না যেতে সতর্ক করেছেন; সর্বোপরি খাঁটি তওবা, নিজেদের মধ্যে পবিত্র পরিবর্তন সাধন, আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক নিবিড় করা এবং রাতের বেলা উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে বাঁচার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দান করেছেন। হুযূর (আই.) দোয়া করেন- আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক আহমদীকে তৌফিক দিন যেন তারা বিশেষভাবে দোয়ার প্রতি মনোযোগী হয়; আল্লাহ্ তা’লা সবার প্রতি কৃপা ও দয়া করুন। (আমীন)