প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দাবী ও শিক্ষা
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
২০-মার্চ, ২০২০
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২০শে মার্চ, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মসীহ্ মওউদ দিবসের প্রেক্ষাপটে হযরত মসীহ্ মওউদ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর দাবী ও শিক্ষামালার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, তিনদিন পর ২৩শে মার্চ; এদিনেই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বয়আত গ্রহণ শুরু করেন আর এভাবে আহমদীয়া জামা’তের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জামা’তে এই দিনটি মসীহ্ মওউদ দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং জলসাও অনুষ্ঠিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দাবী এবং তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যাবলী নিয়ে আলোচনাও করা হয়; এজন্য আমি আজ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রাসঙ্গিক কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতি উপস্থাপন করব। হুযূর আরও বলেন, সম্ভবতঃ করোনা ভাইরাসের মহামারীর কারণে মসীহ্ মওউদ দিবসের জলসা অনুষ্ঠিত হবে না, তাই আমার খুতবা ছাড়াও এমটিএ’তে এ বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে; প্রত্যেক আহমদীর পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়িতে এই অনুষ্ঠানগুলো দেখার চেষ্টা করা উচিত। এরপর হুযূর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাবলী হতে কতিপয় উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যে মহানবী (সা.)-এর দাসত্বে তাঁরই (সা.) ধর্মের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন, সেটি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আমি মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করি কেননা তাঁর জন্যই আল্লাহ্ তা’লা এই জামা’ত প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাঁর আশিস ও কল্যাণের ফলেই এসব সাহায্য লাভ হচ্ছে।’ তিনি (আ.) আরও বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ ব্যতিরেকে কোন মানুষ-ই কোন প্রকার আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও কৃপা লাভ করতে পারে না।’ মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে তিনি যে আধ্যাত্মিক কল্যাণ লাভ করেছেন, এর কারণেই আল্লাহ্ তা’লা তাকে সৃষ্টির সংশোধনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। আর তিনি মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যথাসময় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন, ঠিক সেভাবেই যেভাবে হযরত মূসা (আ.)-এর পর হযরত ঈসা (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন। ইহুদীরা যেভাবে পথভ্রষ্ট হয়েছিল এবং আকাশ থেকে এলিয়া নবীর স্বশরীরে আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল, মুসলমানরাও ঠিক সেভাবেই ঈসা (আ.)-এর স্বশরীরে আকাশ থেকে আগমনের অপেক্ষায় রত। আর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কেবল মুসলমানদের জন্যই নন, বরং প্রত্যেক জাতি ও ধর্মের লোকদের সংশোধনের দায়িত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন এবং এই ঘোষণা দিয়েছেন, যেভাবে তিনি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য মসীহ্ হিসেবে এসেছেন, ঠিক একইভাবে তিনি হিন্দুদের জন্য কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এ-ও বলেছেন, তাঁর এই ঘোষণায় বিরুদ্ধবাদীরা অনেক হৈ-চৈ করবে, কিন্তু আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যারা প্রেরিত হন তারা মানুষের বিরোধিতার ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হন না। তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি (আ.) বলেন, ঐশী প্রজ্ঞার অধীনেই আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে প্রেরণ করেছেন, কিন্তু মানুষ সেটা না বুঝে তাঁকে অস্বীকার করে আর পরিণামে আল্লাহ্র ক্রোধভাজন হয়েছে। মুসলমানদের দৃষ্টি কেন এদিকে নিবদ্ধ হয় না যে, তাদের যুগে ইসলামের ওপর কত ব্যাপক ও প্রবল আক্রমণ করা হয়েছে এবং প্রায় লাখখানিক মুসলমান নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছে; যে পরিমাণে বই-পুস্তক ইসলামের বিরুদ্ধে রচিত হয়েছে সেগুলো একত্রিত করলে এক বিশাল পর্বতের আকার ধারণ করবে, অথচ মুসলমানদের ইসলামের প্রচার বা সেবার বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই! এহেন পরিস্থিতিতে যদি আল্লাহ্ তা’লা কাউকে প্রেরণ না করতেন তবে সেটি-ই আশ্চর্যের বিষয় হতো। তিনি বলেছেন, ঈসা (আ.)-এর জীবিত আকাশে থাকার এবং পুনরায় শেষযুগে স্বশরীরে আগমনের ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফলে খ্রিস্টানদেরই সুবিধা হয়েছে এবং ইসলামের ক্ষতি বৈ আর কিছুই হয় নি; এর ফলে মহানবী (সা.)-এর অবমাননাও হয়েছে, তাই তিনি (আ.) মুসলমানদেরকে এমন কর্মকাণ্ড পরিহার করতে বলেন যাতে ইসলাম বা মহানবী (সা.)-এর সম্মানহানী হয়। তিনি ঢালাওভাবে পৃথিবীবাসীকে ঈমানের প্রতি মনোযোগী হতে উপদেশ দিয়েছেন এবং যাবতীয় পাপ পরিত্যাগ করতে বলেছেন। আল্লাহ্ তা’লা কীভাবে ইসলাম এবং তাঁর সমর্থনে একের পর এক নিদর্শন প্রদর্শন করেছেন, সেগুলোর কয়েকটির উল্লেখ করেও তিনি সবাইকে সাবধান করেছেন যে, আল্লাহ্র প্রেরিত সতর্ককারীর বিরোধিতার পরিনাম মোটেও শুভ হয় না। তিনি আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এই ইলহামও বারংবার সবাইকে স্মরণ করিয়েছেন: ‘পৃথিবীতে এক সতর্ককারী এসেছে, কিন্তু পৃথিবী তাকে গ্রহণ করে নি, তবে, খোদা তাকে গ্রহণ করবেন এবং প্রবল পরাক্রমশালী আক্রমণসমূহ দ্বারা তাঁর সত্যতা প্রকাশ করে দিবেন।’
হুযূর (আই.) বলেন, আজ পৃথিবীর দু’শতাধিক দেশে আহমদীয়া জামা’ত যে বিস্তৃতি লাভ করেছে- এটি যেন উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে যে, আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা পৃথিবীর সামনে ক্রমাগত প্রকাশ করে চলেছেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তাঁর এই মিশনকে বিস্তৃত করার কাজে আমাদেরকেও অংশীদার করুন, আমাদের ঈমান ও বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় করুন এবং আমাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব পালনের তৌফিক দান করুন। (আমীন)
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) সাম্প্রতিক করোনা মহামারীর ফলে জগতপূজারীদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে কিছু কথা বলেন। তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার নিয়মিত কলামলেখক ফিলিপ জনস্টনের একটি কলামের উল্লেখ করেন যাতে তিনি লিখেছেন, এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক যে, মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে আমাদের চেনা পৃথিবী একেবারে বদলে গিয়েছে। আমাদের সব পরিকল্পনা থেমে গিয়েছে, ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা কিংবা অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও মানবতা এতটা স্থবির হয়ে পড়ে নি যেমনটি এখন হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের যে প্রজন্ম, তারা সবসময় স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি ও স্থিতিশীল অবস্থাই আশা করে এসেছে, এরকম বিপদ তাদের জন্য কল্পনাতীত ছিল। তিনি আরো লিখেছেন, হয়তো বিজ্ঞান এই রোগের কোন প্রতিষেধক বা প্রতিকার আবিষ্কার করে ফেলবে, কিন্তু ততদিনে অনেক মানুষের জীবন-প্রদীপ নিভে যাবে। আমেরিকায় পরীক্ষমূলকভাবে প্রতিষেধক মানবদেহে প্রয়োগ করে গবেষণা করা হচ্ছে, কিন্তু এটা জানতেই কয়েকমাস লেগে যাবে যে, এই প্রতিষেধকে আদৌ কোন কাজ হবে কি-না! তিনি আরও লিখেছেন, মানবজাতির ইতিহাস থেকে এটাই জানা যায় যে, এমন ক্রান্তিলগ্নে মানুষ বরাবর ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের স্রষ্টার পানে প্রত্যাবর্তন করে উত্তরণ লাভ করেছে। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে কোন সমাধানের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তিনি নিজেও হয়তো পুনরায় চার্চে ফিরে যাবেন অর্থাৎ ধর্মের প্রতি মনোযোগী হবেন। হুযূর (আই.) বলেন, তাদের অবস্থা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, এই ভাইরাস বিশ্ববাসীকে বাধ্য করছে- তারা যেন খোদা ও ধর্মের পানে প্রত্যাবর্তন করে, কিন্তু প্রকৃত ও জীবন্ত খোদা তো হলেন ইসলামের খোদা, আমাদের আল্লাহ্! তাই আমাদের একদিকে যেমন নিজেদের অবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন এবং আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক নিবিড় করা প্রয়োজন, অন্যদিকে জগদ্বাসীকে তাদের প্রকৃত স্রষ্টা আল্লাহ্ তা’লার প্রতি আহ্বান করা প্রয়োজন এবং ইসলাম ও ইসলামের আল্লাহ্র সাথে তাদের পরিচিত করা প্রয়োজন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে এই তৌফিক দান করুন। (আমীন)
হুযূর (আই.) করোনা প্রতিরোধে সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে পুনরায় স্মরণ করান এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি মনোযোগী হতে বলেন। করোনার মহামারী আরও অনেক দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টিও উল্লেখ করেন এবং এই ভাইরাস কত দ্রুত বারবার জিন পরিবর্তন করছে- সেটিও উল্লেখ করেন। এসব বিষয়ের প্রেক্ষিতে সতর্কতা অবলম্বন এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মান্য করা ও পরিচ্ছন্ন থাকা নিতান্ত আবশ্যক, কিন্তু আসল ও শেষ উপায় হল দোয়া; অনেক বেশি দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ্ তা’লা সবাইকে এর ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। যেসব আহমদী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা ডাক্তাররা ধারণা করছেন যে, তারা আক্রান্ত হয়েছেন, কিংবা অন্য কোন রোগেও আক্রান্ত রয়েছেন, তাদের জন্য হুযূর দোয়া করতে বলেন। সাধারণভাবে পৃথিবীবাসীর জন্য এবং বিশেষভাবে আহমদীদের জন্য এবং আমাদের ঈমানে দৃঢ়তা লাভের জন্য হুযূর দোয়া করেন এবং সবাইকে দোয়া করতে বলেন। (আমীন)