শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
২৮-ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের বলেন, আজ যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করা হবে তার নাম হল, হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)। হযরত মুসআব বিন উমায়ের কুরাইশদের বনু আবদেদ দ্বার গোত্রের সদস্য ছিলেন, তার ডাকনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্। তার পিতার নাম ছিল উমায়ের বিন হাশেম এবং মাতার নাম ছিল খানাস বা হানাস বিনতে মালেক, যিনি মক্কার অত্যন্ত বিত্তশালী একজন মহিলা ছিল। হযরত মুসআবের পিতা-মাতা তাকে খুবই স্নেহ করতো ও ভালবাসতো। তার মা তাকে অনেক প্রাচুর্যের মাঝে বড় করেছিল; ছেলের জন্য খুব দামি পোশাক-আশাক, দামি সুগন্ধির ব্যবস্থা করতো, এমনকি তার জন্য জুতোও আসত মক্কার বাইরে হাজারামওত এলাকা থেকে, যা অত্যন্ত ধনী ও সম্ভ্রান্তরাই কেবল ব্যবহার করতো। হযরত মুসআবের স্ত্রীর নাম ছিল হামনা বিনতে জাহশ, যিনি উম্মুল মু’মিনীন যয়নাব বিনতে জাহশের বোন ছিলেন। তার গর্ভে মুসআবের এক কন্যা যয়নাব জন্ম নেন। মহানবী (সা.) মুসআবের কথা স্মরণ করে বলতেন, ‘আমি মুসআবের চেয়ে সুশ্রী-সুদর্শন এবং প্রাচুর্য ও স্বচ্ছ্বলতায় লালিত-পালিত আর কাউকে দেখিনি।’ হযরত মুসআব শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের একজন ছিলেন এবং একেবারে প্রথম দিকের মুসলমান ছিলেন। তিনি দ্বারে আরকাম যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেন, কিন্তু নিজের মা এবং গোত্রের বিরোধিতার আশংকায় বিষয়টি গোপন রাখেন। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে আসতেন। উসমান বিন তালহা নামক একজন তাকে একদিন নামায পড়তে দেখে তার বাবা-মাকে বলে দেয় এবং এরপর তারা তাকে গৃহবন্দী করে রাখে। কিন্তু তিনি সুযোগ বুঝে ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। কিছুদিন পর যখন কতিপয় মুহাজির সেখান থেকে মক্কায় ফেরত আসে, তাদের সাথে মুসআব (রা.)ও ফেরত আসেন। তার মা ছেলের এই অবস্থা দেখে বিরোধিতা পরিত্যাগ করে এবং ছেলেকে নিজের মত ছেড়ে দেয়। হযরত মুসআব দু’বার হিজরত করার সৌভাগ্য লাভ করেন, ইথিওপিয়ায় ও মদীনায়।
হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলতেন, আমি মুসআবের স্বাচ্ছন্দ্যের যুগও দেখেছি, আর মুসলমান হবার পর তিনি কী কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা-ও দেখেছি। ইসলামের খাতিরে তিনি এতটা কষ্ট সহ্য করেছেন যে আমরা দেখেছি, তার শরীর থেকে সাপের খোলসের মত চামড়া উঠে এসেছে। একদিন মহানবী (সা.)-এর বৈঠকে মুসআব আসেন, তার পরনের কাপড়ে চামড়া দিয়ে তালি লাগানো ছিল। তার করুণ অবস্থা দেখে সাহাবীরাও নতজানু হয়ে বসে ছিলেন। তিনি এসে মহানবী (সা.)-কে সালাম করেন, মহানবী (সা.)-ও তার সালামের উত্তর দেন এরপর বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্! জগতপ্রেমীরা জগৎ অর্জন করুক; আমি মুসআবকে সেই যুগেও দেখেছি, যখন মক্কা নগরীতে তার চেয়ে বেশি প্রাচুর্যের অধিকারী আর কেউ ছিল না, সে তার বাবা-মায়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান ছিল। কিন্তু আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের ভালোবাসা আজ তার এই অবস্থা করেছে, আর সে সবকিছু আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের খাতিরে পরিত্যাগ করেছে।’ এমনকি একবার তিনি (সা.) মুসআবের এই করুণ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন।
সীরাত খাতামান্নবীঈন পুস্তকে সাহেবযাদা হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) ইথিওপিয়ার হিজরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত মুসআব বিন উমায়েরের উল্লেখ করেছেন যে, তিনি-ও তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি এ-ও বর্ণনা করেন যে, ইথিওপিয়ায় প্রথম দফায় হিজরতকারীদের দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায়, ইসলাম গ্রহণের কারণে ধনী পরিবারের সদস্যরাও অনেক অত্যাচারের-নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, কারণ ইথিওপিয়ায় প্রথম হিজরতকারী দলের প্রায় সবাই মক্কার সম্ভ্রান্ত ও ধনী বংশের লোক ছিল। ইথিওপিয়ায় হিজরতের মাধ্যমে তারা কুরাইশদের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন।
আকাবার প্রথম বয়আতের সময় মদীনা থেকে আগত বারোজন ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর তবলীগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মদীনায় ফিরে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) হযরত মুসআব বিন উমায়েরকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন, যেন তিনি তাদেরকে ইসলাম ও কুরআন শেখাতে পারেন এবং মদীনায় তবলীগ করতে পারেন। মদীনায় তিনি ক্বারী ও মুক্বরী বা শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মদীনায় তিনি হযরত আসাদ বিন যুরারাহ্র বাড়িতে অবস্থান করতেন। মক্কার বাইরে তিনি-ই ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ ছিলেন। আসাদ বিন যুরারাহ্ তাকে বিভিন্ন মহল্লায় ও বাড়িতে তবলীগের জন্য নিয়ে যেতেন, তাদের তবলীগে হযরত সা’দ বিন মুআয, আব্বাদ বিন বিশর, মুহাম্মদ বিন মাসলামা, উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেন। একটি ইতিহাসগ্রন্থের বর্ণনামতে তিনি সেই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি হিজরতের পূর্বে মদীনায় জুমুআর নামায পড়ান। হযরত মুসআব মহানবী (সা.)-এর কাছে মদীনায় জুমুআর নামায পড়ানোর অনুমতি চাইলে তিনি (সা.) অনুমতি দেন; তখন সা’দ বিন খায়সামার বাড়িতে প্রথম জুমুআর নামায পড়া হয় এবং ১২জন আনসারী তাতে অংশ নেন। অপর এক বর্ণনামতে প্রথম জুমুআ আসাদ বিন যুররাহ্ (রা.) পড়িয়েছিলেন।
হযরত মুসআবের তবলীগের ফলে খুব দ্রুত ইসলামের প্রসার হতে থাকে, এতে অওস গোত্রের নেতা সা’দ বিন মুআয প্রচণ্ড বিরক্ত হন। যেহেতু আসাদ বিন যুরারাহ তার নিকটাত্মীয় ছিলেন এবং মুসআব তার পৃষ্ঠপোষকতায় তবলীগ করছিলেন, তাই তিনি কিছু বলতেও পারছিলেন না। তাই তিনি তার আরেকজন আত্মীয় উসায়েদ বিন হুযায়েরকে বলেন, আসাদকে তো কিছু বলা যাচ্ছে না, তুমি গিয়ে মুসআবকে বাঁধা দাও যেন সে আমাদের মধ্যে ধর্মহীনতা প্রচার না করে বেড়ায় এবং আসাদকেও বুঝাও যে, এটা ঠিক হচ্ছে না। উসায়েদ বিন হুযায়ের আসাদ বিন যুরারাহ্র বাড়ি গিয়ে খুব উষ্মা প্রদর্শন করেন এবং মুসআবকে তবলীগ করার জন্য বকাঝকা করেন ও তবলীগ করতে বারণ করেন। তখন আসাদ বিন যুরারাহ্ পাল্টা রাগ দেখানোর বদলে মুসআবকে বলেন, উসায়েদ একজন সম্মানিত ও বড় নেতা, তাকে খুবই নম্রতা ও কোমলতার সাথে বুঝাও এবং তবলীগ কর। হযরত মুসআব তাকে অত্যন্ত নম্রভাষায় ও সুন্দরভাবে তবলীগ করেন। উসায়েদ যেহেতু পুণ্যস্বভাবের মানুষ ছিলেন, তাই তিনি চট করে ইসলামের সত্যতা বুঝতে পারেন ও মুসলমান হয়ে যান। পরে তিনি কোন এক ছুতোনাতায় সা’দ বিন মুআযকে সাথে নিয়ে আসেন। সা’দও এসে প্রথমে খুব রাগ দেখান; মুসআব তাকেও খুব নম্রতার সাথে সুন্দরভাবে তবলীগ করেন, ফলে তিনিও মুসলমান হয়ে যান। এরপর সা’দ বিন মুআয, যিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, উসায়েদ বিন হুযায়েরকে সাথে নিয়ে নিজ গোত্র বনু আবদে আশহালকে গিয়ে ইসলামের সত্যতা বুঝান। ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, সন্ধ্যার পূর্বেই বনু আবদে আশহালের পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে যায় এবং তাদের পূজার মূর্তি বের করে ভেঙে ফেলে। হযরত মুসআবের তবলীগেরই ফলে পরবর্তী বছর, নবুওয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের যিলহজ্জ মাসে হজ্জের সময় মদীনা থেকে মক্কায় আগত কয়েকশ’ লোকের মধ্য থেকে ৭০জন পুণ্যাত্মা ইসলাম গ্রহণ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে আকাবার দ্বিতীয় বয়আত নামে সুপরিচিত। হুযূর বলেন, হযরত মুসআব বিন উমায়েরের স্মৃতিচারণের প্রেক্ষিতে আরও বেশকিছু ঘটনা রয়েছে, যা আগামীতে বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।
খুতবার শেষদিকে হুযূর দু’টি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা মরহুম মালেক মুযাফ্ফর আহমদ সাহেবের পুত্র শ্রদ্ধেয় মালেক মুনাওয়ার আহমদ জাভেদ সাহেবের, যিনি গত ২২শে ফেব্রুয়ারি যকৃতের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মরহুমের দাদা হযরত ডা. চৌধুরী জাফর সাহেব এবং নানা হযরত শেখ আব্দুল করিম সাহেব- উভয়ই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন; তেমনিভাবে মরহুমের সহধর্মিনীরও দাদা ও নানা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন। মরহুম ১০ আগস্ট ১৯৮৩ সালে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) কাছে ওয়াকফের আবেদন করেন এবং সারাজীবন জামাতের সেবায় অতিবাহিত করেন।
দ্বিতীয় জানাযা মোকাররম শেখ মাহবুব আলম খালেদ সাহেবের পুত্র শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুনাওয়ার শামীম খালেদ সাহেবের, যিনি গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি প্রায় ৮১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মরহুমের দাদা খান সাহেব মৌলভী ফারযান্দ আলী খান সাহেব লন্ডন মসজিদের সাবেক ইমাম ছিলেন। হুযূর উভয় মরহুমের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও নিঃস্বার্থভাবে জামাতের সেবার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের উভয়ের রূহের মাগফিরাতের ও তাদের পর্দমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেন। (আমীন)