শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৫-নভেম্বর, ২০১৯

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৫ নভেম্বর, ২০১৯ টিলফোর্ডস্থ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বদরী সাহাবীদের নিয়ে আমি যে ধারাবাহিক খুতবা শুরু করেছিলাম, এ বিষয়ে সর্বশেষ খুতবা জার্মানি থেকে দিয়েছিলাম, তাতে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলের স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল, প্রাসঙ্গিকভাবে হযরত আব্দুল্লাহ্‌র পিতা আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলের বর্ণনা চলছিল। আমি উহুদের যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করছিলাম যে মহানবী (সা.) যখন যুবকদের কথা মেনে নিয়ে মদীনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন শুরুতে তো আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই তার সাথীদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে রওয়ানা হয়, কিন্তু উহুদের একদম কাছে গিয়ে সে তার সাথের তিনশত সাথী নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে মদীনায় ফিরে যায় ও বলে- মুহাম্মদ (সা.) আমার কথা শুনেন নি; এটা তো কোন যুদ্ধ না, বরং নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর; আমি নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না। এতে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৭০০, তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.)-এর সুনিপুণ যুদ্ধ পরিচালনার ফলে মুসলমানরা প্রায় জিতেই গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর (সা.) নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে মান্য না করায় এবং গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ অরক্ষিত ফেলে রাখায় সেই বিজয় পরাজয়ে পরিণত হয় এবং মুসলমানরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই ঘটনার ফলে আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই-এর আচরণ যা হয়েছিল এবং সে মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের নিয়ে যেসব তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও পীড়াদায়ক কথাবার্তা বলেছিল, সে সংক্রান্তও কিছু ঘটনা হুযূর তুলে ধরেন; এত্থেকে তার পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্‌রও ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হয়। উহুদের যুদ্ধের পর মদীনার ইহুদী ও মুনাফিকরা, যারা বদরের যুদ্ধের পর কিছুটা ভীত ছিল, আবারো ধৃষ্ট ও দুঃসাহসী হয়ে উঠে। আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই ও তার সাথীরা তো প্রকাশ্যে ঠাট্টা-মশকরা ও খোঁটা দেয়া শুরু করে দেয়, কিন্তু মহানবী (সা.) সেগুলোকে উপেক্ষা করে চলছিলেন। ৫ম হিজরিতে বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে মহানবী (সা.) একটি ঝর্ণার কাছে যাত্রাবিরতি করেন। এখানে মুনাফিকরা এমন একটি ষড়যন্ত্র রচনা করে, যা দূর্বল মুসলমানদের মাঝে গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে দিচ্ছিল। হযরত উমরের দাস জাহজা এবং সিনান নামক আনসারদের এক মিত্র ব্যক্তির মাঝে ঝর্ণার পানি নিয়ে ঝগড়া হয়, ঝগড়ার এক পর্যায়ে জাহজা সিনানকে আঘাত করে বসে। এরা দু’জনই অকাট মূর্খ ও নিতান্ত অজ্ঞ ছিল, কিন্তু এই দু’জনের চেঁচামেচিতে অনেক মুহাজির ও আনসার সাহাবী সেখানে জড়ো হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে সংঘাত বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কয়েকজন বিজ্ঞ মুহাজির ও আনসার সাহাবী সেখানে সময়মত পৌঁছে যান এবং তারা সবাইকে শান্ত করে বিষয়টির মিটমাট করে দেন। মহানবী (সা.) যখন এ বিষয়ে জানতে পারেন তখন তীব্র অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, এটি সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপূর্ণ একটি কাজ হয়েছে। কিন্তু আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল যখন এই ঘটনা জানতে পারে, তখন সে বিষয়টিকে আবার উস্কে দেয়ার চেষ্টা করে এবং আনসারদের বলে, ‘এগুলো সব তোমাদেরই দোষ; তোমরা এই নিঃস্ব মুসলমানদের ঠাঁই দিয়েছ আর এরা এখন তোমাদেরই মাথায় চড়ে বসেছে। এখনও সময় আছে- এদের সাহায্য করা বন্ধ কর, এরা সব ছেড়েছুড়ে পালাবে।’ একপর্যায়ে সেই দুর্ভাগা এই জঘন্য মন্তব্যও করে বসে, এবার মদীনায় গিয়ে মদীনার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি অর্থাৎ সে নিজে মদীনার সবচেয়ে লাঞ্ছিত ব্যক্তি অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে সেখান থেকে বের করে দিবে (নাউযুবিল্লাহ্)। যখন সে এই কথা বলে, তখন সেখানে শিশু যায়েদ বিন আরকামও উপস্থিত ছিলেন, যিনি শিশু অবস্থাতেও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি শুনেই বুঝতে পারেন যে এটি অত্যন্ত ভয়াবহ একটি কথা, তাই তিনি তার চাচার মাধ্যমে মহানবী (সা.)-কে এ বিষয়ে খবর দেন। মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলকে ডেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে একদম অস্বীকার করে বসে, কয়েকজন আনসারও তার পক্ষে সাফাই গায়। মহানবী (সা.) তখন তাদের কথা মেনে নিয়ে যায়েদের আপত্তি ভুল সাব্যস্ত করেন, যায়েদ খুবই ব্যথিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা’লা কুরআনের ওহীর মাধ্যমে তার সত্যায়ন করে দেন। এই ঘটনার পর মুনাফিক সর্দারের পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্ বিচলিত অবস্থায় মহানবী (সা.)-এর কাছে আসেন এবং নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমি শুনেছি যে আপনি আমার পিতার ঔদ্ধত্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাকে হত্যার নির্দেশ দিতে চান। এটাই যদি সিদ্ধান্ত হয় তবে আমাকে নির্দেশ দিন, আমি নিজে তার মাথা কেটে আপনার পদতলে এনে হাজির করব, কিন্তু অন্য কাউকে এই দায়িত্ব প্রদান করবেন না। কারণ আমার ভয় হয়, এতে আমার ভেতর অজ্ঞতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং আমি প্রতিশোধের স্পৃহায় অন্ধ হয়ে এক মুসলমান ভাইকে হত্যা করে বসতে পারি এবং ফলতঃ জাহান্নামের বাসিন্দায় পরিণত হতে পারি।’ মহানবী (সা.) তাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি এমন কোন সিদ্ধান্ত নেন নি, উল্টো তার পিতার প্রতি নম্রতা ও সদাচরণ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ্ তার পিতার উপর এতটাই চটেছিলেন যে মদীনায় প্রবেশের পূর্বে পিতার পথরোথ করেন এবং বলেন, ‘যতক্ষণ তুমি নিজে মুখে একথা স্বীকার না করবে যে রসূলুল্লাহ্ (সা.) মদীনার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি এবং তুমি সবচেয়ে লাঞ্ছিত ব্যক্তি- ততক্ষণ আমি তোমাকে মদীনায় ঢুকতে দেব না।’ আর তিনি তার পিতাকে এটি বলিয়ে ছাড়েন; মহানবী (সা.)-ও হযরত আব্দুল্লাহ্কে নিরস্ত করেন।

এই ঘটনাটি ছাড়াও আরও অনেক কুকীর্তি সে করেছিল। মুনাফিকদের পক্ষ থেকে যে জঘন্য মিথ্যা অপবাদ মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সহধর্মিনী হযরত আয়েশা (রা.)-এর উপর আরোপ করা হয়েছিল, যা পবিত্র কুরআনে ‘ইফক’ বা অপবাদের ঘটনা আকারে বর্ণিত হয়েছে, সেটিরও মূল হোতা ছিল আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল। হুযূর পূর্বেও সেটি বিস্তারিতভাবে খুতবায় উল্লেখ করেছেন, আজও সংক্ষেপে তা বর্ণনা করেন। কিন্তু এতসব কর্মকান্ডের পরও রাহমাতুল্লিল আলামীন মহানবী (সা.) তার সাথে কেমন ব্যবহার করেছিলেন? যখন সে মারা যায় তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) নিজের পবিত্র পোশাক তার কাফন হিসেবে ব্যবহারের জন্য দান করেন, হযরত উমর (রা.)-এর বাধা দেয়া সত্ত্বেও মহানবী (সা.) এই বলে তার জানাযা পড়ান যে ‘আমাকে সুযোগ দেয়া হয়েছে- চাইলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেও পারি, না-ও করতে পারি; যদি সত্তর বারের চেয়ে বেশি তার ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করলে তা গৃহীত হয়, তবে আমি সত্তরবারের চেয়ে অনেকবার বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করব’। যদিও এরপর আল্লাহ্ তা’লা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে (সা.) সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করে দেন এমন মুনাফিকদের জানাযা পড়তে বা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। এমন বর্ণনাও পাওয়া যায় যে মহানবী (সা.) তার লাশ কবরে শোয়ানোর পূর্বে নিজের পবিত্র লালা তার মুখমন্ডলে লাগিয়ে দেন। এই সবকিছু মূলতঃ তার পুত্র, একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মুসলমান সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্‌র খাতিরে ও ইসলামের জন্য হযরত আব্দুল্লাহ্‌র সেবা ও কুরবানীর জন্য তিনি (সা.) করেছিলেন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর চারটি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন; প্রথম জানাযা কেরালার মোকাররমা আমাতুল হাফিয সাহেবার, যিনি মোকাররম মওলানা মোহাম্মদ উমর সাহেবের সহধর্মিনী ছিলেন; গত ২০ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মরহুমার অজস্রর গুণাবলীর মধ্যে একটি বিশেষ গুণ ছিল- নিয়মিত তাহাজ্জুদের পাশাপাশি তিনি প্রত্যেকদিন ফজরের পর কুরআন তিলাওয়াত করতেন ও হাদীস অধ্যয়ন করতেন, এমনকি যেদিন তার মৃত্যু হয় সেদিনও এই অভ্যাস পালন করেছেন। দ্বিতীয় জানাযা রাবওয়ার মোকাররম চৌধুরী মোহাম্মদ ইব্রাহীম সাহেবের, যিনি পাকিস্তান আনসারুল্লাহ্‌র মুখপত্র ‘মাসিক আনসারুল্লাহ্’র সাবেক প্রকাশক ও ম্যানেজার ছিলেন; গত ১৬ অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তৃতীয় জানাযা মোকাররম রাজা মাসুদ আহমদ সাহেবের, যিনি পিন্ডদাদনখানের মোকাররম মরহুম রাজা মুহাম্মদ নওয়াজ সাহেবের পুত্র ছিলেন; দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৯ অক্টোবর ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি কলেজে হুযুরের সহপাঠী ছিলেন, বিভাগ পৃথক হলেও কিছু ক্লাস একত্রে করেছেন; জামাতের ওয়াকেফে যিন্দেগীদের ও কর্মকর্তাদের খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। চতুর্থ জানাযা মোকাররমা সালেহা আনোয়ার আবু সাহেবার, যিনি সিন্ধের মরহুম আনোয়ার আলী আবু সাহেবের সহধর্মিনী ছিলেন; গত ১ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। মরহুমা অত্যন্ত সাহসী, ইবাদতগুযার, আল্লাহ্ ও বান্দার হক আদায়কারীনী এবং আর্থিক কুরবানীতে অত্যন্ত অগ্রসর এক নারী ছিলেন। হুযূর প্রত্যেকের অসাধারণ গুণাবলী ও কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের মাগফিরাত লাভের ও মর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন, আর তাদের বংশধরদেরও তাদের আদর্শানুসারে চলার জন্য দোয়া করেন। (আমীন)