আর্থিক কুরবানী: তাহ্‌রীক-এ-জাদীদ-এর নতুন বর্ষ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৮-অক্টোবর, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৮ই নভেম্বর, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় তাহরীকে জাদীদের ৮৬তম নববর্ষের ঘোষণা করেন এবং আর্থিক কুরবানীর গুরুত্ব ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী নিষ্ঠাবান আহমদীদের বিভিন্ন ঘটনার আলোকে আর্থিক কুরবানী সংক্রান্ত বিভিন্ন ঈমানোদ্দীপক ঘটনা বর্ণনা করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াত পাঠ করেন যার বঙ্গানুবাদ হল: ‘তাদের হিদায়াত দেওয়া তোমার দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহ্ যাকে চান তাকে সুপথে নিয়ে আসেন। আর আল্লাহ্‌র পথে তোমরা যে উত্তম সম্পদই ব্যয় কর, আর প্রকৃতপক্ষে তোমরা তা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই ব্যয় করে থাক, অতএব এর কল্যাণও তোমাদের নিজেদের জন্যই হবে। আর যে উত্তম সম্পদই তোমরা ব্যয় কর, তা তোমাদের পুরোপুরি ফিরিয়ে দেয়া হবে; আর তোমাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।’

উপরোক্ত আয়াত থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, সঠিক পথে পরিচালিত করা যা মানুষকে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, তাতে প্রতিষ্ঠিত রাখা ও গন্তব্যে পৌঁছানো এবং পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা একমাত্র আল্লাহ্ তা’লার-ই কাজ; আমরা কাউকে কেবল পথের সন্ধান দিতে পারি, কিন্তু তাকে সেই পথে পরিচালিত করা বা তাতে প্রতিষ্ঠিত রাখা আমাদের দায়িত্ব নয়। আর আমাদের উচিত- হিদায়াত অর্জনের পর আল্লাহ্‌র নির্দেশানুসারে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা এবং দোয়া করা যেন আল্লাহ্ তা’লা আমাদের পরিণাম শুভ করেন, আর আমাদের দুর্বলতা যেন কখনো আমাদেরকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিচ্যুত না করে, (আমীন)।

দ্বিতীয় বিষয় হল, পবিত্র সম্পদ থেকে যা-ই তোমরা আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করবে, তা তোমাদের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। আল্লাহ্ তা’লা কারও ঋণ রাখেন না। যেভাবে একজন কৃষক তার ক্ষেতে শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়, একজন অজ্ঞ ব্যক্তি ভাবতে পারে- সে হয়তো শস্যদানা না খেয়ে অপচয় করছে। কিন্তু যারা কৃষিকাজে অভীজ্ঞ তারা জানেন, এই ছিটিয়ে দেয়া শস্যদানার চেয়ে বহুগুণ বেশি ফসল একদিন সে ঘরে তুলবে। একইভাবে আল্লাহ্ তা’লাও তাঁর পথে ব্যয়কৃত সম্পদ বান্দাকে শত-সহস্রগুণ বৃদ্ধি করে ফেরৎ দেন, বিশ্বজুড়ে আহমদীরা এর চাক্ষুস সাক্ষী। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ আহমদীদের ঈমানকে সুদৃঢ় করেন। অধিকাংশ আহমদী-ই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির খাতিরে আর তাঁর ধর্মসেবার মানসে নিজেদের পবিত্র সম্পদ ব্যয় করেন। তবে, আল্লাহ্‌র কাছ থেকে প্রতিদান পাবার ক্ষেত্রে আবশ্যক শর্ত হল, ব্যয়কৃত সম্পদ পবিত্র হতে হবে, অবৈধ হলে চলবে না, এবং তা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের বাসনায় করতে হবে।

এরপর হুযূর তাহরীকে জাদীদ খাতে আর্থিক কুরবানীকারী লক্ষ লক্ষ আহমদীর মধ্য থেকে কয়েকজনের ঈমানবর্ধক ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।

সিয়েরালিওনের একজন নতুন আহমদী কামারা সাহেব তাহরীকে জাদীদের কল্যাণ জানতে পেরে তার কাছে থাকা যৎসামান্য অর্থ চাঁদা হিসেবে দিয়ে দেন, যা তিনি পরিবারের চাল কেনার জন্য রেখেছিলেন। পরদিনই তিনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন সেখানে তার ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তন করে দেয়া হয়, আর সেখানে বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া তিনি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও লাভ করেন। আল্লাহ্‌র কৃপা দেখে তিনি চাঁদার কল্যাণ বুঝতে পারেন আর এখন নিয়মিত চাঁদা প্রদান করছেন।

গিনিবাসাও-এর একজন দরিদ্র কিন্তু নিষ্ঠাবান আহমদী দিয়ালু সাহেবকে তাহরীকে জাদীদের চাঁদা সম্পর্কে তখন অবহিত করা হয় যখন তিনি সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন সন্তানদের জন্য খাবার কিনতে। পকেটে যে টাকা ছিল তা তিনি চাঁদা দিয়ে দেন, আর বাসায় যেহেতু টাকা ছিল না, তাই মাছ ধরার জাল নিয়ে নদীতে চলে যান। আল্লাহ্‌র কৃপায় ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ৭৩ কেজি মাছ তার জালে ধরা পড়ে, যা দেখে অন্য জেলেরা আশ্চর্য হয়ে যায়। এই নিষ্ঠাবান আহমদী আল্লাহ্ তা’লার এই কৃপার দৃশ্য দেখে পুনরায় মসজিদে যান, গিয়ে মাছ বিক্রির টাকা থেকে আবারও চাঁদা দেন। এই দেশেরই একজন নিতান্তই গরীব বৃদ্ধা, যার কোন সহায়-সম্বল নেই, তিনি মুয়াল্লিম সাহেবকে বলেন, আমার কাছে তো দেওয়ার মত কিছু নেই, ছোট একটি মুরগির বাচ্চা আছে, এটাকে পেলে-পুষে বড় করে আপনাকে দিয়ে দেব, সেটাই আমার চাঁদা। ইতোমধ্যে গ্রামে মুরগির মহামারী দেখা দেয় আর সেই বৃদ্ধার মুরগিটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে; বাড়ির সবাই সেটি মরে যাওয়ার আগেই জবাই করে ফেলতে বলে। কিন্তু সেই নিষ্ঠাবান নারী আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! আমার কাছে তো এই মুরগি ছাড়া আর কিছুই নেই; তুমিই সাহায্য কর আর এটিকে রক্ষা কর।’ পরদিনই তার মুরগি সুস্থ হয়ে যায় এবং বিশদিন পর তিনি সেই মুরগিটি মুয়াল্লিম সাহেবের হাতে চাঁদা হিসেবে তুলে দেন। যুক্তরাজ্যের এক ভদ্রমহিলা লিখেন, তিনি তার তাহরীকে জাদীদের সম্পূর্ণ চাঁদা দিয়ে দেয়ার পর একদিন লাজনার সদর সাহেবা বলেন, লাজনার চাঁদার লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয় নি, এজন্য তিনি সবাইকে আরও চাঁদা দেয়ার আহ্বান করেন। সেই ভদ্রমহিলার কাছে অন্য কোন প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু অর্থ জমানো ছিল, কিন্তু তিনি সাহস করে তা চাঁদা দিয়ে দেন। পরদিন তিনি নিজের ব্যাংক একাউন্ট চেক করে জানতে পারেন, সেই অর্থের চারগুণ বেশি অর্থ তার একাউন্টে জমা হয়েছে; এটি তার পূর্বের কোন চাকরিস্থল থেকে এসেছিল যা পাবার কোন আশাই ছিল না। বেনিনের লোকোসা অঞ্চলে প্রবল বন্যা হয়, এমনকি সেখানকার আহমদীদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেখানকার মুবাল্লিগ সাহেব অনেক কষ্টে পুলিশের বোটে করে আহমদীদের সাথে দেখা করতে ও তাদের সাহস দিতে যান। সেই ছোট জামাতের প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন; মুরব্বী সাহেব তাকে সাহস দিয়ে বলেন, আল্লাহ্ ক্ষয়-ক্ষতি দূর করবেন। তখন প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেন, আমি এজন্য কাঁদছি না যে, আমরা সমস্যায় পড়েছি; মুয়াল্লিম সাহেব এলে তাকে দেওয়ার জন্য আমি চাঁদার টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বন্যার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আর এদিকে চাঁদা দেয়ার সময়ও পার হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি দোয়া করছিলাম যেন আল্লাহ্ তা’লা কোন ব্যবস্থা করে দেন। আজ আপনারা যখন এলেন তখন আমি আর নিজের অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না, কারণ আল্লাহ্ তা’লা কত দ্রুত আমার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হচ্ছি।

হুযূর বলেন, এই হল তাদের অবস্থা! নিজের ক্ষতির কোন চিন্তা নেই! চিন্তা যদি থাকে তবে তা হল- আমি আল্লাহ্‌র খাতিরে যে কাজ করার অঙ্গীকার করেছি, খোদা তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে কুরবানী করার বাসনা ছিল, সেটি যেন সময়মত সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। ভারতের কর্ণাটকের একজন খাদেম ব্যাঙ্গালোরের একটি প্রতিষ্ঠানে মাসিক বিশ হাজার রুপি বেতনে চাকরি পান। তাকে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বর্ণিত আদর্শ কুরবানীর বরাতে বেতনের অর্ধেক চাঁদা প্রদান করতে আহ্বান করা হলে তিনি পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা সত্ত্বেও দশ হাজার রুপি দেওয়ার ওয়াদা করেন। তার আত্মীয়-স্বজনরা বলেন, ‘সবে তুমি নতুন চাকরি পেয়েছ, এত বড় অঙ্ক তোমার ওয়াদা করা উচিত নয়; সমস্যা হবে,’ কিন্তু তিনি বলেন, “হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) যখন একথা বলেছেন যে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ পূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা না করে, ততক্ষণ খোদা তা’লার ফিরিশ্তারা তার মাঝে শক্তি ও সামর্থ্য সৃষ্টি করেন না’; কাজেই আমি অবশ্যই এটা দিব।” এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই আরেক প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি পান, যেখানে তিনি আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় মাসে এক লাখ সাতাশ হাজার রুপি বেতন পাচ্ছেন; আর তিনি বলেন, এটাও চাঁদার কল্যাণেই হয়েছে।

এমন কুরবানীর ক্ষেত্রে কেবল বড়রাই নয়, ছোট ছোট শিশুরাও অগ্রগামী। ঘানার মুরব্বী সাহেব লিখেন, কিছুদিন পূর্বে আর্থিক কুরবানী ও তাহরীকে জাদীদের গুরুত্ব সম্পর্কে খুতবায় বলা হয় যে, ছোটদেরও নিজ হাতে চাঁদা দেয়ার অভ্যাস করা উচিৎ। পরের জুমুআয় ৯-১০ বছরের এক তিফল তাহরীকে জাদীদের চাঁদার জন্য কিছু অর্থ এনে দেয়। তাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, বাড়িতে যেহেতু আর্থিক সংকট ছিল, তাই সে একটি দোকানে শ্রমিকের কাজ করে যা উপার্জন করেছে তা-ই চাঁদা হিসেবে দিয়েছে। আবার সিয়েরালিওনেও ৯-১০ বছরের এক শিশু চাঁদার তাহরীক শুনে একদিন মাথায় করে লাকড়ির বোঝা নিয়ে আসে আর মুয়াল্লিম সাহেবকে বলে, এটা আপনি কিনে নিন আর সেই মূল্য আপনি আমার নামে চাঁদা দিয়ে দিন। এমন নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা এবং কুরবানীর অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তাদের ধন-সম্পদ ও ঈমানে আরও উন্নতি দান করুন। (আমীন)। হুযূর বলেন, এই যে কুরবানীর স্পৃহা ও নিষ্ঠা- এটি কেবল আল্লাহ্ তা’লার পক্ষেই সৃষ্টি করা সম্ভব, যিনি মানুষের হৃদয়কে পরিবর্তন করতে পারেন। এই একটি বিষয়-ই একজন বিবেকবান ও বুদ্ধিমান মানুষের জন্য হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট হতে পারে।

এরপর হুযূর তাহরীকে জাদীদের নববর্ষের ঘোষণা দেন ও বিগত বছরের কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। গত ৩১শে অক্টোবর তাহরীকে জাদীদের ৮৫তম বছর শেষ হয়েছে এবং ৮৬তম বছর শুরু হয়েছে। এ বছর এই খাতে ১৩.৬ মিলিয়ন পাউন্ড চাঁদা আদায় হয়েছে। পাকিস্তান বরাবর প্রথম স্থানে থাকত, কিন্তু পাকিস্তানের মুদ্রামান আকষ্মিকভাবে কমে যাওয়ায় এবার তারা দ্বিতীয় হয়েছে। হুযূর পাকিস্তানে অবস্থার উন্নতির জন্য দোয়ার আহ্বান করেন। সার্বিক বিচারে এবার প্রথম হয়েছে জার্মানি, এরপর পাকিস্তান; পাকিস্তানকে হিসেবের বাইরে রাখলে বহির্বিশ্বে অবস্থানগুলো যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ঘানা ও মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দেশ অর্জন করেছে। আল্লাহ্‌র কৃপায় এ বছর এ খাতে চাঁদাদাতার সংখ্যা ছিল ১৮ লক্ষ ২৭ হাজারের বেশি, বিগত বছরের তুলনায় ১ লাখ ১২ হাজার চাঁদাদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় জামাতগুলোর মাঝে হুযূর সবার শীর্ষে বাংলাদেশ জামাতের নামও উল্লেখ করেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সকল কুরবানীকারীর ধনসম্পদ ও জনবলে সমৃদ্ধি দান করুন। (আমীন)