সালানা জলসা ফ্রান্স – ২০১৯

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-অক্টোবর, ২০১৯

তিগ-শ্যাতু (Trie Chateau), ফ্রান্স

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৪ই অক্টোবর, ২০১৯ ফ্রান্সের তিগ-শ্যাতু (Trie Chateau) থেকে আহমদীয়া মুসলিম জামাত, ফ্রান্সের ২৭তম বার্ষিক জলসার উদ্বোধন উপলক্ষ্যে জলসা আয়োজনের উদ্দেশ্য এবং বয়আতের তাৎপর্য এবং তা অর্জনের উপায় সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আজ আল্লাহ্ তা’লার অপার কৃপায় আপনাদের জলসা শুরু হচ্ছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জলসাকে একান্তই ধর্মীয় সমাবেশ আখ্যা দিয়েছেন। তাই এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের কাছে এটি সুস্পষ্ট হওয়া উচিৎ যে, আগামী তিনদিনের জন্য আমরা নিজেদের ধর্মীয়, জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক অবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে এখানে সমবেত হয়েছি; এখানে এসে যদি আমাদের মাঝে এই বিষয়গুলোতে উন্নতি সাধনের চিন্তা ও চেষ্টা না থাকে, তবে আমাদের জলসায় আসা বৃথা।

হুযূর বলেন, প্রতি বছর ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারানো লোকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে; এমনকি মুসলমানদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাতেও এটি প্রতীয়মান হয় যে, তারা নামমাত্র মুসলমান, জাগতিকতাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা যারা এই দাবী করি, আমরা সেই যুগ ইমামের হাতে বয়আত করেছি যাকে আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমরা যদি নিজেদের অবস্থা উন্নত করতে সচেষ্ট না হই এবং আমাদের বয়আতের অঙ্গীকার যদি নামমাত্র অঙ্গীকার হয়ে থাকে- তবে তা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই এ বিষয়ে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে নিজেদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। যদি আমরা তা করি এবং সে অনুসারে নিজেদের সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হই, তবে একদিকে যেমন নিজেরা আল্লাহ্ তা’লার কৃপাবারি লাভ করব, অন্যদিকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্যপ্রাপ্ত ও তাঁর কৃপাবারিতে ভূষিত করতে সক্ষম হবো।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভাষ্যমতে জলসার উদ্দেশ্য হল- জলসায় আগতদের মাঝে যেন পরকালের প্রতি আকর্ষণ জন্মে, তাকওয়া সৃষ্টি হয়, খোদাভীতি সৃষ্টি হয়, হৃদয়ে কোমলতা সৃষ্টি হয়, নিজেদের মাঝে পারষ্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, দীনতা ও বিনয় সৃষ্টি হয়, তারা যেন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধর্মসেবার প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। অতএব, আজ আমাদের এখানে একত্রিত হওয়ার এটিই একমাত্র উদ্দেশ্য। যুগ মসীহ্‌র (আ.) হাতে বয়আতকারী প্রত্যেকের পরকাল সম্বন্ধে এতটা চিন্তিত হওয়া দরকার যেন এর তুলনায় জাগতিক বিষয়াদি কোন গুরুত্বই না রাখে। পৃথিবীতে মানুষ ক’দিনই বা বাঁচে! আশি-নব্বই বছর, বড়জোর একশ’ বছর; কিন্তু পরকালের জীবন তো অনন্ত-অসীম। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তো সে, যে চিরস্থায়ী জিনিসের জন্য সাময়িক বস্তুকে উৎসর্গ করে।

হুযূর বলেন, কিন্তু কার্যত যা হয় তা হল- মানুষ মনে করে, ‘আমি অনেক বুদ্ধিমান’, অথচ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর জন্য সে পরকালকে উৎসর্গ করে দেয়; কিন্তু একজন প্রকৃত মু’মিনের অবস্থা তেমন হয় না। মু’মিনের হৃদয়ে খোদাভীতি থাকে, আর আল্লাহ্‌র প্রতি তার ভালোবাসা পার্থিব সকল ভালোবাসার চেয়ে অধিক হয়ে থাকে। মু’মিন কোন পুরস্কারের আশায় পুণ্যকর্ম করে না, বরং আল্লাহ্‌র প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে করে; আর আল্লাহ্‌র নিষেধকৃত বিষয়াবলী থেকে কেবল এজন্য বিরত থাকে যে, এগুলো করলে আমার আল্লাহ্ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। মোটকথা, খোদার সন্তুষ্টিই তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ববহ হয়ে থাকে। আর এমন ব্যক্তিরাই সফলকাম হয়।

হুযূর আরো বলেন, যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে এবং হৃদয়ে খোদাভীতি লালন করে, তারা সর্বপ্রথম নিজেদের ইবাদতকে সুরক্ষিত করার প্রতি মনোযোগী হয়। তারা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী এর প্রতি দৃষ্টি দেয়; আর তা আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করে দিয়েছেন- ‘ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়া’বুদুন’। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর অনুবাদ এভাবে করেছেন ‘আমি জিন্ন ও মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করেছি যেন তারা আমাকে চেনে ও আমার উপাসনা করে।’ তিনি (আ.) বলেন, মানুষের এই অধিকার নেই যে, সে স্বয়ং তার জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবে, কারণ সে নিজে থেকে এই পৃথিবীতে আসেও নি আর যাবেও না। তিনি (আ.) বলেন, নিঃসন্দেহে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হল, খোদা তা’লার ইবাদত, তাঁকে চেনা ও তাঁর মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া। আর ইবাদতের জন্য সর্বোত্তম যে পদ্ধতি আল্লাহ্ তা’লা শিখিয়েছেন তা হল, নামায প্রতিষ্ঠা করা, আর বলেছেন- ‘ইন্নাস সালাতা কানাত আলাল মুমিনীনা কিতাবাম্ মাওকুতা’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই নামায মু’মিনদের জন্য নির্ধারিত সময় পড়া বিধিবদ্ধ’। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, নির্ধারিত সময়ে নামাযের বিষয়টি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই, নামায সময়মত পড়া তো দূরের কথা, কেউ কেউ তো নামাযই পড়ে না, পড়লেও- কয়েক ওয়াক্তের নামায একসাথে পড়ে নেয়; কখনো ব্যবসা-বাণিজ্য বা কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে যোহর বা আসরের নামায নষ্ট করে, কখনো টিভি ইত্যাদি দেখায় মগ্ন থেকে মাগরিব বা এশার নামায নষ্ট করে, কখনো ঘুমের উছিলায় ফজর নষ্ট হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ্ তা’লার বাণী কী দেখুন! ‘ইন্নামা ইয়া’মুরু মাসাজিদাল্লাহি মান আমানা বিল্লাহি ওয়াল ইয়াওমিল আখিরে’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্‌র মসজিদ তো সেই ব্যক্তিই আবাদ করে যে আল্লাহ্ ও পরকালে ঈমান রাখে’। এ আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে মু’মিন হল সেই ব্যক্তি, যে মসজিদ আবাদ করে অর্থাৎ নিয়মিত মসজিদে যায়। কিন্তু তারা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয় যারা মসজিদে আসে ঠিকই কিন্তু বিশৃঙ্খলাপরায়ণ, বরং প্রকৃত মু’মিনের মাঝে বিনয় থাকে, তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে, তাদের মসজিদ ভীতির কারণ হয় না বরং শান্তির নীড় হয়। কাজেই যারা তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে মসজিদ আবাদ করে, তারা যেমন আল্লাহ্‌র প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে, তেমনি বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানেও তৎপর হয়, তারা একে অপরের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে মার্জনা করার ব্যাপারে বেশি উদগ্রীব থাকে।

হুযূর বলেন, অতএব এদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে; আমরা যারা এই শ্লোগান দেই- ‘ভালোবাসা সবার তরে, ঘৃণা নয়কো কারও পরে’- আমাদের প্রথমে নিজেদের বাড়িতে ও সমাজে এর বিকাশ ঘটাতে হবে, তবেই আমরা সঠিক অর্থে জগতময় এই বাণীর প্রচারক হতে পারব। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর বয়আতের বিভিন্ন শর্তের প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যেমন বিনা ব্যতিক্রমে পাঁচবেলার নামায পড়া ও সাধ্যমত তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নফল আদায় করা, দরূদ ও ইস্তেগফারে রত থাকা; উত্তেজনার বশে কোনভাবে আল্লাহ্‌র সৃষ্ট কোন জীবকে, বিশেষতঃ কোন মুসলমানকে কোনপ্রকার কষ্ট না দেয়া; দীনতা-বিনয় অবলম্বন করা। আর সদাচরণ করা। মোটকথা বয়আতের শর্তাবলীর প্রতি আমাদের সর্বদা মনোযোগ থাকা প্রয়োজন ও তা যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন। জলসার এই তিনটি দিন আমাদেরকে এদিকে মনোনিবেশ করার ও আত্মবিশ্লেষণ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা আবশ্যক; তবেই আমরা জলসা থেকে সত্যিকার অর্থে উপকৃত হতে পারব। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বয়আতের যেসব উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন- সে বিষয়ে তাঁর (আ.) একটি নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতিও হুযূর (আই.) খুতবার শেষদিকে তুলে ধরেন। এই উদ্ধৃতিতে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর অনুসারীদের কাছে যেসব প্রত্যাশা রেখেছেন তা সুস্পষ্ট করেছেন। অতঃপর হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন আমরা যেন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার দায়িত্ব পালনকারী হই, তাঁর উপদেশাবলী পালনকারী হই ও তিনি আমাদের কাছে যেমনটি আশা করেছেন- তেমনটি হতে পারি; এই জলসা দ্বারা আমরা যেন বেশি বেশি উপকার লাভ করে নিজেদের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানগত অবস্থাকে সুসংহত করতে পারি এবং এসব পুণ্য যেন আমাদের মাঝে চিরস্থায়ীও হয়। (আমীন)