সালানা জলসা হল্যন্ড – ২০১৯

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৭-সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নুনস্পিট, হল্যান্ড

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ নুনস্পিটের জলসাগাহ্ থেকে হল্যান্ড জামাতের ৩৯তম বার্ষিক জলসা উপলক্ষ্যে জলসা ও বয়াতের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য কি আর তা কিভাবে অর্জন করা যায় সে সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় আজ আহমদীয়া মুসলিম জামাত, হল্যান্ডের বার্ষিক জলসা শুরু হতে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর পর আল্লাহ্ তা’লা আমাকেও এতে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য দান করছেন; বিগত কয়েক বছর থেকেই আমীর সাহেব আমাকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, কিন্তু জামাতের অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসা সম্ভব হয় নি। হুযূর বলেন, বিগত কয়েক বছরে হল্যান্ড জামাতের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্ততঃ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়েছে; পাকিস্তান থেকে অনেকে হিজরত করে এখানে এসেছেন, বেশ কিছু বয়আতও হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য জামাতগুলোর মত হল্যান্ড জামাতও ক্রমশ উন্নতি করছে, সংখ্যা ছাড়াও প্রকাশনা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। নতুন একটি কেন্দ্র এবং খুব সুন্দর মসজিদও নির্মিত হয়েছে যা আমি আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করব। কিন্তু সর্বদা স্মরণ রাখবেন, সংখ্যাবৃদ্ধি বা নতুন কেন্দ্র বা মসজিদ নির্মাণ তখনই কাজে আসবে যখন এগুলোর উদ্দেশ্য পূরণ করা হবে। তাই এখানে অবস্থানকারী প্রত্যেক আহমদীর আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, আর চিন্তা করা উচিৎ ও অন্বেষণ করা উচিৎ, ‘কী সেই উদ্দেশ্য যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার ফলে আমাদের পূরণ করতে হবে?’ যারা পাকিস্তান থেকে এখানে হিজরত করে এসেছেন, তারা চিন্তা করে দেখুন যে, কী কারণে এখানে এসেছেন? আসার কারণ হল, সেখানে আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই, আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার ইবাদত করতে বাধা দেয়া হয়, কারণ আমরা মহানবী (সা.) প্রদত্ত সুসংবাদ ও ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মেনেছি। এখানে এসে আপনারা যেমন ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করেছেন, তেমনি আর্থিকভাবেও পূর্বের চেয়ে অধিক স্বচ্ছ্বলতা লাভ করেছেন, তাই আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা পূর্বের চেয়ে বেশি প্রকাশ করা উচিৎ এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের সুবাদে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য পরিপূর্ণ চেষ্টা করা উচিৎ। আর এতটুকু করেই আত্মপ্রসাদ নিলে চলবে না যে, আমরা এখানে স্বাধীন। ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের পরও যদি আমরা ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে পালন না করি, তবে এই স্বাধীনতায় কী লাভ? অনুরূপভাবে জলসায় অংশগ্রহণও তখন লাভজনক হবে যখন আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.) কর্তৃক বর্ণিত জলসার উদ্দেশ্য অর্জনকারী হব, আর তা হল, আমাদের নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করা, ধর্মকে পার্থিবতার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করা, আমাদের হৃদয়ে আল্লাহ্ তা’লা ও তাঁর রসূল (সা.)-এর ভালোবাসা সৃষ্টি করা, আমাদের আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক অবস্থা এবং জ্ঞানগত মান উন্নত করা।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বয়আতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘বয়আতের উদ্দেশ্য হল, জগতের প্রতি ভালোবাসা ও মোহ যেন শীতল হয়ে যায় এবং আল্লাহ্ তা’লা ও মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা হৃদয়ে প্রাধান্য লাভ করে, আর এমন জগতবিমুখতা সৃষ্টি হয় যেন পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা কষ্টকর মনে না হয়।’ এজন্য তিনি (আ.) বয়আতের শর্তাবলীর মধ্যেও এই শর্তটি রেখেছেন যে, ‘প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নির্দেশকে শিরোধার্য করবে’। হুযূর (আই.) বলেন, জগতের ভালোবাসা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়, এর জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও সাধনা প্রয়োজন। পার্থিব যেসব ব্যস্ততা আমাদের আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জন ও তাঁর অধিকার প্রদানের পথে প্রতিবন্ধক সাজে সেগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা তিনি (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন তা হল, অন্য যে কারো চেয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা বেশি গভীর হতে হবে, কারণ তিনি (সা.)-ই এখন আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছাবার একমাত্র মাধ্যম। তিনি (আ.) পবিত্র কুরআনে প্রদত্ত আল্লাহ্‌র বাণী ‘কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউ’নি ইয়ুহবিবকুমুল্লাহ্’র আলোকে এটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি কেবল মহানবী (সা.)-এর এক নিষ্ঠাবান প্রেমিক, মহানবী (সা.)-এর প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা সৃষ্টি না হলে তার (আ.) হাতে বয়আত করা বৃথা।

হুযূর এরপর সাহাবীদের অসাধারণ কুরবানী ও দৃষ্টান্তের কথাও উল্লেখ করেন, যা তিনি ধারাবাহিকভাবে খুতবায় বর্ণনা করছেন; তারা জীবিকা অর্জনের জন্য পার্থিব কাজকর্ম করতেন, কিন্তু আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা তাদের কাছে সবকিছুর ওপর অগ্রগণ্য ছিল। তারা সবসময় এই চিন্তায় রত থাকতেন যে, তাদের দ্বারা এমন কোন কাজ যেন সংঘটিত না হয়ে যায়, যা আল্লাহ্ বা মহানবী (সা.)-এর অসন্তুষ্টির কারণ হয়। জলসার তিনটি দিন একপ্রকার কর্মশালা বা প্রশিক্ষণ শিবির, যেখানে এসব আধ্যাত্মিক বিষয় শিখে বছরজুড়ে তা চর্চা ও অনুশীলন করতে হয়।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) পুণ্যকর্ম করার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, পুণ্যকর্ম করার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হওয়া উচিত, কোন প্রতিদান পাওয়া যেন এর উদ্দেশ্য না হয়। আল্লাহ্ তো বলেছেন যে, তিনি কারও পুণ্য বিনষ্ট করবেন না, কিন্তু সৎকর্মশীল ব্যক্তির এই চিন্তা হৃদয়ে স্থান দেওয়া অনুচিত যে, ‘এটা করলে আমি প্রতিদানে ওটা পাব’; তেমনিভাবে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ পালনও তাঁর (সা.) ভালোবাসার খাতিরে করা আবশ্যক, কোন প্রতিদান বা প্রশংসা লাভ করা যেন উদ্দেশ্য না হয়। হুযূর বলেন, এসব উন্নত দেশে এসে, যেখানে স্বাধীনতার নামে সর্বপ্রকার নোংরামীর বেসাতি হচ্ছে, আমাদের নিজেদের কর্মের প্রতি আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। কখনও কখনও স্বাচ্ছন্দ্য ইবাদত ও পুণ্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়, মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য বা জাগতিক কাজের অজুহাতে নামায ছেড়ে দেয় বা জমা করে পড়ে, কিংবা এত দ্রুত পড়ে যেন ঘাড় থেকে বোঝা নামাচ্ছে; এমন কর্মকান্ড তো আল্লাহ্‌র ভালোবাসার সম্পূর্ণ বিপরীত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ইবাদত যখন আল্লাহ্ তা’লার প্রতি ভালোবাসার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে করা হয়, তখন তা প্রকৃত ইবাদতে পরিণত হয়। আর এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা’লা জগতের মুখাপেক্ষী রাখেন না, বরং স্বয়ং তার জন্য সম্মানজনক জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করে দেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “আমি এজন্য এসেছি যেন ঈমানকে শক্তিশালী ও দৃঢ় করি এবং মানুষের সামনে খোদা তা’লার অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেখাই, কারণ প্রত্যেক জাতির ঈমানের অবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং পরকালকে এক গল্প-কাহিনী মনে করা হচ্ছে।” তিনি (আ.) আরো বলেন, “যেভাবে ইহুদীরা ধর্মের প্রতি ভালোবাসা পরিত্যাগ করে জগতপ্রেমে মত্ত হয়ে গেলে মসীহ্ এসেছিলেন, তেমনিভাবে মুসলমানদের অনুরূপ অবস্থার প্রেক্ষিতে এ যুগে মুহাম্মদী মসীহ্‌কে প্রেরণ করা হয়েছে।”

হুযূর (আই.) বলেন, তাই আজ আমাদের দায়িত্ব একদিকে নিজেদের মাঝে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের (সা.) ভালোবাসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা এবং পার্থিবতার মোহ থেকে মুক্ত হওয়া। জগত পূজা পরিহার করে নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করা, সেই সাথে এই সমাজ ও জগদ্বাসীকেও খোদার নিকটবর্তী করা, কারণ জগত ক্রমশঃই খোদা ও ধর্ম বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। এমনটি করলে পরেই আমরা এই জলসার উদ্দেশ্য পূরণকারী হব এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত গ্রহণের দায়িত্ব পালনকারী হব। আর কেবল নিজেদের মাঝেই আল্লাহ্ ও রসূলের ভালোবাসা সৃষ্টি করলে চলবে না, বরং নিজ সন্তানদের ও পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয়েও আল্লাহ্ তা’লা ও তাঁর রসূলের ভালোবাসা সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, একইসাথে পৃথিবীবাসীকেও খোদা তা’লার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

হুযূর বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার ফলে তার মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদেরও দায়িত্বে পরিণত হয়েছে, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তা পালনের তৌফিক দান করুন। আল্লাহ্ করুন- এই জলসার দিনগুলো আমরা যেন নিজেদের ইবাদতের মান সমুন্নত করার ও তা ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট হই, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের (সা.) ভালোবাসায় ক্রমশ উন্নতি করি, আর পৃথিবীর চাকচিক্য ও আকর্ষণ কক্ষনো যেন আমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম না হয়; আর এসবকিছু আল্লাহ্ তা’লার কৃপা ছাড়া কখনোই সম্ভব হতে পারে না। তাঁর কৃপা লাভ করার জন্যও অনেক বেশি দোয়া করা প্রয়োজন এবং এদিকে আমাদের অনেক মনোযোগ দিতে হবে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন। (আমীন)