শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-আগস্ট, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬ আগস্ট, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত কাতাদা বিন নো’মান আনসারী (রা.) ও হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাযউন (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আজ আমি পুনরায় বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণ করব। প্রথম স্মৃতিচারণ হল হযরত কাতাদা বিন নো’মান আনসারী (রা.)’র। তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের বনু যাফর পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল নো’মান বিন যায়েদ ও মাতার নাম উনায়সা বিনতে কায়েস। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) তার সৎভাই ছিলেন। তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে অংশ নেন, ইবনে ইসহাক যদিও এ বিষয়ে দ্বীমত পোষণ করেন। হযরত কাতাদা মহানবী (সা.)-এর দক্ষ তীরন্দাজদের একজন ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা হিসেবে যোগদানের সৌভাগ্য লাভ করেন। মক্কা বিজয়ের দিন বনু যাফর-এর পতাকা তার হাতেই ছিল। উহুদের যুদ্ধের দিন তিনি মহানবী (সা.)-এর দেয়া ধনুক দিয়ে তীর নিক্ষেপ করছিলেন; এক পর্যায়ে ধনুকের তন্ত্রী ছিড়ে যায়, তবুও তিনি মহানবী (সা.)-এর সামনে ঢালের মত দাঁড়িয়ে থাকেন এবং নিজের মাথা দিয়ে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মুখমন্ডল রক্ষার চেষ্টা করতে থাকেন। হঠাৎ একটি তীর এসে তার চোখে বীদ্ধ হয় এবং তার অক্ষিগোলক বাইরে বের হয়ে আসে। ইতোমধ্যে শত্রুদল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। হযরত কাতাদা অক্ষিগোলকটি হাতে করে নিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে যান। মহানবী (সা.) যখন এটি দেখেন তখন তাঁর (সা.) চোখ অশ্রুসিক্ত হয় এবং তিনি (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! কাতাদা তার নিজের চেহারা দিয়ে তোমার নবীর চেহারা রক্ষা করেছে; তাই তুমি তার এই চোখটিকে উভয় চোখের মধ্যে অধিক সুন্দর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন করে দাও।’ তিনি (সা.) নিজ হাতে তা অক্ষিকোটরে রেখে দেন, আর পরে সেটি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায় এমনটি শেষ বয়স পর্যন্ত তার এই চোখটি বেশি শক্তিশালী বা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। এজন্য তিনি যুল-আইন নামেও খ্যাতি লাভ করেন। হযরত কাতাদা ২৩ হিজরিতে ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, হযরত উমর (রা.) তার জানাযার নামায পড়ান।

হযরত কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, আনসারদের একটি পরিবারের নাম ছিল বনু উবায়রক; সেই পরিবারে তিন ভাই ছিল- বিশর, বুশায়র ও মুবাশ্বের। বুশায়র মুনাফিক ছিল, স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে সাহাবীদের অপমান করত আর বলত, অমুকে এসব লিখেছে। তবে মহানবী (সা.) ঠিকই তা বুঝতে পারতেন এবং বলতেন যে এগুলো এই দুষ্ট ব্যক্তিরই রচিত। এরা ইসলামপূর্ব যুগেও এবং ইসলামের যুগেও হতদরিদ্র লোক ছিল, কারণ এরা অলস ও অকর্মণ্য লোক ছিল। সেই যুগে যারা একটু ধনী হতো, তারা সিরিয়া থেকে আসা মিটি সাদা আটা কিনে খেতো। কাতাদার চাচা রিফা’ বিন যায়েদ একবার একবস্তা ময়দা বা আটা কিনে নিজের গুদামে রাখেন, যেখানে তার অস্ত্রশস্ত্র, বর্ম ইত্যাদিও ছিল। সেই গুদামের দেয়াল ভেঙে ময়দা ও সব অস্ত্রশস্ত্র চুরি করে নেয়া হয়। রিফা’ তার ভাতিজা কাতাদাকে এটি জানান এবং তারা নিজেদের এলাকায় খোঁজখবর নেন; তারা জানতে পারেন বনু উবায়রক’কে রাতে আগুন জ্বালিয়ে জেগে থাকতে এবং আনন্দ উদযাপন করতে দেখা গিয়েছে, সম্ভবতঃ তারা-ই একাজ করেছে। কিন্তু এই খোঁজখবর নেওয়ার সময় বনু উবায়রক বলে বসে, ‘আল্লাহ্‌র কসম! আমাদের তো মনে হয় চুরি লবীদ বিন সাহল করেছে।’ হযরত লবীদ খুবই ভালো মানুষ ও এক পুণ্যবান সাহাবী ছিলেন, অথচ দুষ্টচক্র তার নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়। রিফা’ কাতাদাকে বলেন, যদি মহানবী (সা.)-কে ঘটনাটি জানানো হয়, তাহলে হয়তো চুরি যাওয়া মাল-সামান ফেরত পাওয়া যেত। কাতাদা মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। মহানবী (সা.) বলেন, তিনি অন্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। বনু উবায়রক যখন এটি জানতে পারে তখন তারা উসায়ের বিন উরওয়া নামক একজনের কাছে যায় এবং তাকে বুঝায় যে রিফা’ ও কাতাদা কোন সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়াই তার প্রতি চুরির মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে, পাড়ার কিছু দুষ্টলোকও একথায় সায় দেয়। সবাই মহানবী (সা.)-কে গিয়ে একথা বলে। কাতাদা পুনরায় মহানবী (সা.)-এর কাছে আসলে তিনি (সা.) পাড়ার লোকদের সেই অভিযোগ তুলে ধরেন। কাতাদা পুণ্যবান প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাই আর কথা না বাড়িয়ে ফেরত চলে আসেন আর মনে মনে ভাবেন, মাল-পত্র চুরি হয়েছে হোক, আমি কেন এটি মহানবী (সা.)-কে বলে তাঁকে কষ্টে ফেললাম?! রিফা’ যখন একথা জানতে পারেন তখন কাতাদাকে বলেন, আল্লাহ্ই আমাদের সহায়। এই আলাপচারিতার সামান্য পরেই সূরা নিসার ১০৬ থেকে ১১৫ নং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়, যেখানে এ ধরনের অপকর্মের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়। কাতাদার ধারণামতে এভাবে আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কে সত্য বিষয় অবগত করেন; বনু উবায়রকও ভাবে যে তারা ধরা পড়ে গিয়েছে, তাই তারা চোরাই অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি মহানবী (সা.)-এর কাছে ফেরত দেয়। তিনি (সা.) কাতাদার হাতে তা রিফা’কে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু রিফা’ আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের খাতিরে এগুলো সদকা করে দেন। এই ঘটনার পর বুশায়র মুশরিকদের দলে গিয়ে ভিড়ে; তখন সূরা নিসার ১১৬-১১৭নং আয়াতদু’টি নাযিল হয় যাতে এভাবে মুরতাদ ও মুশরিক হওয়ার শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, এক রাতে কাতাদা বিন নু’মান সারারাত সূরা ইখলাস পড়তে থাকেন। মহানবী (সা.)-কে যখন এটি জানানো হয় তখন তিনি (সা.) বলেন, সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই সূরা ইখলাস কুরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশের সমান। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র একত্ববাদই এর মূল শিক্ষা।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, জুমুআর দিন এমন একটি মুহূর্ত আসে যে, তখন যদি বান্দা নামাযরত ও দোয়ারত থাকে, তবে সে যা-ই চায়, আল্লাহ্ তাকে অবশ্যই তা দান করেন। আর সেই মুহূর্তটি খুবই সংক্ষিপ্ত বলে আবু হুরায়রা ইঙ্গিত করেন। বিভিন্ন হাদীসে এই মুহূর্তটি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে যা থেকে তিনটি সময়ের কথা জানা যায়, প্রথমতঃ এটি জুমুআর সময় আসে, আরেকটি হল এটি শুক্রবারে দিনের শেষভাগে আসে, তৃতীয় মত হল আসরের নামাযের পর সেই মুহূর্তটি আসে।

হুযূর (আই.) এই বিষয়টির উপর নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, জুমুআ ও রমযানের মধ্যে একটি সাদৃশ্য রয়েছে; জুমুআও দোয়া গৃহীত হওয়ার দিন এবং রমযানও দোয়া কবুল হওয়ার মাস। এরপর তিনি (রা.) হযরত আবু হুরায়রা (রা.)’র বর্ণনাটি উল্লেখ করেন। সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, এই মুহূর্তটি জুমুআর দ্বিতীয় আযান থেকে বা তার কিছু আগে শুরু হয়ে নামাযের সালাম ফিরানো পর্যন্ত থাকে। যদি খুতবা খুব সংক্ষিপ্তও হয় তবুও এতে আধা ঘন্টার মত সময় লাগে, আর খুতবা কিছুটা দীর্ঘ হলে ঘন্টা-দেড় ঘন্টার ব্যাপার। এখন এই নব্বই মিনিট সময়ের মধ্যে কোন একটি সময় সেই দোয়া কবুল হওয়ার মুহূর্তটি আসে, কারও তো জানা নেই যে এটি প্রথম মিনিটে আসে না দ্বিতীয় মিনিটে আসে না শেষ মিনিটে আসে। তাই পুরো সময়-ই দোয়ায় রত থাকা ও মনোযোগী থাকা দোয়া কবুল হওয়ার জন্য আবশ্যক, যা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ; কেননা সাধারণত মানুষের জন্য দেড়-দু’মিনিট পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই নব্বই মিনিট পর্যন্ত দোয়া ও যিকরে ইলাহীতে রত থাকার কঠিন কাজ সাধন করলে আল্লাহ্ তা’লা অবশ্যই তার দোয়া কবুল করবেন।

এরপর দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাযউন (রা.), তিনি কুরাইশদের বনু জুমাহ গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার মাতার নাম সুখায়লা বিনতে আমবাস; তিনি হযরত উসমান বিন মাযউন, কুদামা বিন মাযউন ও সায়েব বিন মাযউনের ভাই ছিলেন, তারা সবাই হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমরের মামা ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাযউন মহানবী (সা.)-এর দারে আরকামে তবলীগি কার্যক্রম শুরু করার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা চার ভাই-ই ইথিওপিয়ায় হিজরত করেছিলেন, পরবর্তীতে কুরাইশদের প্রতারণার শিকার হয় যে, মক্কার সবাই মুসলমান হয়ে গিয়েছে- একথা শুনে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় মহানবী (সা.) তার ও হযরত সাহল বিন উবায়দুল্লাহ্ আনসারীর মাঝে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন রচনা করান, একটি বর্ণনানুসারে তার ধর্মভাই ছিলেন কুতবা বিন আমের (রা.)। তারা চার ভাই-ই একসাথে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বদর ছাড়াও উহুদ, খন্দকসহ বাদবাকি সকল যুদ্ধাভিযানে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ৩০ হিজরিতে হযরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

হুযূর আনোয়ার দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এই সাহাবীদের মর্যাদা উচ্চ থেকে উচ্চতর করতে থাকুন। (আমীন)