শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-জুলাই, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৬ জুলাই, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত মুযাহির বিন রাফে (রা.), হযরত মালিক বিন কুদামাহ্ (রা.), হযরত খুরাইম বিন ফাতেক (রা.), হযরত মা’মার বিন হারেস (রা.), হযরত যুহাইর বিন রাফে (রা.), হযরত আমর বিন আইয়াস (রা.), হযরত মুদলিয বিন আমর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সুহায়ল, হযরত ইয়াযিদ বিন হারেস (রা.), হযরত উমায়ির বিন হুমাম (রা.), হযরত হুমায়দ আনসারী (রা.), হযরত আমর বিন মু’আয বিন নু’মান আওসী (রা.), হযরত মাসুদ বিন রবীআ বিন আমর (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজও আমি বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণই করব। প্রথম যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করা হবে তার নাম হল হযরত মুযাহের বিন রাফে (রা.), তার পিতার নাম রাফে বিন আদী। তিনি আনসারদের অওস বংশের বনু হারসা বিন হারেস গোত্রের লোক ছিলেন। তার ভাইয়ের নাম যুহায়ের, তারা হযরত রাফে বিন খুদায়জের চাচা ছিলেন। হযরত রাফের ব্যাপারে হুযূর বলেন, তিনি বদরের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মহানবী (সা.)-এর কাছে খুব বায়না ধরেছিলেন, কিন্তু হুযূর (সা.) তার বয়স কম হওয়ায় অনুমতি দেন নি; তবে উহুদের যুদ্ধের সময় তার আবদার রাখেন ও অনুমতি প্রদান করেন। উহুদের যুদ্ধে একটি তীর তার পাঁজরে লাগে, তীর বের করে নিলেও তীরের ডগাটি বের করা যায় নি, হযরত রাফে সারা জীবন সেটি বয়ে বেড়িয়েছেন। মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন, কিয়ামতের দিন আমি তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দিব। হযরত মুযাহের তার ক্ষেতে কাজ করার জন্য সিরিয়া থেকে কয়েকজন মজুর ভাড়া করে আনেন। খায়বার পৌঁছে তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান করেন। খায়বারের ইহুদীরা সেই মজুরদেরকে গোপনে হযরত মুযাহেরকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করে, তাদেরকে অর্থের লোভ দেখায় ও কয়েকটি ছুরিও দেয়। খায়বার থেকে রওয়ানা হয়ে মাইল ছয়েক দূরে যাবার পর সেই মজুররা তাকে হত্যা করে ও ইহুদীদের কাছ থেকে পুরস্কারস্বরূপ টাকা-পয়সা নিয়ে সিরিয়া ফিরে যায়। হযরত উমর যখন এটি জানতে পারেন তখন তিনি খায়বার থেকে সেই ইহুদীদের বিতাড়িত করেন ও তাদের যাবতীয় সম্পদ জব্দ করে তা বন্টন করে দেন, যেমনটি আল্লাহ্ তা’লা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন। তার শাহাদাতের ঘটনাটি ২০ হিজরিতে ঘটেছিল।

পরবর্তী সাহাবী হযরত মালেক বিন কুদামা (রা.); তার পিতার নাম কুদামা বিন আরফাজা, তিনি আনসারদের অওস বংশের বনু গানাম গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি তার ভাই হযরত মুনযের বিন কুদামার সাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন।

তৃতীয় সাহাবী হযরত খুরায়ম বিন ফাতেক (রা.); তিনি বনু আসাদ গোত্রের লোক ছিলেন, তার পিতার নাম ফাতেক বিন আখরাম। হযরত খুরায়ম তার ভাই হযরত সাবরা বিন ফাতেকের সাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ও তিনি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজের পুত্রসহ কুফায় চলে যান, সেখানে আমীর মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও অত্যন্ত চমকপ্রদ। হযরত খুরায়ম বেশ-ভূষার ব্যাপারে খুব সৌখিন ছিলেন, সুন্দর জামা-কাপড় পরতেন ও পরিপাটি রাখতেন। ইসলাম গ্রহণের আগে লম্বা পায়জামা পরতেন ও লম্বা চুল রাখতেন। একদিন মহানবী (সা.) বলেন, খুরায়ম, তোমার মাঝে যদি দু’টি বিষয় না থাকলে তুমি খুব ভাল মানুষ ছিলে। তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে সেই দু’টি বিষয় জানতে চান। মহানবী (সা.) ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল রাখার ও পায়জামা ঝুলিয়ে অর্থাৎ মাটিতে লাগিয়ে পরার কথা উল্লেখ করেন, যা অহংকারের পরিচায়ক ছিল। হযরত খুরায়ম সাথে সাথে চুল কাটিয়ে ছোট করে ফেলেন ও পায়জামাও ঠিক করিয়ে নেন। হুযূর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর এই নির্দেশ প্রমাণ করে যে অযথা মেয়েদের মত চুল লম্বা রাখা মহানবী (সা.) পছন্দ করতেন না।

চতুর্থ সাহাবী হযরত মা’মের বিন হারেস (রা.), তিনি কুরায়শদের গোত্র বনু জুমা লোক ছিলেন। তার পিতার নাম হারেস বিন মা’মের ও মাতার নাম কুতায়লা বিনতে মাযউন, যিনি উসমান বিন মাযউনের বোন ছিলেন। তার আরও দুই ভাই ছিলেন- হাতেব ও হাত্তাব; তারা তিনজনই দারে আরকাম যুগের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত মা’মের ‘আসসাবেকুনাল আউয়ালুন’দের মাঝে গণ্য হতেন। মহানবী (সা.) হযরত মুআয বিন আফরা (রা.)-কে তার ধর্মভাই বানিয়েছিলেন। হযরত মা’মের বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই অংশ নেন, ২৩ হিজরিতে হযরত উমরের খিলাফতকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পঞ্চম সাহাবী হযরত যুহায়ের বিন রাফে (রা.), প্রথমোক্ত সাহাবী মুযাহের বিন রাফের ভাই ছিলেন। তার ছেলেন নাম উসায়েদ (রা.), যিনি সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন; যুহায়রের স্ত্রীর নাম ফাতেমা বিনতে বিশর। যুহায়ের ও মুযাহের (রা.) দু’ভাই একসাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। যুহায়ের আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে অংশ নিয়েছিলেন, পরবর্তীতেও সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন।

ষষ্ঠ সাহাবী হযরত আমর বিন আইয়াস (রা.), তিনি ইয়েমেনের লোক ছিলেন আর আনসারদের বনু লুযান গোত্রের মিত্র ছিলেন। তার পিতা আইয়াস বিন আমর। হযরত আমর বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন; তিনি হযরত রবী বিন আইয়াস ও ওয়ারাকা বিন আইয়াসের ভাই ছিলেন, তারা তিনজন একসাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

সপ্তম সাহাবী হযরত মুদলেজ বিন আমর (রা.), তিনি বদরের যুদ্ধে নিজের দুই ভাই সাকফ বিন আমর ও মালেক বিন আমরের সাথে অংশ নেন, তিনি পরবর্তী যুদ্ধগুলোতেও মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৫০ হিজরিতে আমীর মুয়াবিয়ার যুগে তার মৃত্যু হয়।

অষ্টম সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সুহায়ল (রা.), তার পিতার নাম সুহায়ল বিন আমর ও মাতা ফাখতা বিনতে আমর। প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু জান্দাল তার ভাই ছিলেন। তারা কুরায়শ বংশের লোক ছিলেন, তার পিতা কাফের নেতা ছিলেন। ইবনে ইসহাক আব্দুল্লাহ্কে ইথিওপিয়ায় দ্বিতীয় দফায় হিজরতকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেখান থেকে ফেরার পর তার পিতা তার উপর অনেক চাপ প্রয়োগ করেন, ফলে তিনি মুখে ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দেন। বদরের যুদ্ধে তিনি মুশরিকদের পক্ষ হয়ে লড়তে আসেন, কিন্তু বদরের ময়দানে এসেই মুসলমানদের পক্ষে চলে আসেন ও মহানবী (সা.)-এর সেবায় নিজেকে উপস্থাপন করেন; এ ঘটনায় তার পিতা অনেক ক্ষিপ্ত হয়। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি তার পিতাকে মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে নিরাপত্তার পাইয়ে দেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মহানুভবতায় সুহায়লও ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর সাথে সকল যুদ্ধেই অংশ নেন, ১২ হিজরিতে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে শাহাদাত বরণ করেন।

নবম সাহাবী হযরত ইয়াযিদ বিন হারেস (রা.), আনসারদের খাযরাজ বংশের বনু আমর বিন হারসা শাখার লোক ছিলেন। তার পিতার নাম হারেস বিন কায়েস ও মায়ের নাম ফুসম। তার এক ভাই আব্দুল্লাহ্ বিন ফুসম। মহানবী (সা.) যুশ শিমালাইন (সব্যসাচী) হযরত উমায়ের বিন আবদে আমর খুযায়ী-কে হযরত ইয়াযিদের ধর্মভাই বানান, তারা দু’জনই বদরের যুদ্ধে অংশ নেন ও শাহাদাত বরণ করেন।

দশম সাহাবী হযরত উমায়ের বিন হুমাম (রা.), আনসারদের খাযরাজ বংশের লোক ছিলেন। তার পিতা হুমাম বিন জামূহ ও মাতা নাওয়ার বিনতে আমের। রসূলুল্লাহ্ (সা.) উবায়দা বিন হারেস (রা.)-কে তার ধর্মভাই বানান হয়, দু’জনই বদরের যুদ্ধে শহীদ হন। হুযূর তার শাহাদাতের ঘটনা তুলে ধরেন, কারও কারও মতে তিনি ইসলামের ইতিহাসে আনসারদের মধ্য থেকে প্রথম শহীদ।

একাদশ সাহাবী হযরত হুমায়দ আনসারী (রা.), তিনিও বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর ফুফাতো ভাই হযরত যুবায়েরের সাথে তার ক্ষেতে সেচ দেওয়া নিয়ে কিছুটা মনোমালিন্য হয়েছিল।

দ্বাদশ সাহাবী হযরত আমর বিন মু’আয বিন নু’মান (রা.), তার পিতার নাম মু’আয বিন নু’মান ও মাতার নাম কাবশা বিনতে রাফে। আনসারদের অওস গোত্রের নেতা সা’দ বিন মুআয তার ভাই ছিলেন, তারা দু’ভাই একসাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের আপন ভাই উমায়ের বিন ওয়াক্কাস তার ধর্মভাই ছিলেন। আমর বিন মু’আয উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন, জিরার বিন খাত্তাব তাকে শহীদ করে; শাহাদাতের সময় তার বয়স ৩২ বছর ছিল। জিরার মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন।

আজ সবশেষ হুযূর যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করেন তিনি হলেন হযরত মাসউদ বিন রবীআ বিন আমর (রা.), কারা গোত্রের লোক ছিলেন; তার পিতার নাম রবীআ। হযরত মাসউদের পরিবারকে মদীনায় ‘ক্বারী’ অভিহিত করা হতো। তিনি দারে আরকাম যুগের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। হিজরতের পর মহানবী (সা.) তার ও হযরত উবায়েদ বিন তাইয়্যিহানের মাঝে ভ্রাতৃত্বসম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন। তিনি ৩০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সকল সাহাবীর মর্যাদা উন্নত করতে থাকুন, তাদের পুণ্যসমূহ যেন আমরাও বহমান রাখতে পারি। (আমীন)

এরপর হুযূর আগামী শুক্রবার থেকে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাজ্যের জলসা সালানার বিষয়ে সংক্ষেপে উল্লেখ করেন, হুযূর জলসার সার্বিকভাবে কল্যাণমন্ডিত হওয়ার জন্য দোয়া আহ্বান করেন যেন আল্লাহ্ তা’লা সবদিক থেকে এটিকে বরকতময় করেন। যাদের ডিউটি আছে, তাদেরকে হুযূর পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের উপদেশ দান করেন, আর দোয়াও করতে বলেন যেন আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে উত্তমরূপে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথিদের সেবা করার তৌফিক দান করেন। ইসলামাবাদের কেন্দ্র থাকায় এ বছর ট্রান্সপোর্ট বিভাগকে বেশি কাজ করতে হবে- সেটিও হুযূর স্মরণ করিয়ে দেন ও দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সবাইকে সব কাজ উত্তমরূপে সম্পন্ন করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)