শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২১-জুন, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২১ জুন, ২০১৯ টিলফোর্ডস্থ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত যায়েদ বিন হারসা (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি যায়েদ বিন হারেসা (রা.)-এর জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম আর এক্ষেত্রে বলেছিলাম যে, পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত যয়নাবের বিয়ে হয়েছিল; এ বিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার ছিল। বিয়ের সময় হযরত যয়নাব বিনতে জাহশের বয়স ছিল ৩৫ বছর, যা তখনকার দিনে মেয়েদের বেলায় আইবুড়ো বয়স বলেই গণ্য হতো। হযরত যয়নাব অত্যন্ত মুত্তাকী, পরহেযগার ও দানশীলা নারী ছিলেন; যে কারণে হযরত আয়েশা (রা.)’র সাথে তার প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও হযরত যয়নবের ব্যক্তিগত তাকওয়া ও পবিত্রতার তিনি ভূয়সী প্রসংশা করতেন। তিনি কেবল কিছুটা কড়া স্বভাবের মহিলা ছিলেন, রূঢ় আচরণের পর তৎক্ষণাৎ তিনি আবার অনুতপ্তও হতেন। মহানবী (সা.) একবার উম্মুল মুমিনীনদের বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে লম্বা, সে আমার মৃত্যুর পর সবচেয়ে দ্রুত আমার সাথে গিয়ে মিলিত হবে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এজন্য আমরা নিজেদের হাত মাপামাপি করতাম যে, কার হাত সবচেয়ে লম্বা। কিন্তু যখন যয়নাব (রা.) মহানবী পর সবার আগে মৃত্যুবরণ করেন তখন আমরা বুঝলাম, হাত বলতে মহানবী (সা.) দানশীলতার হাত বুঝিয়েছিলেন বাহ্যিক হাত নয়।

মহানবী (সা.) যখন হযরত যয়নাবকে বিয়ে করেন, তখন মুনাফিকরা প্রবল আপত্তি তোলে এবং প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করে যে, মহানবী (সা.) নিজ পুত্রবধূকে বিয়ে করে অপরাধ করেছেন। আসলে যেহেতু এই বিয়ের উদ্দেশ্যই ছিল আরবের এক ভ্রান্ত প্রথাকে রহিত করা, তাই এমন কটুবাক্য শোনাটাও অবধারিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য, ইবনে সা’দ ও তাবারী প্রমুখ হযরত যয়নাবের সাথে বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে একটি সম্পূর্ণ ভুল ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত লিপিবদ্ধ করেছে। যেহেতু এই বর্ণনাটি মহানবী (সা.)-এর পূত-পবিত্র সুমহান সত্ত্বার পরিপন্থী, তাই কোন কোন বিদ্বেষপরায়ণ খ্রিস্টান ঐতিহাসিক এই বর্ণনাটিতে আরো রঙ-চং মাখিয়ে খুবই জঘন্যভাবে উপস্থাপন করেছে।

বানোয়াট গল্পটি কিছুটা এরকম যে, একদিন মহানবী (সা.) যায়েদের সন্ধানে তার বাড়িতে যান। যায়েদ তখন বাড়িতে ছিলেন না, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর শব্দ শুনে যয়নাব তাড়াতাড়ি উঠে আসেন এবং তাঁকে (সা.) ভেতরে যেতে অনুরোধ করেন, তাড়াহুড়োয় তার গায়ে তখন ওড়না ছিল না। মহানবী (সা.) ভেতরে যেতে অসম্মতি জানান, কিন্তু ফেরত আসার সময় দরজা দিয়ে যয়নাবের ওপর তাঁর (সা.) দৃষ্টি পড়ে এবং তিনি তার সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন (নাউযুবিল্লাহ্)। বাড়িতে ফিরে যায়েদ একথা জানতে পেরে মহানবী (সা.)-এর সকাশে গিয়ে নিবেদন করেন যে, আপনার হয়তো যয়নাবকে ভালো লেগেছে, তাই আমি তাকে তালাক দিয়ে দিচ্ছি, আপনি তাকে বিয়ে করুন। মহানবী (সা.) তাকে বলেন, তাকে তালাক দিও না আর আল্লাহ্‌র তাক্‌ওয়া অবলম্বন কর। তবুও যায়েদ যয়নাবকে তালাক দিয়ে দেন। এটি হল ইবনে সা’দ ও তাবারীর বর্ণিত মিথ্যা গল্পের সারমর্ম।

হুযূর বলেন, ঘটনাটি যদি সত্যও হতো তবু এর সুন্দর ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল; কিন্তু আসল বাস্তবতা হল- এই গল্প আগাগোড়াই নির্জলা মিথ্যা ও বানোয়াট। যাবতীয় ইতিহাস আর যুক্তিও এর বিপরীত সাব্যস্ত হয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, এই ঘটনার বর্ণনাকারীরা প্রায় সবাই ওয়াকদি বা আব্দুল্লাহ্ বিন আমেরের বরাতে ঘটনাটি বর্ণনা করেছে, যারা গবেষকদের দৃষ্টিতে দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত। ওয়াকদির ভুল ও নির্জলা মিথ্যা বর্ণনার কথা ইতিহাসবিদদের কাছে সর্বজনবিদিত। এর বিপরীতে সহীহ্ বুখারীর সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, যাতে এটি বর্ণিত হয়েছে যে, যায়েদ (রা.) যয়নাবের দুর্ব্যবহার সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করে তাকে তালাক দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, এই সহীহ্ বুখারীর গ্রহণযোগ্যতা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার কাছেই অবিসংবাদিত। আর যৌক্তিকভাবেও যদি ভাবা হয় তবে ইবনে সা’দ প্রমুখের বর্ণনা ষোলআনাই ভুল সাব্যস্ত হয়। কেননা সবাই জানেন, যয়নাব মহানবী (সা.)-এর আপন ফুফাতো বোন ছিলেন, তিনি (সা.) স্বয়ং তার অভিভাবক হয়ে যায়েদের সাথে তাকে বিয়ে দেন, আর মুসলমান নারীদের জন্য তখনও পর্দার নির্দেশ অবতীর্ণ হয় নি, বরং যয়নাবের সাথে মহানবী (সা.)-এর বিয়ের পরই এই নির্দেশ নাযিল হয়- এমতাবস্থায় এই ধারণা করা যে, মহানবী (সা.) আগে কখনও তাকে দেখেন নি, বরং সেদিন তাকে একটুখানি দেখেই তার রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন- এটি এক নির্জলা মিথ্যা ও ভ্রান্ত ধারণা। আর যয়নাবের তাঁকে (সা.) ভেতরে আসতে অনুরোধ জানানোও সাব্যস্ত করে যে, তখন যয়নাবের গায়ে ওড়না না থাকলেও এতটুকু শালীন পোশাক অবশ্যই ছিল যে, মহানবী (সা.) ভেতরে যেতে পারতেন। আর এর পাশাপাশি যদি মহানবী (সা.)-এর পরম পবিত্র ও জগতবিমুখ জীবনাচারকে দৃষ্টিপটে রাখা হয়, তাহলে এই গল্পের অসারতা আরও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আর আল্লামা ইবনে হাজর, যুরকানী, ইবনে কাসীরসহ প্রসিদ্ধ সব ঐতিহাসিক এই রটনাকে নির্জলা মিথ্যা বলেই সাব্যস্ত করেছেন। এই বানোয়াট গল্প সম্পর্কে এটাও মনে রাখা দরকার, এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন মুনাফিকরা মদিনায় খুব জোরেশোরে ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনায় লিপ্ত ছিল। আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলের নেতৃত্বে তারা সংঘবদ্ধভাবে মিথ্যা গল্প রচনা করে বা সামান্য সত্যের সাথে শত-শত মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে মহানবী (সা.), তাঁর পরিবার ও নিকটজনদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে বেড়াত। এই ঘটনার কাছাকাছি সময়েই হযরত আয়েশা (রা.)’র বিরুদ্ধেও ইফকের জঘন্য মিথ্যা অপবাদ রটানো হয়েছিল। কুরআন শরীফে সূরা আহযাবের যে স্থানে যয়নাবের সাথে মহানবী (সা.)-এর বিয়ের উল্লেখ এসেছে, সেই একই স্থানে তাদের এরকম ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচারেরও উল্লেখ এসেছে।

হুযূর এ প্রসঙ্গে হযরত সাহেবযাদা মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.)-এর বরাতে ইসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম মূইরের জঘন্য অপবাদের, যা তিনি মহানবী (সা.)-এর অনিন্দ্যসুন্দর ও পূত:পবিত্র চরিত্রের ওপর আরোপ করেছে, সবিস্তারে এর খ-ন করেন।

ক্রীতদাস বা মুক্তকৃত দাসদের প্রতি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলানোর জন্য মহানবী (সা.) খুবই মনোযোগী ছিলেন। তিনি তাদের মধ্য থেকে যারা যোগ্য হতেন, তাদের সম্মান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় তাদেরকে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দিতেন। এজন্য অনেকবার তিনি যায়েদ বিন হারেসা (রা.) ও তার পুত্র উসামা বিন যায়েদ (রা.)-কে যুদ্ধাভিযানে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং বড় বড় ও সম্ভ্রান্ত সাহাবীদেরকে তাদের অধীনে রাখেন। এভাবেই একবার যখন উসামা বিন যায়েদের নেতৃত্ব নিয়ে কেউ কেউ আপত্তি করেন তখন তিনি (সা.) তাদেরকে এই উত্তরই দেন যে, আজ তোমরা সেভাবেই উসামার নেতৃত্ব নিয়ে আপত্তি তুলছ যেমনটি তার পিতা যায়েদের নেতৃত্ব নিয়ে তুলেছিলে; আল্লাহ্‌র কসম! যেভাবে যায়েদ নেতৃত্বের যোগ্য ও আমার প্রিয়তম ব্যক্তিদের একজন ছিল, উসামাও ঠিক সেভাবেই নেতৃত্বের যোগ্য ও আমার প্রিয়তম ব্যক্তিদের একজন। মহানবী (সা.)-এর এই উত্তরে সাহাবীগণ বুঝতে পারেন, ইসলামে কোন ব্যক্তির ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসের সন্তান হওয়া কিংবা বাহ্যত কোন নিচু বংশের সন্তান হওয়া তার উন্নতির পথে অন্তরায় হতে পারে না; প্রকৃত মানদণ্ড সবসময় হওয়া উচিত তাক্‌ওয়া ও ব্যক্তির যোগ্যতা। এরচেয়েও বড় কথা হল, মহানবী (সা.) যায়েদের সাথে নিজের আপন ফুফাতো বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন। আর পুরো কুরআন শরীফে কেবলমাত্র একজন সাহাবীরই নামের উল্লেখ এসেছে- আর তিনি হলেন, যায়েদ বিন হারেসা (রা.)।

হযরত যায়েদ (রা.) বদর, উহুদ, খন্দক, খায়বারের যুদ্ধ সহ হুদাইবিয়ার সন্ধিতেও অংশ নিয়েছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর দক্ষ তীরন্দাজদের মধ্যে গণ্য হতেন। খালিদ বিন ওয়ালীদের মত বড় বড় সেনাপতিও তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন। বনু মুস্তালিকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) যায়েদ বিন হারেসাকে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। বদরের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) যায়েদকে আগে পাঠিয়ে দেন, যেন তিনি গিয়ে সবাইকে যুদ্ধ-জয়ের সুসংবাদ প্রদান করতে পারেন। খন্দকের যুদ্ধের দিন মুহাজিরদের পতাকা তার হাতেই ছিল। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) যখনই কোন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করতেন যায়েদ বিন হারেসাকেও তাদের সাথে পাঠাতেন, তিনি (সা.) যায়েদকেই তাদের নেতা মনোনীত করে পাঠাতেন, যদি যায়েদ পরবর্তীতেও বেঁচে থাকতেন তবে তিনি (সা.) তাকেই নেতা বানাতেন। হুযূর বলেন, এই স্মৃতিচারণ আগামী খুতবায়ও চলবে, ইনশআল্লাহ্‌।

এরপর হুযূর জনাব মোবারক সিদ্দিকী সাহেবের মেয়ে স্নেহের মরিয়ম সালমান গুল সাহেবার জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন, যিনি গত ১৭ই জুন মাত্র ২৫ বছর বয়সে লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমা অল্প বয়সেই জামাতের অনেক সেবা করে গেছেন। তিনি তার জামাতের নও মোবাঈয়াত সেক্রেটারী ছিলেন। নবাগতা আহমদীরা এবং প্রতিবেশি ইংরেজ মহিলারাও তার আচার-ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হুযূর মরহুমার অসাধারণ গুণাবলীর সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং দোয়া করেন যে, আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি দয়া ও কৃপা করুন, তাকে স্বীয় ভালোবাসার চাদরে আবৃত করে রাখুন আর তার পদমর্যাদা উন্নত করুন, তার পাঁচ বছর ও দেড় বছর বয়সী শিশু কন্যাদ্বয়কে সর্বদা নিজ নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখুন আর তাদের অনুকূলে মায়ের সব দোয়া কবুল করুন; আল্লাহ্ তা’লা তার পিতা-মাতাকেও ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবল দান করুন। আর তার স্বামীকেও তৌফিক দিন যেন সে তার কন্যাদেরকে বাবা ও মা উভয়ের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলতে পারেন। (আমীন)