জুমুআর নামাযের গুরুত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩১-মে, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩১ মে, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় জুমুআর নামাযের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা জুমুআর ১০-১২ নং আয়াত তিলাওয়াত করেন ও আয়াতগুলোর অনুবাদ উপস্থাপন করেন। হুযূর বলেন, আজ এই রমযানের শেষ জুমুআ। সাধারণত এই দিনটিতে মানুষ বিশেষভাবে জুমুআয় উপস্থিতির ব্যাপারে মনোযোগ দিয়ে থাকে। সূরা জুমুআর শেষদিকের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা’লা জুমুআর গুরুত্ব সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে জুমুআর দিন যখন নামাযের জন্য আহ্বান করা হয় তখন কোন রকম আলস্য দেখিও না, বরং জুমুআকে গুরুত্ব দিয়ে তৎক্ষণাৎ নামাযের জন্য উপস্থিত হয়ে যাও। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন বা ব্যবসা ইত্যাদিতে যত লোকসানই হোক না কেন, সেগুলোর তোয়াক্কা করো না, কারণ তোমাদের জন্য জুমুআয় উপস্থিত হওয়া ও খুতবা শোনা তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা পার্থিব কাজ থেকে শত-সহস্রগুণে উত্তম। আর একইসাথে আল্লাহ্ তা’লা এ-ও বলে দিয়েছেন, জুমুআর নামাযের পর তোমরা স্বাধীন, তখন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য জাগতিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে যেতে পার, আল্লাহ্ তা’লা তোমাদের কাজে বরকত দান করবেন। কিন্তু নিজেদের ইবাদতকে কেবল জুমুআর মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখো না, বরং তোমাদের সর্বদা আল্লাহ্ তা’লাকে স্মরণ করা উচিত। এমনটি করলে আগের চেয়েও অনেকগুণ বেশি সাফল্য তোমরা লাভ করবে- ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও আর জাগতিক কাজের ক্ষেত্রেও। মোটকথা, সাফল্য আল্লাহ্ তা’লার ইবাদত ও তাঁর স্মরণের সাথেই সম্পৃক্ত। জুমুআর আবশ্যকতা, আল্লাহ্‌র ইবাদত ও তাঁর স্মরণে মগ্ন থাকা কেবল রমযানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জুমুআর গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে একস্থানে বলেন, জুমুআর দিন তো ঈদের দিন, বরং অন্যান্য ঈদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর; কেননা এই ঈদের জন্য সূরা জুমুআ নাযিল হয়েছে। হযরত উমর (রা.)-ও একবার এক ইহুদীকে এই কথা বলেছিলেন, জুমুআ মুসলমানদের জন্য ঈদ-ই বটে। তিনি (আ.) বলেন, কিন্তু অনেকেই এই ঈদের ব্যাপারে উদাসীন, যা আল্লাহ্ তা’লা প্রতি সপ্তাহে উদযাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন; বরং তারা ভাবে যে রমযানের শেষ জুমুআতে বিশেষ মনোযোগের সাথে উপস্থিত হলেই তারা সব জুমুআর পুণ্য পেয়ে যাব। তাই অনেক গুরুত্বের সাথে আমাদেরকে প্রতিটি জুমুআর ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হতে হবে। কিন্তু যেটা ঘটে তা হল- অনেকেই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না, বরং জাগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে জুমুআ ছেড়ে দেয়। অথচ আল্লাহ্ তা’লা বলছেন, তোমাদের জানা দরকার- যা আল্লাহ্‌র কাছে আছে, তা এসব জাগতিক বস্তু, বিত্ত-বৈভব ও কর্মকান্ড থেকে অনেকগুণ উত্তম, আর আল্লাহ্ তা’লাই সেই সত্ত্বা যিনি তোমাদের রিযক বা জীবনোপকরণ দান করেন। তাই এটি প্রত্যেক মুমিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; বিশেষভাবে আমরা যারা আহমদী হয়ে যুগের ইমামকে মান্য করেছি, আমাদের এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া আবশ্যক। কিন্তু কার্যত আমাদের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়টি ভুলে যায়, আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে কেন মেনেছিলাম। তিনি তো খোদা তা’লার সাথে আমাদের বন্ধন দৃঢ় করতে এসেছিলেন, সবকিছুর উপরে যেন আল্লাহ্‌ সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ভালবাসা লাভ করাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তিনি (আ.) তাকে গ্রহণ করার ফলে একজন আহমদীর অবস্থার উপমা দিতে গিয়ে বলেন, অন্যদের তুলনায় তোমাদের অবস্থা এতটুকু উন্নত যে তোমরা সেই ঝর্ণার নিকটে এসেছ যা চিরন্তন জীবন লাভের উৎস, কিন্তু এখনও সেই পানি এখনও তোমরা পান কর নি। তাই আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করে তাঁর করুণা ভিক্ষা কর যেন তিনি তোমাদের সিঞ্চিত করেন, কারণ তাঁর দয়া ছাড়া কিছুই হবে না। আর এই ঝর্ণা দ্বার সিঞ্চিত হবার উপায় হল, খোদা তা’লা যে দু’টি কর্তব্য অর্পণ করেছেন অর্থাৎ হুকুকুল্লাহ্ বা আল্লাহ্‌ অধিকার ও হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার, সেই দু’টি কর্তব্য পরিপূর্ণভাবে পালন কর।

মহানবী (সা.) জুমুআর গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তিনি (সা.) বলেন, জুমুআর দিন খুতবার মাঝে এমন একটি সময় আসে যখন বান্দা আল্লাহ্র কাছে যা-ই প্রার্থনা করে, তিনি তা কবুল করেন। আর এই মুহূর্তটি কোন নির্দিষ্ট একটি জুমুআতে আসে না, বরং প্রত্যেক জুমুআতেই আসে। তিনি (সা.) আরও বলেন, প্রত্যেক সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য জুমুআর দিন জুমুআর নামায পড়া আবশ্যক; ব্যতিক্রম হল অসুস্থ, মুসাফির, নারী, শিশু ও দাস, তাদের জন্য ছাড় রয়েছে। যে ব্যক্তি আমোদ-প্রমোদ বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য জুমুআকে উপেক্ষা করবে, আল্লাহ্ তা’লাও তাকে উপেক্ষা করবেন। তিনি (সা.) আরও বলেন, জুমুআর দিন পুণ্যের প্রতিদান কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি (সা.) এ-ও বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা কারণে জুমুআ পরিত্যাগ করে, তার আমলনামায় মুনাফিক লিখে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি অলসতা করে তিন জুমুআ পরিত্যাগ করে, আল্লাহ্ তা’লা তার হৃদয় মোহরাংকিত করে দেন। হুযূর (আই.) বলেন, এটি অত্যন্ত ভয়ের বিষয়, কারণ যখন হৃদয় মোহরাংকিত করে দেয়া হয়, তখন পুণ্য করার সৌভাগ্যও কমতে থাকে, আবার অনীহার সাথে জুমুআয় আসা হৃদয়ে মুনাফিকি বা কপটতা সৃষ্টি করে। তাই এটি অত্যন্ত ভয়ের বিষয় এবং খুবই মনোযোগের দাবী রাখে যেন আমরা নিজেদের অবস্থা আত্মবিশ্লেষণ করি। তিনি (সা.) একবার একথাও বলেছেন, নিয়মিত জুমুআয় আসবে, কারণ জুমুআ পরিত্যাগ করতে করতে একজন ব্যক্তি জান্নাতের যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাত্থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এই সমস্ত উপদেশবাণীতে তিনি (সা.) একবারও রমযানের শেষ জুমুআর কথা বলেন নি। আর শুধু জুমুআই নয়, বরং মহানবী (সা.) তো মুমিনের লক্ষণ এটি বর্ণনা করেছেন- মুমিন এক নামাযের পর পরবর্তী নামাযের অপেক্ষায় থাকে, এক জুমুআ থেকে পরবর্তী জুমুআর অপেক্ষায় এবং এক রমযান থেকে পরবর্তী রমযানের অপেক্ষায় থাকে। এটিই আমাদের জন্য আদর্শ ও মানদন্ড।

হুযূর বলেন, কেউ কেউ তার কাছে এসে অনুযোগ করে যে তারা অনেক দোয়া করেছে, কিন্তু দোয়া কবুল হয় নি। হুযূর বলেন, আমাদেরকে প্রতিটি বিষয়ের আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রাধান্য দিতে হবে। দেখা যায়, আমরা কখনো কখনো সাময়িক প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেই, আর যেটি চিরন্তন প্রয়োজন সেটিকে গৌণ মনে করি। দোয়া করার ক্ষেত্রেও এমনটি করা হয়, জাগতিক চাহিদা ইত্যাদির জন্য অনেক দোয়া করা হয়, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লাকে পাওয়ার জন্য, তাঁর ভালবাসা লাভের জন্য দোয়া করা হয় না। অথচ সূরা বাকারার ১৮৭নং আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা এই ইঙ্গিতই করেছেন, যারা আল্লাহ্‌র সন্ধানে রত ও তাঁর সন্তুষ্টি ও ভালবাসা লাভে ব্যাকুল হয়ে দোয়া করে, আল্লাহ্ তাদের সেই দোয়া কবুল করেন; আর দোয়া কবুল করানোর জন্য তাদেরও উচিত তারা যেন আল্লাহ্‌র কথা ও নির্দেশ মান্য করে ও তাঁর উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। শুধুমাত্র জাগতিক বস্তুর প্রয়োজন হলেই আল্লাহ্‌কে ডাকা, আর সেই মনোবাসনা পূর্ণ না হলে অনুযোগ করা যে ‘আমরা অনেক দোয়া করেছি কিন্তু তা কবুল হয় নি’- একেবারে অর্থহীন অভিযোগ। হ্যাঁ, যদি পবিত্র পরিবর্তন আনয়ন করে আল্লাহ্ তা’লাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুলচিত্তে দোয়া করে, তবে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, আমি অবশ্যই সেই দোয়া শুনব এবং তার বন্ধু হয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াব ও তার ইচ্ছাসমূহ পূরণ করব, তার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে পেয়ে যায়, পৃথিবীর যাবতীয় কল্যাণরাজিও তার পদতলে এসে জমা হয়। তাই বান্দার কাজ হল আল্লাহ্ তা’লার সব কথা মান্য করা। বছরে কেবল একটি দিন ইবাদত করাকেই যেন সে যথেষ্ট মনে না করে, রমযানের শেষ জুমুআকেই কেবল গৃহীত হওয়ার মাধ্যম মনে না করে। হুযূর বলেন, আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার উপর পূর্ণ ভরসা রাখি ও কখনও আল্লাহ্ তা’লার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করি; যদি আমরা এমনটি করি তবে প্রকৃত অর্থে হেদায়েতপ্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য হব, যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন যে তিনি তাদের বন্ধু ও অভিভাবক হয়ে যান এবং তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করেন। আমরা যারা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মান্য করেছি, আমাদের দায়িত্ব হল- আমরা যেন নিজেদের ইবাদতের মান উন্নত করি, এই রমযান মাসে যে মানে উন্নীত হয়েছি বা হওয়ার চেষ্টা করেছি- তাত্থেকে যেন নিজেদের অবনমন হতে না দেই; নিজেদের নামাযের মানকেও উন্নত করতে থাকি, আমাদের জুমুআর উপস্থিতিও যেন বজায় থাকে, আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশাবলী মান্যকারী যেন হই, আর বিশেষভাবে আমরা যেন সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হই যারা আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য দোয়া করেন, আমাদের নামায ও ইবাদত যেন আল্লাহ্ তা’লার দর্শন-লাভকারী নামায ও ইবাদত হয়; আল্লাহ্ তা’লা সর্বদা আমাদেরকে এই মান অর্জনের তৌফিক দান করুন। (আমীন)