শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-মে, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩রা মে, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত উবায়েদ বিন আবু উবায়েদ আনসারী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন নোমান বিন বালদামা (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমায়ের (রা.), হযরত আমর বিন হারেস (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কা’ব (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কায়েস (রা.), হযরত সালামা বিন আসলাম (রা.), হযরত উকবা বিন উসমান (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সাহল (রা.), হযরত উতবা বিন রবীআ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজ আমি যেসব বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তাদের মধ্যে প্রথম নাম হল হযরত উবায়েদ বিন আবু উবায়েদ আনসারী (রা.), তিনি অওস গোত্রের বনু উমাইয়া শাখার লোক ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন নুমান বিন বালদামা (রা.), তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের আবু খুনাস শাখার লোক ছিলেন। তিনি হযরত আবু কাতাদার চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

তৃতীয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমায়ের (রা.), তিনি বনু জিদারা গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

চতুর্থ সাহাবী হযরত আমর বিন হারেস (রা.), তিনি বনু হারেস গোত্রের লোক ছিলেন। তার ডাকনাম ছিল আবু নাফে। তিনি প্রাথমিক যুগে মক্কাতে ইসলাম গ্রহণ করেন ও ইথিওপিয়ার দ্বিতীয় হিজরতে অংশ নেন।

পঞ্চম সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কা’ব (রা.), তিনি বনু মা’যান গোত্রের লোক ছিলেন। আবু লায়লা মা’যানী তার ভাই ছিলেন। বদরের দিন মহানবী (সা.) তাকে মালে গণিমতের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন, এছাড়া আরও অনেক যুদ্ধেই মহানবী (সা.) তাকে এই দায়িত্ব দান করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন। তিনি হযরত উসমানের খিলাফতকালে মদীনায় ৩৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন, হযরত উসমান (রা.) তার জানাযা পড়ান।

পরবর্তী সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কায়েস (রা.), তিনি বনু নাজ্জার গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। এক বর্ণনামতে তিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। অন্য বর্ণনামতে তিনি সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন ও হযরত উসমানের খিলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।

সপ্তম যে সাহাবীর হুযূর স্মৃতিচারণ করেন তার নাম হযরত সালামা বিন আসলাম (রা.), তিনি বনু হারসা গোত্রের লোক ছিলেন। আবু সা’দ ছিল তার ডাকনাম। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথী ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে সায়েব বিন উবায়েদ ও নুমান বিন আমরকে বন্দী করেন। হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ইরানীদের সাথে হওয়া জিসরের যুদ্ধ বা পুলের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৩১ বছর। বদরের যুদ্ধে তার তলোয়ার ভেঙে গেলে মহানবী (সা.) তার হাতে একটি খেজুরের শাখা দিয়ে সেটি দিয়ে যুদ্ধ করতে বলেন। তিনি সেটি হাতে নিলে তা এক মজবুত তলোয়ারে পরিণত হয় এবং সারা জীবন তিনি সেটি দিয়ে যুদ্ধ করেন। মহানবী (সা.)-কে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আবু সুফিয়ান ভাড়াটে খুনী দিয়ে তাঁকে হত্যা করানোর চেষ্টা করেছিল। এই উদ্দেশ্যে সে এক বেদুঈন যুবককে মদীনায় পাঠায়। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে দেখেই মন্তব্য করেন, এই ব্যক্তি কোন বদ-মতলবে এসেছে। সেই বেদুঈন ত্বরিৎবেগে মহানবী (সা.)-এর উপর আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু হযরত উসায়েদ বিন হুযায়ের (রা.) তাকে ধরে ফেলেন এবং তার কাছে থাকা খঞ্জরও পেয়ে যান। তখন সে এই শর্তে সব সত্য স্বীকার করে যে তাকে প্রাণে হত্যা করা হবে না। যখন মহানবী (সা.) সব ষড়যন্ত্র জানতে পারেন তখন আমর বিন উমাইয়া যামরী ও সালামা বিন আসলাম (রা.)-কে তথ্য সংগ্রহের জন্য মক্কায় প্রেরণ করেন। আর কুরায়শদের কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাদেরকে এই অনুমতিও দিয়ে পাঠিয়েছিলেন যে যদি সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তারা এসব জঙ্গী শত্রুদের হত্যা করতে পারেন। কিন্তু কুরায়শরা আগেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল, আর এরা দু’জন কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসেন। ফেরার পথে মক্কার দু’জন গুপ্তচরের সাথে তাদের দেখা হয়ে যায়; সাহাবীরা তাদের বন্দী করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা আক্রমণ করে বসে এবং তাদের একজন সাহাবীদের হাতে নিহত ও অপরজন বন্দী হয়। কারও মতে এই ঘটনা ৪র্থ হিজরিতে ঘটে, কারও মতে এই ঘটনা ৬ষ্ঠ হিজরির। হুদাইবিয়ার সন্ধির দিন হযরত আব্বাদ বিন বিশর ও হযরত সালামা বিন আসলাম মহানবী (সা.)-এর প্রহরায় ছিলেন।

এরপর হুযূর হযরত উকবা বিন উসমান (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন, তিনি আনসারদের বনু যুরায়ক গোত্রের লোক ছিলেন। সা’দ বিন উসমান তার ভাই ছিলেন। তারা উভয়েই বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। তাদের সম্বন্ধে জানা যায় যে তারা উহুদের যুদ্ধের দিন কাফেরদের তীব্র আক্রমণের মুখে পিছু হটে অন্যত্র পলায়ন করেন, পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে তা জানান। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দেন, এই কাজের জন্য জবাবদিহিতা চান নি।

পরবর্তী সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সাহল (রা.); তার মায়ের নাম সা’বা বিনতে তাইয়্যিহান, তিনি হযরত আবুল হাইসাম বিন তাইয়্যিহানের বোন ছিলেন। হযরত রাফে বিন সাহল তার ভাই ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ আকাবার বয়আত ও বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে তার ভাই রাফে বিন সাহলও তার সাথে ছিলেন। তিনি খন্দকের যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত আব্দুল্লাহ্ ও তার ভাই রাফে হামরাউল আসাদের অভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন। হুযূর (আই.) প্রাসঙ্গিকভাবে হামরাউল আসাদের অভিযানের বিষয়টিও সংক্ষেপে তুলে ধরেন। উহুদের যুদ্ধে মুশরিকরা বাহ্যত বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু তাদের সাথে কোন যুদ্ধবন্দী বা মালে গণিমত ছিল না। এজন্য কতিপয় কুরায়শ নেতা বলছিল, আমাদের এই সুযোগেই মদীনায় আক্রমণ করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া উচিত। তবে অন্য কয়েকজন নেতার মত ছিল, এটুকু বিজয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত, ফিরে গিয়ে হামলা করতে গিয়ে আবার পরাজিত হয়ে সম্পূর্ণ সম্মান খোয়ানোর কোন দরকার নেই। অবশেষে তারা পুনরায় ফিরে গিয়ে মদীনায় আক্রমণেরই সিদ্ধান্ত নেয় এবং মদীনা থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে শিবির স্থাপন করে। এদিকে মহানবী (সা.)-ও তাদের দূরভিসন্ধির বিষয়ে আভাস পেয়ে নির্দেশ দেন, উহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়া প্রত্যেক ব্যক্তি যেন পুনরায় যুদ্ধের জন্য তাঁর (সা.) সাথে রওয়ানা হয়, অন্য কেউ যেন সাথে না আসে। মহানবী (সা.) অগ্রসর হয়ে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। যখন আব্দুল্লাহ্ বিন সাহল ও রাফে বিন সাহল এই অভিযানের বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ শুনতে পান, তখন এক ভাই অপরজনকে বলেন, ‘আল্লাহ্র কসম! যদি আমরা এই যুদ্ধাভিযানে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে অংশ নিতে না পারি, তবে তা অনেক বড় বঞ্চনার কারণ হবে।’ তারা দু’জনই আহত ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তারা রওয়ানা হন। বাহন না থাকায় পায়ে হেঁটেই তারা যাত্রা করেন, পথিমধ্যে রাফে বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আব্দুল্লাহ্ তাকে কাঁধে করে এগিয়ে নিয়ে যান। এভাবে অতিকষ্টে তারা হামরাউল আসাদে পৌঁছেন। মহানবী (সা.) যখন সব বৃত্তান্ত জানতে পারেন তখন তাদের মঙ্গলের জন্য দোয়া করেন ও বলেন, বেঁচে থাকলে তোমরা অনেক উট, ঘোড়া, খচ্চর ইত্যাদি বাহন পাবে, কিন্তু সেসব যাত্রা কক্ষনো তোমাদের আজকের এই সফরের মত পুণ্যময় হবে না। পরবর্তীতে কাফেররা যখন মুসলমানদের এই অভিযানের বিষয়ে জানতে পারে, তখন তারা ভয়ে তাড়াতাড়ি মক্কার দিকে হাঁটা দেয় এবং মদীনায় আক্রমণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে।

সবশেষে হুযূর হযরত উতবা বিন রবীআ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি ইয়ারমূকের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যতম নেতা ছিলেন, যাদের অধীনে সৈন্যদলকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর ইয়ারমূকের যুদ্ধের বিষয়েও সংক্ষেপে বর্ণনা করেন, যা ১৩ হিজরিতে রোমানদের সাথে হয়েছিল। রোমান বাহিনী ছিল আড়াই লাখের, আর মুসলমান বাহিনীর সংখ্যা ৩৬ হাজার বা ৪০ হাজার ছিল। দীর্ঘ সময়ের এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুসলমান বাহিনী জয়ী হয়, এক লক্ষের বেশি রোমান নিহত হয় ও মোট তিন হাজার মুসলমান এতে শহীদ হন। এই যুদ্ধের পর পুরো সিরিয়া প্রায় অনায়াসেই মুসলমানদের করতলগত হয়।

খুতবার শেষাংশে হুযূর মোকাররমা সাহেবযাদী সাবিহা বেগম সাহেবার গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন, যিনি মির্যা বশীর আহমদ সাহেবের দৌহিত্রি, সাহেবযাদা মির্যা রশীদ আহমদ সাহেবের মেয়ে, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) ও উম্মে নাসের সাহেবার পুত্র সাহেবযাদা মির্যা আনওয়ার আহমদ সাহেবের স্ত্রী ছিলেন; গত ৩০ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে তাহের হার্ট ইনস্টিটিউশনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সম্পর্কে তিনি হুযুরের মামী ছিলেন। হুযূর মরহুমার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তার বংশধররা যেন তার আদর্শ অনুসরণ করতে পারে সেজন্য দোয়া করেন। (আল্লাহুম্মা আমীন)