শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-এপ্রিল, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৬শে এপ্রিল, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত উসমান বিন মাযউন (রা.) ও হযরত ওয়াহাব বিন সা’দ বিন আবি সারহ্ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, বিগত খুতবায় আমি হযরত উসমান বিন মাযউন (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একথা বলে শেষ করেছিলাম যে, তিনি জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত প্রথম ব্যক্তি।

হুযূর এ প্রসঙ্গে জান্নাতুল বাকীর গোড়াপত্তনের ইতিহাস তুলে ধরেন। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় আগমনের সময় সেখানে অনেক কবরস্থান ছিল, ইহুদীসহ প্রত্যেক গোত্রেরই পৃথক পৃথক কবরস্থান ছিল। তবে সব কবরস্থানের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো কবরস্থান ছিল বাকীউল গারকাদ, যা মহানবী (সা.) পরে মুসলমানদের কবরস্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন; এটিই জান্নাতুল বাকী নামে পরিচিতি পায় আর একটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। মহানবী (সা.) আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশেই এটিকে নির্বাচন করেন। এই কবরস্থানে প্রচুর গারকাদ বা বক্সথর্ন (একপ্রকার কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়) ও অন্যান্য আগাছা জন্মাত, মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়ের আখড়া ছিল। হযরত উসমান বিন মাযউনই ছিলেন সেখানে সমাহিত প্রথম মুসলমান। মহানবী (সা.) তার কবরের মাথার কাছে চিহ্নস্বরূপ একটি পাথর রেখে দেন আর বলেন, সে আমাদের অগ্রদূত। এরপর যখনই কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ করতো এবং রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে তাকে কোথায় দাফন করা হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা চাইলে তিনি (সা.) বলতেন, আমাদের অগ্রদূত উসমান বিন মাযউনের কাছে তাকে সমাহিত করো।

হযরত উসমান বিন মাযউনের মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) তার শবদেহের কাছে আসেন এবং বলেন, “হে আবু সায়েব! আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন। তুমি এমন অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছ যে, পৃথিবীর কোন জিনিস তোমাকে দূষিত করতে পারে নি।” মহানবী (সা.) তার লাশের কপালে চুমু খান এবং তাঁর (সা.) চোখ দিয়ে তখন এত অশ্রু ঝরছিল যে, তা হযরত উসমানের গালের ওপর পড়তে থাকে। মহানবী (সা.)-এর সাহেবযাদা হযরত ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) বলেছিলেন, আমাদের প্রয়াত পুণ্যবান প্রিয়জন উসমান বিন মাযউনের সান্নিধ্যে যাও। হযরত উসমান বিন আফফান বর্ণনা করেন, হযরত উসমান বিন মাযউনের জানাযা মহানবী (সা.) চার তকবীরে পড়িয়েছেন। তাকে দাফন করার সময় মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে একটি পাথর তুলে আনতে বলেন। কিন্তু পাথর ভারী হওয়ায় তিনি তা উঠাতে পারেন নি। তখন মহানবী (সা.) স্বয়ং নিজের জামার আস্তিন গুটিয়ে স্বহস্তে সেই পাথর তুলে আনেন এবং তার সমাধির শিয়রের কাছে রাখেন।

হযরত উসমান বিন মাযউনের মৃত্যুতে তার স্ত্রী অত্যন্ত আবেগপূর্ণ শোকগাথা রচনা করেন। হযরত উম্মে আলা, যিনি এক আনসারী মুসলিম রমনী ছিলেন, তিনি বলেন, যখন মুহাজিররা কে কার বাড়িতে থাকবে- এই বিষয়ে লটারি করা হয়, তখন হযরত উসমান বিন মাযউন আমাদের ভাগে পড়েন। তিনি আমাদের কাছে থাকেন; যখন তিনি অসুস্থ হন, আমরা তার সেবা-শুশ্রূষা করি। তিনি মৃত্যুবরণ করলে আমরা তাকে তার পরিহিত পোশাকেই দাফন করি। তার মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) আমাদের কাছে আসেন। আমি বললাম, হে আবু সায়েব, আপনার ওপর আল্লাহ্‌র রহমত বর্ষিত হোক! আপনার ব্যাপারে আমার সাক্ষ্য হল- আল্লাহ্ অবশ্যই আপনাকে সম্মানিত করেছেন।’ মহানবী (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে, আল্লাহ্ তা’লা তাকে অবশ্যই সম্মানিত করেছেন? উম্মে আলা বলেন, আমি জানি না, এটি আমার আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মহানবী (সা.) বলেন, “উসমান তো এখন মারা গিয়েছে, আর আমি তার ব্যাপারে ভালো কিছুরই আশা রাখি; কিন্তু আল্লাহ্‌র কসম! আমি নিজে আল্লাহ্‌র রসূল হওয়া সত্ত্বেও এটি জানি না যে, উসমানের সাথে কী হবে।” উম্মে আলা বলেন, ভবিষ্যতে তিনি কখনো আর এমনটি বলবেন না। সেদিন রাতে তিনি যখন ঘুমান, তখন তিনি স্বপ্নে একটি প্রবাহমান ঝর্ণা দেখেন আর তাকে বলা হয়- এটি উসমানের ঝর্ণা। তিনি মহানবী (সা.)-কে স্বপ্নের কথা বলেন; মহানবী (সা.) ব্যাখ্যা করে বলেন, এটি তার কর্মের ঝর্ণা যা জান্নাতে প্রবাহমান। এটি ছিল মহানবী (সা.)-এর তরবীয়তের রীতি যে, ধারণাবশে কারও ব্যাপারে আল্লাহ্‌র ক্ষমা লাভের বিষয়ে জোরালো সাক্ষ্য দিয়ে দিও না; কিন্তু যখন স্বপ্নে আল্লাহ্ তা’লা তার মর্যাদার বিষয়টি দেখিয়ে দেন তখন তিনি (সা.) সেটির সত্যায়নও করেছেন। নতুবা মহানবী (সা.) তো জানতেন যে, আল্লাহ্ তা’লা বদরী সাহাবীদের প্রতি সন্তুষ্ট; আর তিনি (সা.) নিজেও তার জন্য যেভাবে দোয়া করেছেন বা আবেগ দেখিয়েছেন তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তার ব্যাপারে এরূপই আশা রাখতেন। কিন্তু তবুও তিনি শিখিয়েছেন, কারও ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে পার না। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা ক্রমাগত তার মর্যাদা উন্নত করতে থাকুন আর তার পুণ্য-আদর্শ আমরাও যেন নিজেদের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে পারি-সেই তৌফিক দান করুন। (আমীন)

হুযূর এরপর হযরত ওয়াহাব বিন সা’দ বিন আবি সার্‌হ্‌ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সা’দ, তিনি বনু আমের বিন লুআই গোত্রের লোক ছিলেন। মুরতাদ হয়ে যাওয়া কাতেবে ওহী আব্দুল্লাহ্ বিন সা’দ বিন আবি সার্‌হ্‌ তারই ভাই ছিল। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর আব্দুল্লাহ্‌র মুরতাদ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ও পরবর্তীতে তাকে পুনরায় ক্ষমা করে দিয়ে মুসলমান হওয়ার সুযোগ দেয়ার ঘটনাও বর্ণনা করেন। হযরত ওয়াহাব মদীনায় হিজরতের সময় কুলসুম বিন হিদমের বাড়িতে অবস্থান করেন। মহানবী (সা.) তার ও হযরত সুয়াইদ বিন আমরের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেন। তারা দু’জনই মূতার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। হযরত ওয়াহাব বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৮ম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে মূতার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন, শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল ৪০ বছর।

প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর মূতার যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও তুলে ধরেন। মূলত বসরার শাসকের কাছে প্রেরিত মহানবী (সা.)-এর দূত হযরত হারেস বিন উমায়েরকে মূতায় রোমান রাজ্যের একজন আমীর শারাহবিল বিন আমরকে অকারণে অন্যায়ভাবে হত্যা করার কারণেই মূতার যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মহানবী (সা.) হযরত যায়েদ বিন হারসার ওপর নেতৃত্ব ভার অর্পণ করেন ও বলে দেন, তিনি মৃত্যুবরণ করলে যেন যথাক্রমে হযরত জাফর ও হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা নেতৃত্ব দেন; তাদের তিনজনের মৃত্যু হলে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ স্বয়ং নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন আর আল্লাহ্ তা’লা তার হাতে বিজয় দান করেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এই সাহাবীদের মর্যাদা সর্বদা উন্নত থেকে উন্নততর করতে থাকুন। (আমীন)

এরপর হুযূর জামাতের কয়েকজন নিষ্ঠাবান সেবকের স্মৃতিচারণ করেন, যারা সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। প্রথম জানাযা মুরব্বী সিলসিলাহ্ শ্রদ্ধেয় মালেক মোহাম্মদ আকরাম সাহেবের, যিনি ২৫শে এপ্রিল যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার জানাযাটি উপস্থিত জানাযা; বাকি জানাযাগুলো গায়েবানা জানাযা। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে জামাতের মুবাল্লিগ শ্রদ্ধেয় চৌধুরী আব্দুশ শাকুর সাহেবের জানাযা। যিনি গত ১২ই এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। তারপরে রয়েছেন শ্রদ্ধেয় মালেক সালেহ মোহাম্মদ সাহেব, মুয়াল্লিম ওয়াকফে জাদীদ, যিনি ২১শে এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। এরপরে রয়েছেন তাঞ্জানিয়ার শ্রদ্ধেয় ওয়েশে জুমা সাহেব, যিনি গত ১৩ই মার্চ ইন্তেকাল করেন। হুযূর প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তাদের অসাধারণ সব গুণাবলীর উল্লেখ করেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ। হুযূর মরহুমদের বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা তাদের পদমর্যাদা উন্নীত করুন এবং তাদের বংশধরদেরকেও তাদের গুণাবলী নিজেদের মাঝে ধারণ করার তৌফিক দান করেন। (আল্লাহুম্মা আমীন)