শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৫-এপ্রিল, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৫ই এপ্রিল, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত খিরাশ বিন সিম্মাহ্ আনসারী (রা.), হযরত উবায়েদ বিন তায়্যিহান (রা.), হযরত আবু হান্না মালেক বিন আমর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ্ বিন যায়েদ বিন সা’লাবা (রা.), হযরত মুআয বিন আমর বিন জমূহ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি প্রথম যে বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তার নাম হল, হযরত খিরাশ বিন সিম্মাহ্ আনসারী (রা.), তিনি খাযরাজ গোত্রের শাখা বনু জুশমের সদস্য ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন; উহুদের যুদ্ধে তার শরীরে দশটি আঘাত লাগে। তিনি মহানবী (সা.)-এর দক্ষ তীরন্দাজদের একজন ছিলেন। বদরের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর জামাতা আবুল আসকে তিনি বন্দী করেছিলেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, হযরত উবায়েদ বিন তায়্যিহান (রা.), তার মায়ের নাম ছিল লায়লা বিনতে আনীক। তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আবুল হাইসাম বিন তায়্যিহানের ভাই ছিলেন, তারা দু’ভাই একসাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। হযরত উবায়েদ উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন, ইকরামা বিন আবু জাহল তাকে শহীদ করে। অন্যান্য বর্ণনামতে তিনি সিফফীনের যুদ্ধে হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তার দুই পুত্র আব্বাদ ও উবায়দুল্লাহ্; আব্বাদ নিজেও বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, আর উবায়দুল্লাহ্ ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত আবু হান্না মালেক বিন আমর (রা.); আবু হান্না ছিল তার ডাকনাম, আসল নাম হল, মালেক বিন আমর। মুহাম্মদ বিন উমর ওয়াকদি তাকে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গণ্য করেছেন।

এরপর হুযূর যার স্মৃতিচারণ করেন তার নাম হল, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ বিন সা’লাবা (রা.); তার পিতার নাম ছিল যায়েদ বিন সা’লাবা আর তিনিও সাহাবী ছিলেন। তিনি খাযরাজের শাখা বনু জুশমের সদস্য ছিলেন। তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে অংশ নেন; তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ অন্যান্য যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্ব হতেই তিনি আরবী লিখতে জানতেন। তার ভাই হুরায়েস বিন যায়েদও মুসলমান ছিলেন ও বদরী সাহাবী ছিলেন, তার এক বোন কুরায়বাও সাহাবীয়া ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ সেই সাহাবী, যাকে স্বপ্নে আযানের বাক্যগুলো শেখানো হয়েছিল; তিনি মহানবী (সা.)-কে তা অবগত করলে মহানবী (সা.) হযরত বেলালকে সেই অনুসারেই আযান দিতে বলেন। যখন হযরত বেলাল (রা.) আযান দেন, তা শুনে হযরত উমর (রা.) দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসেন এবং আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে বলেন যে, তিনিও স্বপ্নে ঠিক এই বাক্যগুলোই আযানের জন্য শুনেছেন।

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) যখন আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদের স্বপ্নের কথা শুনেন তখন বলেন, এই শব্দগুলো তাঁকেও (সা.) ওহী করে জানানো হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ নিজের শেষ সম্বলটুকুও সদকা করে দিয়েছিলেন, যা তার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল। যখন মহানবী (সা.) তা জানতে পারেন, তিনি (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদকে ডেকে বলেন, আল্লাহ্ তোমার সদকা কবুল করে নিয়েছেন, এখন এটি উত্তরাধিকার হিসেবে তোমার বাবা-মাকে লিখে দাও। ফলে পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদের সন্তানরা উত্তরাধিকারী হিসেবে এর মালিকানা সত্ত্ব লাভ করেন। বিদায় হজ্জের সময় মিনায় মহানবী (সা.) কুরবানীর পর সাহাবীদের মধ্যে মাংস উপহারস্বরূপ বিতরণ করেন। কিন্তু কয়েকজন সাহাবী এত্থেকে অংশ পান নি। মহানবী (সা.) নিজের মাথা কামিয়ে ও নখ কেটে সেগুলোও উপহার হিসেবে বিতরণ করে দেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ নবীজী (সা.)-এর নখ উপহার হিসেবে লাভ করেন।

হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন এক ব্যক্তি এসে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল (সা.)! আল্লাহ্‌র কসম! নিশ্চয়ই আপনাকে আমি আমার নিজের প্রাণ, পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের চেয়েও অনেক বেশি ভালবাসি। বাড়িতে ছিলাম, আপনার কথা মনে পড়লে আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, আপনার কাছে ছুটে এলাম। কিন্তু যখন আপনার ইন্তেকাল হবে, তখন আপনি তো জান্নাতে অনেক ঊর্ধ্বে অন্যান্য নবীদের সাথে থাকবেন। আমার ভয় হয়, আমি মারা গেলে তো জান্নাতে এত উর্ধ্বে স্থান পাব না আর আপনার দেখাও পাব না! মহানবী (সা.) তার একথার কোন উত্তর দেন নি, তখন জীব্রাঈল (আ.) সূরা নিসার ৭০ নং আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হন, যার অর্থ হল, “যে আল্লাহ্ ও এই রসূলের (সা.) আনুগত্য করে, তারা সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদেরকে আল্লাহ্ পুরস্কার প্রদান করেছেন, অর্থাৎ নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও পুণ্যবানদের মধ্যে।”

হুযূর (আই.) বলেন, এই আয়াতটি মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যে তার উম্মতের মধ্য থেকে শরীয়তবিহীন নবুওয়তের মর্যাদা লাভের সম্ভাবনার একটি অকাট্য দলিল, যা উম্মতের পূর্ববর্তী বুযূর্গ ও আলেমগণও বর্ণনা করেছেন। হযরত ইমাম রাগেবও উপরোক্ত আয়াতের এই অর্থই করেছেন যে, মহানবী (সা.)-এর পর তাঁর অনুসরণে শরীয়তবিহীন নবী আসতে পারেন।

আল্লামা যুরকানীর মতে উল্লিখিত ঘটনায় বর্ণিত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ ছিলেন। মহানবী (সা.) যখন ইন্তেকাল করেন, তখন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ বাগানে কাজ করছিলেন। তার ছেলে এসে তাকে মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের সংবাদ দেন। তিনি তখন দোয়া করেন, হে আল্লাহ্! আমার দৃষ্টি নিয়ে নাও, যেন আমি আমার প্রিয় মুহাম্মদ (সা.)-এর পর আর কাউকে দেখতে না পাই! অতঃপর এমনটিই ঘটে অর্থাৎ তিনি ক্রমান্বয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং অন্ধ হয়ে যান। অনেকের মতে তিনি উহুদের যুদ্ধের পর ইন্তেকাল করেন কিন্তু বেশিরভাগের মত হল তিনি ৩২ হিজরিতে ৬৪ বছর বয়সে হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন, হযরত উসমান (রা.) তার জানাযা পড়ান। এবং তাকে জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত করা হয়।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত মুআয বিন আমর বিন জমূহ (রা.); তার পিতা আমর বিন জমূহও মহানবী (সা.)-এর সাহাবী ছিলেন, যিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত মুআয আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। তার পিতা শুরুতে কট্টর মুশরিকদের দলভুক্ত ছিলেন। তিনি মুসলমান হবার পর মদীনার আরও কয়েকজন যুবকের সাথে মিলে গোপনে মদীনার প্রতিমাগুলো ধ্বংস করার কাজ করতেন। তার পিতা আমর বিন জমূহ বাড়িতে কাঠের একটি মূর্তি রাখতেন; মুআয প্রতিরাতে সেই মূর্তিটি আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতেন, আর তার পিতা পরদিন সেটিকে তুলে এনে ধুয়ে-মুছে যথাস্থানে রাখতেন, যদিও তিনি জানতেন না কে এই কাজ করছে। কয়েকদিন এমনটি হওয়ার পর রাতে আমর বিন জমূহ মূর্তির গলায় তরবারি ঝুলিয়ে দিয়ে মূর্তিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আজও যদি কেউ তোমার সাথে এমন করতে আসে, তবে তুমি তাকে প্রতিহত করো। যা হওয়ার তা-ই হল, মূর্তিকে আবারও বাইরে ফেলে দেয়া হল। এই ঘটনার পর আমর বিন জমূহ্’র চোখ খুলে যায়, তিনি বুঝতে পারেন- আসলে এই মূর্তির কোন ক্ষমতাই নেই। অতঃপর তিনি র্শিক থেকে বিরত হন ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, বদরের যুদ্ধে আবু জাহলকে হত্যাকারীদের মধ্যে মুআযও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন; বর্ণিত হয়েছে, মুআয বিন আমর ও মুআয বিন আফরা আবু জাহলকে রণক্ষেত্রে আক্রমণ করে হত্যা করেন, পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ তার শিরোচ্ছদ করেন। তবে অন্যান্য বর্ণনায় মুআয বিন আমরের পরিবর্তে মুআয বিন আফরা ও তার ভাই মুআওভেয বিন আফরার নামও এসেছে। সকল বর্ণনা একত্র করে প্রণিধান করলে বুঝা যায় যে, আবু জাহলের ওপর প্রথমে আক্রমণ করেন মুআয বিন আমর ও মুআয বিন আফরা, পরবর্তীতে মুআওভেযও আক্রমণ করেন, সবশেষে আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ তার শিরোচ্ছেদ করেন। তিনি হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে ইন্তেকাল করেন, হযরত উসমান তার জানাযা পড়ান ও জান্নাতুল বাকীতে তাকে সমাহিত করেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার মহানবী (সা.) বলেন, মুআয বিন আমর বিন জমূহ কতই না উত্তম ব্যক্তি!

হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এসব ব্যক্তির প্রতি সহস্র সহস্র রহমত ও কৃপা বর্ষণ করুন, যারা আল্লাহ্ তা’লা ও তাঁর রসূলের (সা.) প্রেমে বিভোর হয়ে তাঁর সন্তোষভাজন হয়েছেন। (আল্লাহুম্মা আমীন)

খুতবার শেষ দিকে হুযূর শ্রদ্ধেয় মালেক সুলতান হারুন খান সাহেবের গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন, যিনি গত ২৭শে মার্চ ইসলামাবাদে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমের বড় পুত্র খলীফাতুল মসীহ্ রাবের ছোট জামাতা ছিলেন। তিনি জন্মগত আহমদী ছিলেন, তার পিতা কর্ণেল মালেক সুলতান মুহাম্মদ খান সাহেব মাত্র ২৩ বছর বয়সে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর হাতে বয়আত করেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও নবাব পরিবারের সন্তান ছিলেন, জমিদার ছিলেন তারা। তার অজস্র অসাধারণ গুণাবলী সম্পর্কে হুযূর নাতিদীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি কৃপা ও ক্ষমার আচরণ করুন এবং তার সন্তানদেরও তার পুণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন এবং জামাত ও খিলাফতের সাথে দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার তৌফিক দিন। (আমীন)