শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৯-মার্চ, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৯শে মার্চ, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত তুলায়ব বিন উমায়ের (রা.), হযরত সালেম মওলা আবু হুযায়ফা (রা.) ও হযরত ইতবান বিন মালেক (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি প্রথম যে বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তার নাম হল, হযরত তুলায়ব বিন উমায়ের (রা.); তার মা আরওয়া হযরত আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ও মহানবী (সা.)-এর ফুফু ছিলেন, অর্থাৎ হযরত তুলায়েব মহানবী (সা.)-এর ফুফাতো ভাই ছিলেন। হযরত তুলায়ব দ্বারে আরকাম যুগের, অর্থাৎ একেবারে প্রাথমিক যুগের মুসলমান ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি বাড়িতে গিয়ে তার মাকে যখন বয়আত গ্রহণের কথা জানান, তখন তার মা তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বলেন, আমাদের মহিলাদেরও যদি পুরুষদের মত শক্তি ও প্রভাব থাকত, তাহলে আমরাও তাঁর (সা.) অনুসরণ ও সুরক্ষা করতাম। হযরত তুলায়ব মাকে বলেন, আপনার হৃদয়ে যখন এরূপ গভীর স্পৃহা আছে, তখন আপনিও কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন না? আপনার ভাই হামযাও তো মুসলমান হয়ে গিয়েছেন! তার মা বলেন, আমি একটু দেখি আমার বোনেরা কী করে। হযরত তুলায়ব তার মাকে আল্লাহ্‌র দোহাই দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার ও কলেমা শাহাদাতের ঘোষণা দেয়ার অনুরোধ করেন, তখন তার মা কলেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করেন।

হযরত তুলায়ব মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি মহানবী (সা.)-কে অপমান করার কারণে কোন মুশরিককে মেরে আহত করেন। কেউ গিয়ে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করলে তিনি পাল্টা জবাব দেন, তুলায়ব তার মামাতো ভাইকে সাহায্য করেছে। হযরত তুলায়ব প্রথমবার ইথিওপিয়ায় হিজরত করেছিলেন; পরবর্তীতে কুরাইশরা মুসলমান হয়ে গিয়েছে এমন গুজব শুনে মক্কায় ফেরত আসেন, পরে মদীনায় হিজরত করেন। মহানবী (সা.) হযরত মুনযের বিন আমরকে তার ধর্মভাই বানিয়েছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ১৩ হিজরিতে সিরিয়ায় রোমানদের সাথে সংঘটিত আজনাদায়ন-এর যুদ্ধে যোগদান করেন ও শাহাদত বরণ করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত সালেম মওলা আবু হুযায়ফা (রা.); তার পিতার নাম মা’কেল, যিনি ইরানের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে গণ্য হতেন। তিনি হযরত আবু হুযায়ফার স্ত্রী সুবায়তার দাস ছিলেন, হযরত সুবায়তা তাকে স্বত্বহীনভাবে মুক্ত করে দেন। হযরত আবু হুযায়ফা তাকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, এজন্য সবাই তাকে সালেম বিন আবু হুযায়ফা ডাকত। কিন্তু যখন আল্লাহ্ তা’লা এরূপ করার ব্যাপারে কুরআনে নিষেধাজ্ঞা নাযিল করেন, তখন থেকে তিনি সালেম মওলা আবু হুযায়ফা নামে পরিচিত হন। তিনি ক্বারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন; তিনি সেই চারজন সাহাবীর একজন ছিলেন যাদের কাছ থেকে মহানবী (সা.) সবাইকে কুরআন শিখতে বলতেন। বাকিরা ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ, উবাই বিন কা’ব ও মুআয বিন জাবাল (রা.)। হযরত সালেম অত্যন্ত সুললিত কন্ঠে কুরআন পাঠ করতেন। উহুদের যুদ্ধে কাফিরদের পাথরের আঘাতে মহানবী (সা.) আহত ও রক্তাক্ত হলে হযরত সালেম সেই ক্ষতস্থান ধোয়ার বা পরিস্কার করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

হুযূর বলেন, হযরত সালেম মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা নিয়ে আমাদের সবারই গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত ও আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত। মহানবী (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন এমন কিছু লোকও থাকবে, যাদের পুণ্য ‘তিহামা পর্বতে’র সমান হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাদের পুণ্যগুলোকে বিনষ্ট করে দিয়ে তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। হযরত সালেম প্রশ্ন করেন, আমাদেরকে তাদের লক্ষণাবলীও বলুন যেন তাদেরকে চিনতে পারি; আল্লাহ্‌র কসম, আমার তো ভয় হয় আমি না আবার তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই! তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, তারা অনেক নামায-রোযা পালনকারীও হবে আর অনেক রাত জেগে ইবাদতকারীও হবে; কিন্তু যখন তাদের সামনে কোন হারাম বা নিষিদ্ধ বস্তু উপস্থাপন করা হবে তখন তারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হুযূর (আই.) বলেন, অর্থাৎ তারা পার্থিব বস্তুর লোভ সামলাতে পারবে না; প্রত্যেকেরই এই হাদীসের কথাগুলো সর্বদা খুব গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত ও নিজের অবস্থা যাচাই করা উচিত, আল্লাহ্ তা’লা সবাইকে এর তৌফিক দান করুন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর তার এক পুত্রের নাম হযরত সালেমের নামানুসারে ‘সালেম’ রেখেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বর্ণনা করেন, কোন এক যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর কতিপয় সাথী ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। আমি অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে দেখলাম হযরত সালেম সম্পূর্ণ শান্তভাবে নির্ভিকচিত্তে অস্ত্রহাতে এগিয়ে যাচ্ছেন; আমিও তার পিছু পিছু এগোতে থাকলাম এবং মহানবী (সা.)-এর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। মহানবী (সা.) ভীত মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন; তিনি (সা.) বলেন, ‘হে লোকেরা, তোমাদের এ কী অবস্থা! তোমাদের কি এই দু’জনের মত সাহস প্রদর্শন করার সাধ্য নেই?’

মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) ছোট ছোট সৈন্যদল আশে-পাশের গোত্রগুলোর প্রতি প্রেরণ করেন; তাদের দায়িত্ব ছিল ইসলামের বাণী পৌঁছানো ও তবলীগ করা, যুদ্ধ করা নয়। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে বনু জাযিমা গোত্রে পাঠানো হয়। সেই গোত্রের লোকেরা খালিদকে দেখা মাত্র হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, কিন্তু তিনি তাদেরকে নিরস্ত হতে বলেন যে, যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই। একথা শুনে সবাই অস্ত্র রেখে দিলেও জাহদম নামক একজন বলল, ‘আমি অস্ত্র হাতছাড়া করব না; ইনি হল খালিদ- আমি তাকে বিশ্বাস করি না। অস্ত্র সমর্পণ করলেই বন্দী হতে হবে ও মরতে হবে।’ কিন্তু অন্যরা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করায়। তখন খালিদ তাদের কয়েকজনকে হত্যা করেন ও কয়েকজনকে বন্দী করে সাহাবীদেরকে দেন ও পরদিন নিজ নিজ বন্দীকে হত্যা করতে বলেন। কিন্তু হযরত সালেম বলেন, তিনি বা অন্য সাহাবীরা কেউই এমনটি করবেন না। একজন সাহাবী গিয়ে মহানবী (সা.)-কে সবকিছ খুলে বলেন। মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন, কেউ কি তার এই কাজের বিরোধিতা করে নি? জানানো হয় যে হযরত সালেম ও আব্দুল্লাহ্ বিন উমর বিরোধিতা করেছেন, এমনকি সালেমের সাথে খালিদের উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়ও হয়েছে। মহানবী (সা.) তখন হযরত আলীর হাতে অনেক ধন-সম্পদ দিয়ে সেখানে পাঠান যেন তিনি আরবের প্রচলিত রীতি অনুসারে এই অনভিপ্রেত ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় করেন। হযরত আলী যথাযথভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে এসে মহানবী (সা.)-কে জানান। মহানবী (সা.) পুরো বিবরণ শুনেন ও হযরত আলীর কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন; এরপর কা’বামুখী হয়ে তিনবার এই দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! খালিদ যে অপরাধ করেছে, আমি তা থেকে তোমার কাছে দায়মুক্তি প্রার্থনা করছি।’ মহানবী (সা.) শুধু খালিদের কাজটিকে অন্যায় বলেই আখ্যা দেন নি বা এত্থেকে নিজের দায়মুক্তি ঘোষণা করেন নি, বরং এর যথাযথ ক্ষতিপূরণও পরিশোধ করেছেন। যদিও সেই গোত্রের অনেকেই ইসলামের শত্রু ছিল, তদুপরি মহানবী (সা.) তাদের প্রতি অন্যায় বা অবিচার করাকে কোন অবস্থাতেই সমর্থন করেন নি। হযরত সালেম ১৩ হিজরিতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খিলাফতকালে ইয়ামামার যুদ্ধে পরম বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে শাহাদত বরণ করেন।

পরবর্তী সাহাবী হযরত ইতবান বিন মালেক (রা.), তিনি খাযরাজ গোত্রের বনু সালেম বিন অওফ শাখার লোক ছিলেন। মহানবী (সা.) হযরত উমরকে তার ধর্মভাই বানিয়েছিলেন। তিনি বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ নেন। আমীর মুআবিয়ার যুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তিনি ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। যখন তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে নিজের বাড়ীতে নামায পড়ার অনুমতি চান। কিন্তু মহানবী (সা.) অনুমতি প্রদান করেন নি; বরং বলেন, তুমি আযান তো শুনতে পাও, তাহলে ঘর থেকে মসজিদ পর্যন্ত একটি রশি টানিয়ে নাও, সেটি ধরে ধরে মসজিদে চলে আসবে। পরবর্তীতে তিনি পুনরায় আবেদন করেন যে, তিনি নিজ ঘরেই নামায সেন্টার বানাতে চান, মহানবী (সা.) যেন তার ঘরে গিয়ে একটি স্থানে নামায পড়ে আসেন যেখানে তিনি নামায সেন্টার বানাবেন। তখন মহানবী (সা.) তাকে অনুমতি প্রদান করেন ও নিজে গিয়ে সেই স্থানে নামায পড়ে তা উদ্বোধন করে আসেন। এই ঘটনা থেকে সাব্যস্ত হয়, বৈরি পরিস্থিতিতে বা বাধ্য-বাধকতার কারণে বাড়িতে নামায পড়লেও তা বাজামাত পড়া আবশ্যক।

হুযূর (আই.) বলেন, এই নির্দেশনা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে ও পালন করতে হবে। যারা মসজিদ থেকে দূরে বসবাস করেন তাদেরও কয়েকটি পরিবার মিলে একস্থানে বাজামাত নামায পড়ার ব্যবস্থা করা উচিত। হুযূর দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন। প্রথমজন হলেন রাবওয়ার শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা আওয়ান সাহেব যিনি গত ১৬ই মার্চ ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, দ্বিতীয়জন শ্রদ্ধেয়া আমাতুল হাই সাহেবা, যিনি ১৫ই মার্চ রাবওয়াতে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের আত্মিক মর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সবরে জামীলের দোয়া করেন। (আমীন)