শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৫-জানুয়ারি, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৫শে জানুয়ারি, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত তোফায়েল বিন হারেস (রা.), হযরত সুলায়ম বিন আমর আনসারী (রা.), হযরত সুলায়ম বিন হারেস আনসারী (রা.), হযরত সুলায়ম বিন মিলহান আনসারী (রা.), হযরত সুলায়ম বিন কায়েস (রা.), হযরত সাবেত বিন সা’লাবা (রা.), হযরত সিমাক বিন সা’দ (রা.), হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ্ বিন রিআব (রা.), হযরত মুনযেব বিন আমর বিন খুনায়েস (রা.), হযরত মা’বদ বিন আব্বাদ (রা.), হযরত আবী বিন আবী যাগবা আনসারী (রা.), হযরত রবী বিন আইয়াস (রা.), হযরত উমায়ের বিন আমের আনসারী (রা.), হযরত সা’দ বিন খওলী (রা.), হযরত আবু সিনান বিন মেহসান (রা.), হযরত কায়েস বিন আল্ সাকান (রা.), হযরত আবুল ইয়াসের কা’ব বিন আমর (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি যেসব বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব, তাদের মধ্যে প্রথমে রয়েছেন, হযরত তোফায়েল বিন হারেস (রা.)। তিনি কুরায়শ বংশোদ্ভূত ছিলেন। মদীনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) হযরত মুনযের বিন মুহাম্মদকে তার ধর্মভাই বানিয়ে দেন, অন্যান্য বর্ণনানুসারে সুফিয়ান বিন নসর ছিলেন তার ধর্মভাই। হযরত তোফায়েল (রা.) তার ভাই হযরত উবায়দা ও হুসায়নের সাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। উহুদ এবং খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই তিনি মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন। ৩২ হিজরিতে ৭০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, হযরত সুলায়ম বিন আমর আনসারী (রা.), তিনি খাযরাজ গোত্রের শাখা বনী সালামার সদস্য ছিলেন। তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন ও উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত সুলায়ম বিন হারেস আনসারী (রা.), তিনি খাযরাজের শাখা বনু দিনারের সদস্য ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন এবং উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

এরপরে রয়েছেন হযরত সুলায়ম বিন মিলহান আনসারী (রা.)। তার মা ছিলেন মালায়কা বিনতে মালেক, তিনি হযরত আনাস বিন মালেকের মামা ছিলেন। তিনি তার আপন ভাই হারাম বিন মিলহানের সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন; আর তারা উভয়ে বি’রে মউনার ঘটনায় শহীদ হন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত সুলায়ম বিন কায়েস (রা.), তার মা ছিলেন উম্মে সুলায়ম বিনতে খালেদ এবং বোন খওলা বিনতে কায়েস, যিনি হযরত হামযার স্ত্রী ছিলেন। বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই তিনি অংশ নিয়েছিলেন। হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত সাবেত বিন সা’লাবা (রা.); তার মা উম্মে উনাস বিনতে সা’দ। তার পিতা সা’লাবা বিন যায়েদকে সাহসিকতার জন্য ‘আল-জিযআ’ বলে ডাকা হতো, পিতার মত তাকেও ‘আল-জিযআ’ ডাকা হতো। তার দুই ছেলে- আব্দুল্লাহ্ ও হারেস। তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে অংশগ্রহণকারী ৭০ জন আনসারের একজন ছিলেন। বদর, উহুদসহ অন্যান্য সকল যুদ্ধ এবং হুদাইবিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের অভিযানে যোগদান করেন; তায়েফের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন এবং তায়েফের যুদ্ধের দিনই শাহাদাত বরণ করেন।

আরেক সাহাবী হলেন, হযরত সিমাক বিন সা’দ (রা.), তার পিতা সা’দ বিন সা’লাবা। হযরত নু’মান বিন বশীরের পিতা বশীর বিন সা’দের ভাই ছিলেন, তার সাথেই বদরের যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি উহুদের যুদ্ধেও অংশ নেন।

আরেকজন সাহাবী হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ বিন রিআব (রা.)। তিনি সেই ছয়জন সাহাবীর একজন ছিলেন যারা হিজরতের পূর্বেই মক্কায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। বাকি পাঁচজন হলেন, হযরত আসাদ বিন যুরারাহ্ (রা.), অওফ বিন হারেস (রা.), রাফে বিন মালেক বিন আজলান (রা.), কুতবা বিন আমের বিন হাদীদাহ্ (রা.) ও উকবা বিন আমের বিন নাবী (রা.)। তাদের বয়আত গ্রহণের ঘটনার বিবরণ ইতোপূর্বে হযরত উকবা বিন আমের বিন নাবী (রা.)-এর স্মৃতিচারণের সময়ও করা হয়েছে, আজও হুযূর সংক্ষেপে সেটি তুলে ধরেন। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ বদর, উহুদ ও খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত মুনযের বিন আমর বিন খুনায়েস (রা.), তার উপাধি ছিল ‘মু’নিক বিল মওত’ বা ‘মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী’। খাযরাজ গোত্রের শাখা বনু সা’য়েদার লোক ছিলেন। মহানবী (সা.) হিজরতের পর হযরত তুলায়ব বিন উমায়েরকে তার ধর্মভাই বানিয়েছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, বি’রে মউনার সফরে তিনি ৭০জনের প্রতিনিধি দলের আমীরের দায়িত্ব পালন করেন এবং শহীদ হন। বি’রে মউনার ঘটনার সময় মুশরিকরা তাকে তাদের সাথে আপোষের মাধ্যমে নিজের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ দিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি শাহাদাতকেই বরণ করে নিয়েছিলেন, সেজন্য তাকে ‘মু’নিক বিল মওত’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। শাহাদতের সময় তার মুখ নিঃসৃত শেষ বাক্য ছিল, ‘আল্লাহ্ আকবর, ফুযতু বিরব্বিল ক্বাবা’। ইতিহাস থেকে এটিও জানা যায় যে, শাহাদতের পর মহানবী (সা.) তার ত্যাগের মহিমাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার ভাতিজা উসায়েরের নাম রাখের মুনযের।

হুযূর (আই.) ‘সীরাত খাতামান্নাবীঈন’ পুস্তক এবং বুখারীর হাদীসের আলোকে বি’রে মউনার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত মা’বদ বিন আব্বাদ (রা.), তার পিতার নাম আব্বাদ বিন কুশায়র। তিনি খাযরাজের শাখা বনু সা’লেম বিন গানামের লোক ছিলেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন।

আরেকজন সাহাবী হযরত আবী বিন আবী যাগবা আনসারী (রা.), তার পিতার নাম ছিল, সিনান বিন সুবীহ্। হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন।

আরেকজন সাহাবী হযরত রবী বিন আইয়াস (রা.), তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের শাখা বনু লু’যানের সদস্য ছিলেন। বদরের যুদ্ধে তিনি তার অপর দু’ভাই ওয়ারকা বিন আইয়াস ও আমর বিন আইয়াসের সাথে অংশ নেন, উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।

আরেকজন সাহাবী হযরত উমায়ের বিন আমের আনসারী (রা.); তার পারিবারিক নাম ছিল আবু দাউদ, এই নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তার পিতার নাম আমের বিন মালেক। তিনি খাযরাজ গোত্রভুক্ত ছিলেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন। হযরত আবু দাউদ ও সুলায়েত বিন আমর আকাবার বয়আতে অংশ নেয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছিলেন, কিন্তু রওয়ানা হয়ে জানতে পারেন লোকজন ইতোমধ্যেই বয়আত করে ফেলেছেন। তখন তারা হযরত আসাদ বিন যুরারাহ্-এর মাধ্যমে বয়আত করেন। বদরের যুদ্ধে হযরত উমায়ের বিন আমর (রা.)’ই আবুল বখতরীকে হত্যা করেছিলেন বলে প্রসিদ্ধ আছে।

আরেকজন সাহাবী হযরত সা’দ বিন খওলী (রা.), তিনি হযরত হাতেব বিন আবি বালতাআর মুক্তকৃত দাস ছিলেন। কারও কারও মতে তিনি অনারব ও পারস্যবংশীয় ছিলেন। হযরত হাতেব তার সাথে খুবই সদ্ব্যবহার করতেন। হযরত সা’দ হযরত হাতেবের সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন ও উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন।

আরেকজন সাহাবী হযরত আবু সিনান বিন মেহসান (রা.), পিতার নাম মেহসান বিন হুরসান। আবু সিনান তার পারিবারিক নাম, আসল নাম ছিল ওয়াহাব বিন মেহসান। তিনি হযরত উকাশা বিন মেহসানের বড় ভাই ছিলেন। তার পুত্র সিনান বিন আবু সিনান (রা.)। বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ৫ম হিজরিতে বনু কুরায়যার অবরোধের সময় ৪০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ও বনু কুরায়যার কবরস্থানেই সমাহিত হন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত কায়েস বিন আল্ সাকান (রা.); তার পিতার নাম সাকান বিন যাহুরা, খাযরাজ গোত্রের শাখা বনু আদী বিন নাজ্জারের সদস্য ছিলেন। তার পারিবারিক নাম আবু যায়েদ, এ নামেই তিনি সুপরিচিত ছিলেন। বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় যে চারজন আনসারী সাহাবী কুরআন সংকলনের কাজ করেন, তাদের একজন ছিলেন হযরত কায়েস; অপর তিনজন হলেন, যায়েদ বিন সাবেত, মুআয বিন জাবাল ও উবাই বিন কা’ব। হযরত কায়েস হযরত আনাসের চাচা ছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে ৮ম হিজরীতে তবলীগের জন্য ওমানে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি হযরত উমরের যুগে ইরানিদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন।

আরেকজন সাহাবী হযরত আবুল ইয়াসের কা’ব বিন আমর (রা.); আবুল ইয়াসের ছিল তার ডাক নাম। তিনি বনু সালামার লোক ছিলেন, পিতার নাম ছিল আমর বিন আব্বাদ। তিনি আকাবার বয়আতের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। শীর্ণকায় হওয়া সত্ত্বেও বদরের দিন তিনি হযরত আব্বাসের মত স্থুলদেহীকে বন্দী করেছিলেন এক অচেনা ফিরিশতার সাহায্যে। সেদিন আবু আযীয বিন উমায়েরের হাত থেকে মুশরিকদের পতাকা তিনি-ই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। অন্যান্য যুদ্ধেও মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন। সিফফীনের যুদ্ধেও তিনি হযরত আলীর পক্ষে লড়াই করেছেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর নির্দেশানুসারে তার দাসের সাথে অত্যন্ত সদ্ব্যবহার করতেন। নিজে যা খেতেন দাসকেও তাই খাওয়াতেন আর নিজে যা পরিধান করতেন তাকেও তাই পরিধান করাতেন। অনুরূপভাবে দরিদ্র ঋণগ্রস্তের ঋণ মওকুফ করে দেয়ারও অসাধারণ ঘটনা তার রয়েছে। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। আমীর মুয়াবিয়ার যুগে ৫৫ হিজরিতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর সাহাবীরা অনন্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তাঁরা আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার সাথে বিশ্বস্ততা রক্ষার রীতিও শিখিয়েছেন, কীভাবে আল্লাহ্ তা’লাকে ভয় করতে হয় তা-ও শিখিয়েছেন; মহানবী (সা.)-এর বাণী কীভাবে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে গ্রহণ করে পরিপূর্ণ আনুগত্য করতে হবে, সেটিও শিখিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের মর্যাদা ক্রমশ উন্নত করুন। (আমীন)