বিনয়াবনত ব্যক্তিত্ব: সাহেবযাদা মির্যা আনাস আহমদ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২১-ডিসেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২১শে ডিসেম্বর, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সদ্য প্রয়াত জামাতের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সাহেবযাদা মির্যা আনাস আহমদ সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, জামাতের সদস্যরা তার মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়ে এত বেশি চিঠি-পত্র লিখেছে যে, আজকের খুতবায় আমি কেবল তাঁর স্মৃতিচারণ করব বলেই মনস্থ করেছি। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.) জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন সাহেবযাদা মির্যা আনাস আহমদ সাহেব, কয়েকদিন পূর্বে ৮১ বছর বয়সে তিনি রাবওয়ায় ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর সবচেয়ে বড় পৌত্র ছিলেন; হযরত নওয়াব মোবারেকা বেগম সাহেবা ও নওয়াব মোহাম্মদ আলী খান সাহেবের দৌহিত্র ছিলেন, সম্পর্কের দিক থেকে তিনি আমার মামাতো ভাই ছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা কাদিয়ানে শুরু করলেও রাবওয়াতে গিয়ে তিনি মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন, পরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। আল্লাহ্‌র কৃপায় ১৯৫৫ সালে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন এবং ১৯৬২ সাল থেকে কর্মজীবন শুরু করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে তিনি জামাতের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন।

হুযূর (আই.) বলেন, হাদীস শাস্ত্র, দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যে তার সুগভীর পাণ্ডিত্য ছিল। হাদীসের ব্যাপারে তার খুবই আগ্রহ ছিল, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আগ্রহে মোহতরম মৌলভী খুরশিদ আহমদ সাহেবের কাছ থেকে তিনি হাদীসের পাঠ গ্রহণ করেন। বাড়িতে তার নিজস্ব পাঠাগার ছিল, সেখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য ও বই রয়েছে। পড়াশোনার গভীর শখ ছিল তার। কোন ছাত্র যদি কোন বিষয়ে দিক-নির্দেশনার জন্য তার কাছে আসত তাহলে তিনি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য ও উপদেশ দিয়ে তাদের সাহায্য করতেন। যখন তিনি জীবন উৎসর্গ করেন তখন হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) স্বয়ং সেটির উল্লেখ করে তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন, “ওয়াক্‌ফে যিন্দেগীর জন্য আমি তাহরীক করার পর যে তিনটি আবেদন পেয়েছি, তার মধ্যে একটি হল, আসার পৌত্র স্নেহের মির্যা আনাস আহমদের।” তিনি আল্লাহ্‌র কৃপায় ৫৬ বছর জামাতের বিভিন্ন বিভাগে গ্রহণীয় সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। প্রথম পদায়ন হয় তার তা’লীমুল ইসলাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে। ১৯৭৫ সনে নায়েব নাযের ইসলাহ ও ইরশাদ হন, পরে এডিশনাল নাযের ইসলাহ ও ইরশাদ হন, খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী হিসেবে তিনি ইউরোপ সফরে দায়িত্ব পালন করেছেন। জামেয়া আহমদীয়ার প্রশাসক হিসেবে সেবা করারও সুযোগ লাভ করেছেন, নাযের তা’লীমও ছিলেন কয়েক বছর, নায়েব নাযের দিওয়ানও ছিলেন। তাহরীকে জাদীদের ওকীলুত তসনীফ ছিলেন, ১৯৯৯ সালে ওকীলুল ইশায়াত নিযুক্ত হন। বয়স অনুসারে ৯৭ সালে তিনি যদিও অবসরপ্রাপ্ত হন, কিন্তু কার্যতঃ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সেবা করার সুযোগ লাভ করেছেন। তিনি খোদ্দামুল আহমদীয়া এবং আনসারুল্লাহ্‌র কেন্দ্রীয় পর্যায়েও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। বারাহীনে আহমদীয়া ও মাহমুদ কি আমীন-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন যা প্রকাশিত হয়েছে, ইদানিং সুরমা চশমায়ে আরিয়া, ইযালায়ে আওহাম ও দুররে সমীনের অনুবাদ রিভিশনের কাজ করছিলেন। নাসের ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, মজলিসে ইফতা ও নূর ফাউন্ডেশনের বোর্ড মেম্বার ছিলেন, মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বলের উর্দু অনুবাদের কাজও তিনি করছিলেন।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) রাবওয়াতে হিজরতের সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে তার নাম উল্লেখ করেছিলেন। হিজরতের পরপর জামাতের আর্থিক দুরাবস্থার কারণে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র নির্দেশ ছিল, লঙ্গরখানায় সবাইকে মাথাপিছু যেন একটি করে রুটি দেয়া হয়, খান্দানের সদস্যরাও মাথাপিছু একটি করেই রুটি পাবে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, “একদিন আমার বড় পৌত্র মির্যা আনাস আহমদ কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসে, একটি রুটিতে নাকি তার ক্ষুধা মেটে না”। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তখন বলে দেন, “যতদিন অবস্থার উন্নতি না হয়- তাকে আমার ভাগের রুটি থেকে অর্ধেক দিয়ে দিও, আমি অর্ধেক রুটি খেয়ে পার করব”। হুযূর (আই.) বলেন, যদিও এ ঘটনায় মির্যা আনাস আহমদ সাহেবের নাম এসেছে কিন্তু আসল কুরবানী ছিল হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র।

মরহুমের জামাতা মির্যা ওয়াহিদ আহমদ সাহেব বর্ণনা করেন, “একবার আমি বুখারা ও সমরকন্দ সফরে যাচ্ছিলাম, তখন মির্যা আনাস আহমদ সাহেব আমাকে বলেন, ইমাম বুখারীর কবর যিয়ারত করবে আর সেখানে আমার পক্ষ থেকে দোয়া করবে ও সালাম পৌঁছাবে”। এটি ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রতি তার গভীর ভালোবাসার প্রমাণ। কেননা, ইমাম বুখারীর কারণে আমরা মহানবী (সা.)-এসব নির্দেশ ও ঘটনা জানতে পেরেছি, তাই তিনি আমাদের দোয়া ও সালামের হকদার।

ডা. নূরী সাহেব বর্ণনা করেন, “তাকে যে কাজই দেয়া হতো, পরম আগ্রহ ও স্পৃহার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে সেই কাজ সমাধা করতেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও হাসপাতালের বিছানায় বসে ল্যাপটপে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকাবলীর অনুবাদের কাজ করতে থাকতেন। প্রায়ই বলতেন, আমার কেবল এতটুকুই ইচ্ছা যে, যুগ-খলীফা আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, আল্লাহ্‌র সাহায্যে সেই কাজ যেন শেষ করতে পারি। সদা ধৈর্যশীল এক ব্যক্তি ছিলেন। চরম কষ্টের সময়ও দর্শনার্থীদের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করতেন”। তার স্নেহশীলতার কথা বলতে গিয়ে তার এক ভাগ্নে বলেন, “যদি তিনি কখনো কাউকে সদুপদেশ দেয়ার পর মনে করতেন যে, যাকে উপদেশ দেয়া হয়েছে সে এতে কষ্ট পেয়েছে; তখন সঠিক কথা বলা সত্ত্বেও তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতেন”।

মরহুমের অধীনে যারা কাজ করেছেন তাদের মন্তব্য হল, তিনি প্রত্যেকের সাথে অত্যন্ত নম্র, কোমল ও ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। বয়সে ও জ্ঞানে যারা তার চেয়ে অনেক ছোট, তাদের সাথেও অত্যন্ত বন্ধু-সুলভ আচরণ করতেন; ঘুণাক্ষরেও নিজ আচরণে এটি প্রকাশ করতেন না যে, তিনি বয়সে বা জ্ঞানে তাদের চেয়ে বড়। খিলাফতের প্রতি অসাধারণ বিশ্বস্ততা ও শ্রদ্ধা ছিল। প্রায়শঃই সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাইতেন, হুযূর (আই.) তার কাজে সন্তুষ্ট কি-না। খিলাফতের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা পেলে সেটিকে শিরোধার্য করতেন, নিজের মতামতকে সেটির তুলনায় তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। মোবাল্লিগদের খুবই সম্মান করতেন, তাদেরকে দিক-নির্দেশনাও প্রদান করতেন। হাফেয মোজাফফর আহমদ সাহেব বলেন, মিয়াঁ সাহেব অজস্র গুণের অধিকারী ছিলেন; খোদাভীরু, খোদাপ্রেমিক, রসূলপ্রেমিক, কুরআন-প্রেমিক, সহজ-সরল, দয়ার্দ্র এক ব্যক্তি ছিলেন। আল্লাহ্‌র অধিকার প্রদানের পাশাপাশি বান্দার অধিকার প্রদানের বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। গরীব সাহায্যপ্রার্থীকে কখনো খালি হাতে ফেরাতেন না, ধার করে হলেও তাকে সাহায্য করতেন। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাবলী ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সেই একবার সম্পূর্ণ পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, এরপর সারা জীবন সেগুলো বারংবার পড়েছেন। জ্ঞানপিপাসু এক ব্যক্তি ছিলেন, সারা জীবন জ্ঞানচর্চা করেছেন। মহানবী (সা.) যে বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর- এই নির্দেশ পালন করার এক বিমূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। সিহাহ্ সিত্তাহ্‌র জামাতি অনুবাদ ও ব্যাখ্যার জন্য হুযূর (আই.) যখন একটি বোর্ড গঠন করেন, তখন মিয়াঁ সাহেবকেও এর সদস্য নিযুক্ত করা হয়, আর তিনি মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বলের অনুবাদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন যা ছিল সবচেয়ে কষ্টসাধ্য ও দুরূহ কাজ। সারা জীবন তিনি নিজ অধীনস্তদের সাথেও কোমল ব্যবহার করেছেন, তাদের কোনরকম কষ্ট বা অসুবিধা দেখলে তাদেরকে জোর করে ছুটি ও বিশ্রাম দিয়ে দিতেন, অথচ নিজে গুরুতর অসুস্থাবস্থায়ও অফিসে হাজির হতেন। যদি কখনো অফিসে আসতে না পারতেন তাহলে বাসাতেই কাজ করতে থাকতেন, এমনকি অসুস্থতা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েও কাজ করতেন। রমযান মাসে হাদীসের অসাধারণ ও জ্ঞানগর্ভ দরস প্রদান করতেন, যা শ্রোতাদেরকে যেন হাদীস বর্ণনার সেই যুগে নিয়ে যেত। জামাতের মুরব্বীরাও তার দরস শোনার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। অসুস্থতার শেষ দিনগুলোতে একজন তার সাথে দেখা করে দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ ফযল করবেন। তখন তিনি হাসিমুখে বলেন, আল্লাহ্ যখন কাউকে নিজের কাছে ডেকে নেন, সেটিও তো তাঁর ফযলই বটে। মৃত্যু নিয়ে মোটেও দুঃখিত বা চিন্তিত ছিলেন না, বরং সর্বদা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। মোবাল্লিগদেরকে তবলীগের ব্যাপারে খুব উৎসাহিত করতেন, তাদেরকে জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। জামাতের বুযুর্গদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। হুযূর বলেন, খিলাফতের প্রতি এত গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য ছিল যে, যখন খলীফা রাবে (রাহে.) আমাকে নাযেরে আলা ও আমীর মোকামী নিযুক্ত করেন, তখন খিলাফতের আনুগত্যে তিনি আমারও পূর্ণ আনুগত্য করেছেন, অথচ তিনি বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ১৩-১৪ বছর বড় ছিলেন। আর খিলাফতের পরও পরিপূর্ণ আনুগত্য ও পূর্ণ বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।

খুতবার শেষ দিকে হুযূর আনোয়ার (আই.) মরহুমের রূহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি দয়া ও কৃপা করুন আর নিজ প্রিয়দের চরণে তাকে ঠাঁই দিন, তার সন্তানদেরকেও খিলাফতের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত রাখুন, আমীন।