শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩০-নভেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩০শে নভেম্বর, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত সাবেত বিন খালেদ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উরফাতা (রা.), হযরত উতবা বিন আব্দুল্লাহ্ (রা.), হযরত কায়েস বিন আবি সা’সা (রা.), হযরত উবায়দা বিন আল্ হারেস (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হু্যূর (আই.) বলেন, আজ যেসব সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন, হযরত সাবেত বিন খালেদ (রা.), তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আর ইয়ামামার যুদ্ধেও অংশ নেন এবং শাহাদত বরণ করেন; কারও কারও মতে তিনি বি’রে মাঊনার ঘটনায় তিনি শহীদ হয়েছিলেন।

এরপর আছেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উরফাতা (রা.), তিনি হযরত যাফর বিন আবু তালিবের সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

এরপর রয়েছেন হযরত উতবা বিন আব্দুল্লাহ্ (রা.), তিনি আকাবার বয়আত, বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত কায়েস বিন আবি সা’সা (রা.)। তিনি ৭০ জন আনসারের সাথে আকাবার বয়আতে অংশ নেন, এছাড়া বদর ও উহুদের যুদ্ধেও অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। মহানবী (সা.) বদরের যুদ্ধের জন্য মদীনা থেকে বের হয়ে বুয়ুতুস্ সুকিয়া নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন; এবং সেখান থেকে তিনি (সা.) অল্পবয়সী বালকদেরকে মদীনায় ফেরত পাঠান। সেই স্থান অথাৎ বুয়ুতুস্ সুকিয়া থেকে পুনরায় যাত্রার প্রাক্কালে তিনি (সা.) হযরত কায়েস বিন আবি সা’সাকে মুসলমানদের সংখ্যা গণনা করার জন্য বললে, তিনি গণনা করে জানান, “এখানে ৩১৩ জন উপস্থিত আছেন”। একথা শুনে মহানবী (সা.) খুশি হয়ে বলেন, “তালূতের সাথে যোদ্ধার সংখ্যাও ছিল ৩১৩ জন”। একবার হযরত কায়েস বিন আবি সা’সা (রা.) মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমি কমপক্ষে কয়দিনে একবার কুরআন খতম করব?” মহানবী (সা.) তাকে ১৫ রাতে তা করতে বলেন। তিনি (রা.) নিবেদন করেন, “আমি এর চেয়েও অল্প সময়ে শেষ করতে পারব”। মহানবী (সা.) বলেন, “তাহলে এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ পর্যন্ত কর”। তিনি (রা.) বলেন, “আমি এর চেয়েও বেশি করতে পারব”। এরপর তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ এমনটিই করেছেন, অর্থাৎ প্রতি এক সপ্তাহে তিনি কুরআন খতম করতেন। কিন্তু তিনি যখন অনেক বৃদ্ধ হয়ে যান তখন ১৫ রাতে একবার খতম করতে শুরু করেন। তখন তিনি বলতেন, “হায়, আমি যদি মহানবী (সা.)-এর দেয়া সুযোগ কাজে লাগাতাম!” হযরত কায়েসের তিন ভাই ছিলেন, যারা মহানবী (সা.)-এর সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করলেও বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন নি। তাদের মধ্যে হযরত হারেস (রা.) ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন, আর আবু কিলাব ও জাবের বিন আবি সা’সা (রা.) মূতার যুদ্ধে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন।

আরেকজন সাহাবী ছিলেন, হযরত উবায়দা বিন আল্ হারেস (রা.), তিনি বনু মুত্তালিব গোত্রের সদস্য ছিলেন ও মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন। বয়সে তিনি মহানবী (সা.)-এর চেয়ে ১০ বছরের বড় ছিলেন। তিনি একেবারে প্রাথমিক যুগের মুসলমান, দারে আরকামের যুগের পূর্বেই তিনি ঈমান আনেন। মহানবী (সা.) তাকে উমায়র বিন আল্ হুমাম (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন, আর তারা উভয়েই বদরের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। হিজরতের অষ্টম মাসে মহানবী (সা.) উবায়দা বিন হারেসকে আমীর নিযুক্ত করে ৬০টি উষ্ট্রারোহীর একটি দল প্রেরণ করেন, যাতে তারা মক্কার কুরায়শদের আক্রমণ সম্পর্কে আগাম সংবাদ সংগ্রহ করে আনতে পারেন। তখন মিকদাদ বিন আমর ও উতবা বিন গাযওয়ান কাফিরদের দল ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে এসে মিলিত হন, সত্যিকার অর্থে তারা উভয়ে খুবই দুর্বল মুসলমান ছিলেন, হিজরতের সাহস বা সুযোগ তারা পান নি; তারা কাফিরদের সাথে এজন্য এসেছিলেন যাতে তারা সুযোগ মত মুসলমানদের সাথে এসে মিলিত হতে পারেন। তিনি বদরের যুদ্ধে ওয়ালিদ বিন উতবার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, একইভাবে হযরত হামযা (রা.) কুরায়শ যোদ্ধা উতবা ও হযরত আলী (রা.) কাফির নেতা শায়বার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করেন। ওয়ালিদের সাথে লড়াইয়ে তিনি (রা.) প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন, আর এরই ফলশ্রুতিতে তিনি বদরের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সাফরা নামক স্থানে এসে মৃত্যুবরণ করেন। শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল ৬৩ বছর।

এ ক’জন সাহাবীর স্মৃতিচারণের পর হুযূর (আই.) ইন্দোনেশিয়ার একজন নিবেদিতপ্রাণ সেবক, ওয়াকেফে যিন্দেগী, জামাতের প্রবীণ মুবাল্লিগ মোকাররম মওলানা সুয়ুতি আযীয আহমদ সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন, চিকিৎসার জন্য তাকে রাবওয়ার তাহের হার্ট ফাউন্ডেশনে পাঠানো হয়েছিল এবং সেখানে তার অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। এর কয়েকদিন পর গত ১৯শে নভেম্বর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ১৭ই আগস্ট ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ থেকে অক্টোবর ১৯৭১ পর্যন্ত জামেয়া আহমদীয়া রাবওয়ায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ইন্দোনেশিয়াতে কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ হিসেবে তার পদায়ন হয়। ১৯৮৫ সালে কর্মস্থলে থাকাকালীন তার কর্মনিষ্ঠা ও যোগ্যতার কারণে তাকে শাহেদ ডিগ্রিও প্রদান করা হয়। ২০০০ সালে তিনি হজ্জব্রত পালনের সুযোগ পান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর দক্ষিণ সুমাত্রা, লাম্পংক, জাম্বি ও ব্যাংকোলোতে মুবাল্লিগ হিসেবে তিনি জামাতের মূল্যবান সেবা করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মুয়াল্লিম ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামেয়া আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তবলীগ বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২০১৬ থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি পুনরায় জামেয়া আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মওলানা সুয়ুতি সাহেব তার ও তার পরিবারের আহমদীয়াত গ্রহণ সম্পর্কে এমটিএতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তার ও তার পরিবারবর্গের আহমদীয়াত গ্রহণের প্রধান কারণ হল, তার দাদার এই মূল্যবান ওসীয়্যত- “শেষ যুগে ইমাম মাহদী আসবেন, তিনি আসলে তোমরা সবাই তাকে গ্রহণ করো।” এই ওসীয়্যত পূরণার্থে ১৯৫৯ সালে তাদের পরিবার লাম্পংকে হিজরত করেন। ১৯৬৩ সালে মওলানা যেহনি দেহলান সাহেব সেখানে তবলীগের উদ্দেশ্যে আসেন এবং তার তবলীগে মওলানা সুয়ুতি সাহেব ও তার বংশের ৪০জন সদস্য আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। রাবওয়াতে থাকাকালীন তিনি সর্বদা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবীদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ খুঁজতেন, তাদের সেবা করতেন, তাদের পা টিপে দিতেন।

খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.)-এর নির্বাচনের পর তিনি যখন তাঁর সাথে দেখা করতে যান, তখন খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.) তার সাথে কোলাকুলি করার পর আদর করে বলেন, “এই ছেলে ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছে, তোমরা সবাই অনেক দূরদেশ থেকে এসেছো (বিদেশি ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলেন), তোমরা সবাই আমার সন্তান”। ইন্দোনেশিয়া ফেরত যাবার আগে বিদায়ের সময় খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.) তাকে দীর্ঘসময় ধরে আলিঙ্গন করেন এবং তার কানে কানে বলেন, “নিজের নেতার সাথে কখনও অবিশ্বস্ততা করো না- এটিই আমার উপদেশ!”

মরহুম সুযূতি সাহেব খিলাফতের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন। জামাতের সেবার ক্ষেত্রে কখনো তিনি নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি কোন পরওয়া করতেন না। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন, বিরোধিতার সময় নিজে গিয়ে খোদ্দামদের সাহস যোগাতেন। জীবন সায়াহ্নে অসুস্থতা সত্ত্বেও বাজামাত নামাযের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। গভীর মনোযোগের সাথে খুতবা শুনতেন, পরে জামেয়ার ছাত্রদের সাথে তা নিয়ে আলোচনা করতেন এবং দেখতেন যে, তারা বিভিন্ন পয়েন্ট নোট করেছে কি-না। মরহুম মূসী ছিলেন। তিনি ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তি বিভিন্ন দেশে তবলীগের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তার তবলীগে শত শত মানুষ আহমদীয়াত গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। আল্লাহ্ তা’লার প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। তিনি তার সহকর্মি মুরব্বীদেরকেও খোদার সত্তার প্রতি আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। তিনি খুবই কর্মঠ ছিলেন। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রাবওয়ায় যাওয়ার পূর্বে গত ৮ই নভেম্বর তিনি জামেয়াতে শেষবারের মত ক্লাশ নিয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি বিধবা স্ত্রী এবং চারজন সন্তান রেখে গেছেন। ইন্দোনেশিয়ার আমীর মওলানা বাসেত সাহেব সহ সবাই একবাক্যে তার পুণ্যময় স্বভাব-চরিত্রের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি সবকিছুর ওপর ওয়াক্ফে প্রাধান্য দিতেন এবং সবাইকে ওয়াক্ফের মর্যাদা রক্ষার নসীহত করতেন। ২৩শে নভেম্বর রাবওয়াহ্ হতে তার মরদেহ ইন্দোনেশিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ২৪শে নভেম্বর তাকে পারুমের মূসীদের জন্য সংরক্ষিত বিশেষ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার জানাযায় অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করেন। হুযূর আনোয়ার (আই.) তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তার মর্যাদা উন্নত করুন, জান্নাতুল ফিরদৌসে তাকে উচ্চস্থান দান করুন। মরহুমের সকল আত্মীয়-স্বজনকে ধৈর্য ও দৃঢ়মনোবল দান করুন এবং তার সন্তান-সন্ততিকে তার উন্নত আদর্শ অবলম্বন ও অনুসরণের তৌফিক দিন, আমীন।