যুক্তরাষ্ট্র ও গুয়াতেমালা ভ্রমণ – ২০১৮

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-নভেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬ই নভেম্বর, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় তাঁর সাম্প্রতিক আমেরিকা ও গুয়েতেমালা সফরের বৃত্তান্ত তুলে ধরেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, গত শুক্রবার তাহরীকে জাদীদের নববর্ষের ঘোষণা প্রদানের কারণে আমি আমার সাম্প্রতিক আমেরিকা ও গুয়েতেমালা সফর সম্পর্কে কিছু বলি নি। আল্লাহ্ তা’লার অপার কৃপায় এ ধরনের সফরের ফলে আহমদী ও অ-আহমদীদের সাথে সাক্ষাতের ক্ষেত্রে এবং জামাতের ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে; অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি। এছাড়া এ ধরণের সফরে তিনটি প্রধান যে লাভ হয় তাহল; সফররত দেশের শিক্ষিত ও প্রভাবশালী শ্রেণী-পেশার লোকদের সাথে যোগাযোগ হয় বা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, দ্বিতীয়তঃ প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে ইসলাম ও আহমদীয়াতের পরিচিতি ও প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে মানুষ অবগত হয়, তৃতীয়তঃ জামাতের সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় এবং সাক্ষাৎ হয় যা তাদের ভেতর খিলাফতের সঙ্গে বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার কারণ হয়ে থাকে। এছাড়া সেসব দেশের অবস্থানুসারে খুতবাতেও সরাসরি কিছু কথা বলার সুযোগ ঘটে।

হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্‌র অশেষ কৃপায় আমেরিকাতে এবারের সফরে তিনটি মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে; আল্লাহ্ তা’লা এই মসজিদগুলোকে সর্বদা নামাযী দ্বারা পরিপূর্ণ রাখুন এবং জামাতের সদস্যদের ভেতর নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকুন। আমি ফিলাডেলফিয়া, হিউস্টন আর ওয়াশিংটন বা ভার্জিনিয়া যেখানেই গিয়েছি, জামাতের ছোট-বড় সকল সদস্যকে অধিকাংশ সময় মসজিদের কাছাকাছিই অবস্থান করতে দেখেছি। স্বদেশে নির্যাতনের শিকার পাকিস্তানী আহমদীদের মধ্য হতে যারা সম্প্রতি আমেরিকাতে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন তাদের একটি বড় সংখ্যা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, তাদের সাথে সাক্ষাতের সময় অনেকে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। আল্লাহ্ তাদেরকে এখানে পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের পাশাপাশি তাদের মাঝে এই অনুভূতিও সর্বদা জাগরত রাখুন, তারা যেন ধর্মকে তাদের পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দিতে পারে আর জগতের চাকচিক্যের মোহে পথ হারিয়ে না ফেলে।

হুযূর (আই.) বলেন, সাধারণভাবে আমেরিকানরা, তা সে রাজনীতিবিদই হোক বা শিক্ষিত শ্রেণী কিংবা সাধারণ মানুষই হোক না কেন, তারা কথা শোনে এবং ভালো কথা বললে তা মেনে নেয়। ইসলামের খাঁটি ও সঠিক শিক্ষা তাদের কাছে আগে পৌঁছে নি; তাই ইসলাম সম্পর্কে তাদের অনেকেই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বা বিদ্বেষ রয়েছে বলা যেতে পারে। তবে, যাদের সাথে জামাতের বা আহমদীদের জানাশোনা আছে তারা ইসলাম ও আহমদীয়াত সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করেন। কাজেই, এটি এখন আমাদের- আহমদীদের দায়িত্ব: আমরা যেন ইসলামের সঠিক শিক্ষা আমেরিকাতে এবং গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিই। ইসলামের প্রকৃত বাণী ও শিক্ষা একদিকে যেমন অমুসলমানদের জন্য দৃষ্টি উম্মোচনের কারণ হয়, অন্যদিকে অ-আহমদী মুসলমানরাও জানতে ও বুঝতে পারে যে, ইসলামের কারণে তাদের হীনম্মন্যতায় ভোগার কোন কারণ নেই; বরঞ্চ ইসলামই যাবতীয় সমস্যার সমাধান প্রদান করে- এটি ভেবে তারা যেন আনন্দিত হয়। অমুসলমানরা আমাদের কথা শুনে অবাক বিষ্ময়ের সাথে বলে, যদি এটি-ই ইসলামের সঠিক শিক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতরূপে এটি-ই সফলকাম হওয়ার শিক্ষা। বা অচিরেই এই শিক্ষা বিশ্বময় গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।

এরপর হুযূর আনোয়ার (আই.) ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমোর ও ভার্জিনিয়ায় নবনির্মিত বায়তুল আফিয়্যাত, বাইতুস সামাদ এবং মসজিদে মসরূরের উদ্বোধন এবং তৎপরবর্তি বিভিন্ন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আগত বিভিন্ন অ-আহমদী অতিথির অনুভূতি বা অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। তাদের প্রায় সবাই একবাক্যে হুযূর (আই.)-এর সময়োপযোগী ভাষণের প্রেক্ষিতে যেসব মন্তব্য করেছেন তাহল, ইসলামের শিক্ষা যদি এমন অনিন্দ্য-সুন্দর হয়ে থাকে তবে তা তাদের জন্য মোটেই আপত্তিকর বা অগ্রহণযোগ্য নয়, আর তারা ইসলামের এমন অসাধারণ শিক্ষা সম্পর্কে ইতোপূর্বে অবগতও ছিল না। শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলামের যে শিক্ষা, এর তারা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা, প্রতিবেশির অধিকার প্রদান বা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যের অধিকার প্রদানের ব্যাপারে বেশি সচেষ্ট হওয়া, প্রতিবেশির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরষ্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান শিক্ষা তাদের অভিভূত করেছে। কেউ কেউ সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, ইসলামে যেরূপ অনিন্দ্য-সুন্দর শিক্ষা বিদ্যমান রয়েছে, খ্রিস্টধর্মে আদৌ তা নেই। আজকাল আমেরিকাতে ইসলামের প্রতি যে বিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে তা আসলে প্রচার মাধ্যমের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে হচ্ছে। কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী বা উগ্রপন্থীর কারণে পুরো ধর্মকে বা জাতিকে দায়ী করা ঘোরতর অন্যায়। আহমদীয়াতের যে স্লোগান বা ব্রত- ‘ভালোবাসা সবার তরে, ঘৃণা নয়কো কারো পরে’- এটি সকল দেশের নীতি-নির্ধারকদের অনুসরণ করা উচিত ও পালন করা উচিত। তবেই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন।

আমেরিকাতে তিনটি মসজিদ উদ্বোধন করা ছাড়াও হুযূর (আই.) হিউম্যানিটি ফার্ষ্টের উদ্যোগে গুয়েতেমালাতে নবনির্মিত একটি অত্যাধুনিক আহমদীয়া হাসপাতালের উদ্বোধন করেন, যার নাম হল; নাসের হাসপাতাল। এ উপলক্ষে আয়োজিত একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আগত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লোকেরা আহমদীয়া জামাতের মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা বলেন, হুযূর (আই.) যেভাবে মানুষের প্রতি সহানুভূতির চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়ার কথা বলেন। তিনি যেভাবে আর্তপিড়িত মানুষের সেবায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং আহমদীয়া জামাত যেভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সেবা করে আমরাও যদি এটি অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে বিশ্ব শান্তিধামে পরিণত হতো। হুযূর (আই.)-এর যুগান্তকারী বক্তব্য আপন-পর সবাইকে সমানভাবে মোহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে এবং সবাই তা স্বীকারও করেছেন অবলীলায়।

এছাড়া পাশ্ববর্তি বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক নতুন বয়আতকারী আহমদীও হুযূর (আই.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য গুয়েতেমালায় আসেন। মেক্সিকো, হন্ডুরাস, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, পানামা আর বেলিস সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আহমদীরা হুযূর (আই.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য এবং তাঁর পিছনে নামায পড়ার জন্য আসেন। তারাও নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন, কেউ কেউ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। যারা প্রথমবার হুযূর (আই.)-এর সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তাদের জন্য খলীফার সান্নিধ্য লাভ করা এক আশ্চর্য ও অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল বলে তারা মন্তব্য করেছেন। আহমদীয়াত গ্রহণ তাদের জীবনে কিরূপ আশ্চর্জ পরিবর্তন এনে দিয়েছে এরও তারা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। হুযূর (আই.)-কে বাস্তবে দেখে এবং তার সাথে একান্তে সময় কাটানোর সৌভাগ্য লাভ করে তারা যারপরনাই আনন্দিত ছিলেন। হুযূর (আই.)-এর সাথে সরাসরি সাক্ষাত লাভ ছিল তাদের জীবনের পরম পাওয়া। সবাই তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পরেন। তারা বিনাবাক্যে বলেছেন, আহমদীয়াত গ্রহণ তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে। তারা এক নতুন জীবন লাভ করেছেন।

হুযূর (আই.) বলেন, মোটের ওপর এই সফরকে আল্লাহ্ তা’লা সবদিক থেকে অত্যন্ত কল্যাণমন্ডিত করেছেন। হুযূর (আই.) নবাগত আহমদীদের জন্য দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এদের সবাইকে নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততায় উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে থাকুন, তাদের খাঁটি আহমদী হবার তৌফিক দিন। এছাড়া টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হুযূরের এই সফরের বরাতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোকের কাছে ইসলাম ও আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁছেছে, হুযূর সেগুলোরও একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এসব বর্ণনার উপসংহার টেনে হুযূর (আই.) মন্তব্য করেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় এই সফর সবদিক থেকে অত্যন্ত কল্যাণমন্ডিত ও সফল ছিল। হুযূর (আই.) মিডিয়া টিমেরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের সুশীল সমাজ, সরকারী ও বেসরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রচার মাধ্যমের সাথে একটি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ কারণেই এবার প্রচার মাধ্যম আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ফলাও করে প্রচার করেছে। আল্লাহ্ সবাইকে এর উত্তম প্রতিদান দিন। এরপর হুযূর (আই.) দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা ভবিষ্যতেও এই সফরের পুণ্যময় ও কল্যাণকর ফলাফল সৃষ্টি করতে থাকুন, আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) বুর্কিনাফাঁসোর একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও পুণ্যবান আহমদী মোহতরম সাওয়াদুগু ইসমাঈল সাহেবের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন, যিনি গত ১৪ই নভেম্বর ফজরের নামাযের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং পথিমধ্যেই অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর (আই.) মরহুমের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তার অসাধারণ গুণাবলীর কথা তুলে ধরেন; তিনি সর্বদা মসজিদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন। নিয়মিত মসজিদে আযান দিতেন বলে সবাই তাকে সৈয়দনা বেলাল বলে ডাকতেন। তিনি একজন মূসী ও খিলাফতের প্রেমিক ছিলেন। মরহুমের আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করে হুযূর (আই.) ও তার পদমর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য দোয়া করেন, আমীন।