প্রকৃত আহ্‌মদী’র গুণাবলী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-নভেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বায়তুর রহমান, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২রা নভেম্বর, ২০১৮ আমেরিকার মেরিল্যান্ডের মসজিদ বায়তুর রহমান থেকে বয়আতের প্রকৃত তত্ত্ব ও মসীহ্ মওউদ (আ.) কর্তৃক নির্ধারিত বয়আতের কতিপয় শর্তের আলোকে একজন আহমদীর করণীয় প্রসঙ্গে খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তি, তা সে পুরুষই হোক বা নারী, কেবল আহমদী দাবী করলেই প্রকৃত আহমদী হয়ে যায় না। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রকৃত আহমদী হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত রেখেছেন, কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছেন; সেগুলো পালন করলে তার জামাতভুক্ত বলে গণ্য হওয়া যাবে। কেবল বিশ্বাসগত পরিবর্তন আহমদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; এর মাধ্যমে বিশ্বাসগতভাবে তো আহমদী হওয়া যায়, কিন্তু কার্যত আহমদী হওয়ার জন্য নিজের যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য সেসব কথা মানার জন্য ব্যয় করতে হবে যেগুলো মসীহ্ মওউদ (আ.) একজন আহমদীর কাছ থেকে আশা করেছেন। তিনি (আ.) বলেন, বয়আত করা মানে নিজ প্রাণ খোদা তা’লার হাতে সমর্পণ করে দেয়া। যখন আমরা কোন জিনিস বিক্রি করে দিই তখন সেটির মালিকানা আর আমাদের থাকে না, বরং যার কাছে বিক্রি করা হয়েছে তার হয়ে যায়। বয়আতের পর আমাদের অবস্থা এমনটিই হওয়া উচিত। এই অবস্থা অর্জনের জন্য একজন বয়আতকারীকে সর্বপ্রথম দীনতা ও বিনয় অবলম্বন করতে হয় এবং নিজ আমিত্ব ও অহংকার থেকে মুক্ত হতে হয়। হুযূর (আই.) বলেন, কিছু মানুষের আমিত্ব এতটাই বেশি যে কোন এক কর্মকর্তা অন্য এক কর্মকর্তার প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে আমার উপস্থিতি সত্ত্বেও নামাযের জন্য মসজিদে আসে নি। অবস্থা যদি এমনটিই হয়, তবে এমন আহমদী হয়ে কোন লাভ নেই।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যদি বয়আতের সময় অঙ্গীকার একরকম থাকে এবং কাজ অন্যরকম হয়, তাহলে খোদা তা’লাও তোমাদের থেকে দূরে থাকবেন। তাই তোমরা নিজেদের ঈমান ও কর্মের হিসাব নাও যে তোমরা সেই পরিবর্তন ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেছ কি-না যেন তোমাদের হৃদয় খোদা তা’লার আরশে পরিণত হয় ও তোমরা তাঁর নিরাপত্তার ছায়াতলে আশ্রয় লাভ কর। তোমরা নিজেদের মাঝে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি কর যেমনটি সাহাবীরা (রা.) করেছিলেন। তারা তো বয়আত করার পর বংশানুক্রমিক শত্রুতাকেও ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বে বদলে দিয়েছিলেন। তারা বয়আতের পর মনে-প্রাণে এটিই মেনে চলেছেন, আজ থেকে আমাদের নিজেদের কিছুই নেই, সবকিছু খোদা তা’লার। শির্‌ক থেকে তওবা করার পর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শির্‌ক থেকেও আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন। গোপন শির্‌ক কী তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, কেবল পাথর ইত্যাদির তৈরি প্রতিমার পূজাই শির্‌ক নয়, বরং উপায়-উপকরণের পূজাও শির্‌ক । মহানবী (সা.) বলেন, লোকদেখানো কর্ম করা এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অধীন হওয়াও শির্‌ক । মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, কেবল মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে দেয়া তওহীদ নয়, বরং যে ব্যক্তি নিজের কাজ, বুদ্ধি ও পরিকল্পনাকে খোদার মতই শক্তিশালী মনে করে বা কোন মানুষের উপর ভরসা করে বা নিজ সত্ত্বাকে সেই সম্মান দেয় যা খোদা তা’লাকে দেয়া উচিত- এমন প্রত্যেক ক্ষেত্রে সে খোদার নিকট প্রতিমাপূজারী। হুযূর (আই.) বলেন, কেউ একজন আমাকে বলেছে, মানুষ খলীফাকে এতটা উচ্চ মর্যাদা দেয় যে তা শির্‌কের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। স্পষ্ট হওয়া দরকার, মসীহ্ মওউদ (আ.) মহানবী (সা.)-এর দাসত্বে শির্‌ক দূর করতে এসেছেন; এটি অসম্ভব যে তাঁর পরে প্রতিষ্ঠিত খিলাফত কোনভাবে কোন প্রকার শির্‌ককে উৎসাহিত করবে। যদি কারও মনে এরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়, তবে তার ইস্তেগফার করা উচিত ও সতর্ক হওয়া উচিত।

তওহীদ প্রতিষ্ঠা ও শির্‌ক থেকে আত্মরক্ষার অঙ্গীকারের পর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যে বিষয়ে আমাদের বয়আত নিয়েছেন তা হল মিথ্যা ও চারিত্রিক অপবিত্রতা থেকে আত্মরক্ষা। আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে মিথ্যাকে প্রতিমার সাথে একত্রে উল্লেখ করে দু’টোকে অনুরূপ অপবিত্রতা বলে সাব্যস্ত করেছেন। মিথ্যার উপর ভরসাকারী ব্যক্তি খোদার উপর ভরসা করা ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ ছোট-খাটো বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলে বসে আর ভাবে, এটি মিথ্যা নয়। অবশ্যই তা মিথ্যা! মহানবী (সা.) মিথ্যার সংজ্ঞায় ভয়াবহ কথা বলেছেন। তিনি (সা.) বলেন, যে কোন শিশুকে এটি বলে, ‘আস, আমি তোমাকে কিছু দেব’ আর বাস্তবে কিছু দেয় না, সে-ও মিথ্যাবাদী। তাই আমাদের মিথ্যা পরিত্যাগের ক্ষেত্রে এই মানদন্ডে উন্নীত হতে হবে। আরেকটি নোংরামি হল ব্যভিচার, এটি থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। আর কেবল বাহ্যিক ব্যভিচারই নয়, বরং কুরআনের নির্দেশ হল- ব্যভিচারের চিন্তাও মনে আসতে পারে এমন ক্ষেত্র পরিহার কর। বর্তমান যুগে টিভি বা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফিও ব্যভিচারের অন্তর্ভুক্ত, তাই সেটি আহমদীদের অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আরেকটি বিষয় হল সর্বপ্রকার অত্যাচার থেকে বিরত থাকা। এ বিষয়টিও অনেক ব্যাপক; কারও অধিকার খর্ব করাও অনেক বড় অত্যাচার ও পাপ। এটির ক্ষেত্রেও প্রত্যেক আহমদীর সূক্ষ্মভাবে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে।

মুমিন হওয়ার আবশ্যক শর্ত হল আল্লাহ্‌র ইবাদত, আল্লাহ্ তা’লা এটিকে মানবসৃষ্টিরই উদ্দেশ্য আখ্যা দিয়েছেন। আর এর প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হল নামায। মহানবী (সা.)-এর কাছে নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের একটি দল তাদের কর্মব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে আবেদন করে যেন তাদের নামায মাফ করে দেয়া হয়। তিনি (সা.) তাদের জবাব দেন, নামায ছাড়া তো ধর্মই থাকে না। জন্তু-জানোয়ার ও মানুষের মাঝে পার্থক্যকারী জিনিস হল নামায। মহানবী (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেয়া হবে; এই হিসাব ঠিক থাকলে মুক্তি পাওয়া যাবে, নতুবা বিপদে পড়তে হবে। কেবল ফরয নামাযই নয়, বরং নফল ও তাহাজ্জুদ নামাযেও মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। আরেকটি বিষয় যার প্রতি একজন আহমদীর গভীর মনোযোগ থাকা প্রয়োজন তা হল, নিজ ভুল-ত্রুটি ও অন্যায়ের জন্য আল্লাহ্ তা’লার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও ইস্তেগফার করা। কোন কোন মানুষ তো নিজ পাপ সম্পর্কে অবগত থাকে, কিন্তু এমন অনেক মানুষও রয়েছে যারা নিজেদের পাপ সম্পর্কে অবগতও থাকে না। এজন্য আল্লাহ্ তা’লা ইস্তেগফারকে আবশ্যক করেছেন, যেন অজান্তে করা পাপের কুফল থেকে ও পাপ থেকে মানুষ বাঁচতে পারে। আরেকটি শর্ত তিনি (আ.) বয়আতকারীদের জন্য রেখেছেন, তা হল- আল্লাহ্‌র সৃষ্ট কোন জীবকে কোন প্রকার কোন কষ্ট না দেয়া। কাউকে নিজ হাত বা কথা দ্বারা কোন প্রকার কষ্ট দেয়া অবৈধ। আবার অহংকার একটি অত্যন্ত বড় পাপ, যা থেকে আল্লাহ্ তা’লা আমাদের বিরত থাকতে বলেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, যার মনে সরিষার দানা পরিমানও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে যেতে পারবে না। একজন আহমদীর জ্ঞানের বা বংশমর্যাদার বা সম্পদের বা কোন প্রকার কোন অহংকার করা উচিত নয়। এটি আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। বয়আতের অঙ্গীকারের আরেকটি বিষয় হল আর্থিক কুরবানী, আর এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’লাও কুরআনে নির্দেশ প্রদান করেছেন। হুযূর (আই.) বলেন, এ বিষয়টি স্বয়ং খোদা তা’লার সাথে সম্পর্কিত, তাই চাঁদার বাজেটে সঠিক আয় লেখানো উচিত। এটি ভাবা অনুচিত যে আল্লাহ্‌র পথে খরচ করলে তো আমার নিজের কষ্ট হবে। কুরবানী মানেই হল নিজেকে কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে খোদা তা’লার পথে প্রিয় বস্তু ব্যয় করা।

হুযূর (আই.) খুতবায় শেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করেন তা হল আনুগত্য। এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনে অজস্রবার এসেছে, বিশেষভাবে আল্লাহ্, তাঁর রসূল (সা.) ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের আনুগত্য প্রসঙ্গে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও বয়আতের একটি শর্ত রেখেছেন আনুগত্য প্রসঙ্গে, আর আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের অঙ্গীকারনামাতেও এই কথাগুলো রয়েছে-‘যুগ-খলীফার সকল ন্যায়সংগত মীমাংসা মেনে চলব’। কিন্তু কতিপয় বক্র প্রকৃতির লোক, যদিও তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য, এই আপত্তি করে যে ‘খলীফার সব মীমাংসা তো ন্যায়সংগত হয় না’! মহানবী (সা.)-এর যুগেও এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল, এক কাফেলার আমীর ঠাট্টাচ্ছলে একটি বিষয় প্রশ্ন করেছিলেন। যখন তা মহানবী (সা.)-এর কাছে উল্লেখ করা হয় তখন তিনি (সা.) বলেন, আল্লাহ্‌র নির্দেশের বিপরীত কোন নির্দেশ যদি দেয়া হয় তবে তা মান্য করা যাবে না। তাঁর (সা.) এই কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে অন্যায় সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা কোনটি, অর্থাৎ আল্লাহ্ ও রসূলের নির্দেশের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত হল অন্যায় সিদ্ধান্ত। আর মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কোন খলীফা কখনোই এমন কোন সিদ্ধান্ত দেন নি যা আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-এর নির্দেশের পরিপন্থী।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকলকে ইসলামের শিক্ষা সঠিকভাবে বুঝে তা পালনের তৌফিক দান করুন; আমরা যেন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার হক আদায়কারী হই, সর্বদা যেন খিলাফতের সাথে পূর্ণ আনুগত্যের সাথে সম্পৃক্ত থাকি, আর যুগ-খলীফার সকল ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা বিশুদ্ধচিত্তে, পরিপূর্ণ আনুগত্যের সাথে মান্যকারী হই- আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকলকে সেই তৌফিক দান করুন। আমীন।