প্রকৃত আহ্‌মদী’র গুণাবলী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-অক্টোবর, ২০১৮

মসজিদ বায়তুস্ সামী, হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮ইং আমেরিকার হিউস্টন, টেক্সাসের মসজিদ বায়তুস্ সামী থেকে একজন প্রকৃত আহ্‌মদী’র গুণাবলী প্রসঙ্গে খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আমাদের প্রতি এটি আল্লাহ্ তা’লার অনেক বড় অনুগ্রহ যে তিনি আমাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মানার তৌফিক দান করেছেন, যাকে মহানবী (সা.) অত্যন্ত ভালবাসার সাথে ‘আমাদের মাহদী’ নামে উল্লেখ করেছেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর রচনাবলীর মাঝে ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট ধর্ম হবার কথা লিখেছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। একইসাথে তিনি সেসব পুস্তকে ও বক্তৃতাসমূহে আমাদের তরবিয়তের জন্যও অনেক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন, যা আমাদের নিয়মিত চর্চা করা প্রয়োজন; এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ, ধর্মের ব্যুৎপত্তি ও আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জন, কুরআনের জ্ঞান ও মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা অনুধাবন করার এবং আমাদের বিশ্বাস ও কর্মের উন্নতি সাধনের উপায়। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হবে যদি আমরা এই ধনভান্ডার থাকা সত্ত্বেও তা থেকে উপকৃত না হই। তাই আমরা যারা তাঁকে মানার দাবী করি, তাদের জন্য তাঁর পুস্তকাদি পড়া, মনোযোগ দিয়ে শোনা ও তা পালনের চেষ্টা করা আবশ্যক। এরপর হুযূর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় উদ্ধৃতির আলোকে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।

প্রকৃত তাকওয়া সম্বন্ধে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, প্রকৃত তাকওয়া, যার দ্বারা খোদা তা’লা সন্তুষ্ট হন, সেটি অর্জনের জন্য তিনি বারংবার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাযিনা আমানুত্তাকুল্লাহা’ অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারেরা! তোমরা আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর।’ আল্লাহ্ এ-ও বলেছেন, ‘ইন্নাল্লাহা মা’আল্লাযিনাত্তাকাও ওয়াল্লাযিনা হুম মুহসিনুন’ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’লা তাদের সাহায্য-সহায়তা করেন, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। তিনি (আ.) বলেন, এই কথাটি আমার প্রতি অজস্রবার নাযিল হয়েছে, হয়তোবা দুই সহস্রাধিক বার নাযিল হয়েছে; এর উদ্দেশ্য হল যেন জামাত বুঝতে পারে যে কেবল মৌখিক বয়আত বা শুষ্ক ঈমান কোন কাজের জিনিস নয়, যতক্ষণ প্রকৃত তাকওয়া ও পুণ্য অর্জিত না হয়। কেবলমাত্র মন্দকর্ম থেকে বিরত হওয়া ইসলাম নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত একই সাথে পুণ্যকর্ম না করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করা যায় না। কিছু কিছু পাপ তো স্থুল ধরনের হয়ে থাকে, যেমন মিথ্যা কথা, ব্যভিচার, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা সাক্ষ্য ইত্যাদি। কিন্তু কিছু কিছু পাপ অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়ে থাকে, যেগুলোতে আক্রান্ত মানুষ বুঝতেও পারে না যে সে পাপ করছে। যেমন, অযথা অভিযোগ-অনুযোগ করা, যা পরবর্তীতে চোগলখুরী বা পরচর্চায় রূপান্তরিত হয়; কুরআন শরীফ এটিকে অনেক বড় পাপ বলে আখ্যা দিয়েছে। তেমনিভাবে কৃপণতা, ক্রোধ ইত্যাদি আরও অনেক সূক্ষ্ম পাপ রয়েছে, যা মানুষ ছোট বিষয় মনে করে, অথচ তা অনেক বড় পাপ। আল্লাহ্‌র নির্দেশানুসারে সর্বপ্রথম ধাপ হল, মানুষ যেন সর্বপ্রকার পাপ থেকে বিমুক্ত হয়। তিনি (আ.) বলেন, এমন মানুষ অনেক আছে যারা কখনো খুন, চুরি, ব্যভিচার ইত্যাদি করে নি; কিন্তু এমন মানুষ কতজন পাওয়া যাবে যারা কখনও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ করে নি, কারও আড়ালে তার বিরুদ্ধে কথা বলে নি, বা নিজের কথা দিয়ে কাউকে কষ্ট দেয় নি? তিনি (আ.), আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম, যারা এসব সূক্ষ্ম বিষয় খেয়াল করে চলে এবং আল্লাহ্ তা’লাকে ভয় করে। হুযূর (আই.) বলেন, এটি হল পুণ্যের সেই মানদন্ড যা একজন মুমিনের কাছ থেকে আশা করা হয়।

মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা বলেন, প্রথম ধাপ হল মানুষ যেন তাকওয়া অবলম্বন করে, ছোট ছোট ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পাপ থেকে বিরত হওয়া। মানুষ যেন এটি জানে ও বোঝে যে কোনটি পাপ ও কোনটি পুণ্য। নামায-রোযা ইত্যাদি ইবাদতও কেবল মুত্তাকী বা খোদাভীরুদেরই গৃহীত হয়। আর নামায গৃহীত হওয়ার অর্থ হল, নামাযের প্রভাব ও কল্যাণ নামাযীর মাঝে সৃষ্টি হওয়া। আর যদি সেই প্রভাব ও কল্যাণ তার মাঝে সৃষ্টি না হয় তবে তার নামায কেবলমাত্র প্রথাগত ওঠ-বস করা। হুযূর (আই.) বলেন, এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের যাচাই করতে হবে আমাদের ইবাদত গৃহীত হচ্ছে কি-না। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যে ব্যক্তি মুমিন হতে চায় তার জন্য প্রথম ধাপ বা বাধা হল মন্দ কাজ পরিত্যাগ করা, আর এরই নাম হল তাকওয়া। আর আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য কেবল এটিই যথেষ্ট নয়; বরং এর সাথে সাথে পুণ্যও করতে হবে, নতুবা মুক্তি পাওয়া যাবে না। ইসলাম মানুষের দু’টি অংশকেই পূর্ণ করতে চায়- একদিকে পাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত হও, সেইসাথে পুণ্যকর্ম পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন কর। যতক্ষণ এই দু’টি বিষয়ই অর্জিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত নাজাত বা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভালভাবে স্মরণ রেখো, যদি তাকওয়া অবলম্বন না কর ও খোদার পছন্দমত পুণ্য যথেষ্ট পরিমাণে না কর, তাহলে আল্লাহ্ তা’লা সর্বপ্রথম তোমাদেরকেই ধ্বংস করবেন; কারণ তোমরা একটি সত্যকে গ্রহণ করা সত্ত্বেও কাজের মাধ্যমে সেটিকে অস্বীকার করছ। কথা ও কাজে যতক্ষণ এক না হবে, ততক্ষণ ধর্মবিশ্বাস কোন কাজে আসবে না; ধর্মবিশ্বাস তো তোমাদের ও অ-আহমদীদের একই রকম। আসল জিনিস হল কর্ম, সেটিকে ঠিক করতে হবে।

ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দেয়ার বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি (আ.) সাহাবীদের (রা.) উদাহরণ উপস্থাপন করে বলেন যে তারা আল্লাহ্‌র পথে জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। এটি কোন সহজ ব্যাপার ছিল না, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর সাহাবীরা তা-ই করেছিলেন এবং তা করতে গিয়ে পৃথিবীর দিকে ঝোঁকেন নি। তাই তোমাদের জন্য ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। মনে রেখো, যে এই জামাতের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার শেকড় হল এই পৃথিবী, খোদা তা’লার কাছে সে এই জামাতের সদস্য নয়। তিনি (আ.) বলেন, বয়আত কেবল তখনই উপকারে আসে যখন ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দেয়া হয় ও এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা হয়। বয়আত হল বীজের মত; যদি এক কৃষক কেবল বীজ বপন করার পর সেই ক্ষেতে পানি-সার ইত্যাদি না দেয় বা অন্যান্য যত্ন না নেয়, সেই কৃষক কি ফসলের আশা করতে পারে? তার ক্ষেত তো একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষেত তার-ই ঠিক থাকবে যে পূর্ণ দায়িত্বশীল হবে। তিনি (আ.) তার সামনে থাকা নতুন বয়আতকারীদের সম্বোধন করে বলেন, আপনারাও আজ এক প্রকার বীজ বপন করেছেন; সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে এই বীজকে নিরাপদ রাখবে ও নিজ সাধ্যানুসারে এর উন্নতির জন্য দোয়া করতে থাকবে।

তিনি (আ.) অত্যন্ত জরুরী এক উপদেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন, বর্তমান যুগ খুব মন্দের দিকে এগোচ্ছে। বিভিন্ন রকম শির্‌ক, বিদআত ও মন্দকাজের প্রচলন হয়ে গেছে। বয়আতের সময় ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দেয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়, তা খোদার সামনে করা অঙ্গীকার। এখন মৃত্যু পর্যন্ত এই অঙ্গীকারের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত; নতুবা জানবে বয়আত হয় নি। আর যদি বয়আতে প্রতিষ্ঠিত থাক, তাহলে আল্লাহ্ তা’লা ইহকাল ও পরকাল দু’টোতেই বরকত দিবেন। এ যুগ অত্যন্ত নাজুক, খোদার ক্রোধ এতে প্রকাশিত হচ্ছে। যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুসারে জীবন গড়বে, সে নিজের ও নিজ পরিবারবর্গের প্রতি করুণা করবে। এই বিপদসংকুল যুগে আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কই মানুষকে রক্ষা করতে পারে। তিনি (আ.) উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেভাবে এক ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ছোট্ট এক টুকরো রুটি বা ছোট এক চুমুক পানি খেয়ে বাঁচতে পারে না, বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার ও পানি খেলে তার প্রাণ রক্ষা পায়, তেমনিভাবে ধর্মকর্ম, তাকওয়া ও ইবাদত সেই পরিমাণ করা আবশ্যক যা আধ্যাত্মিক জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন। ভালভাবে স্মরণ রাখা উচিত, খোদা তা’লার কোন কোন কথা না মানা তাঁর সকল নির্দেশই অমান্য করার সমতুল্য হয়ে থাকে। এটি তো হতে পারে না যে একদিকে তোমরা খোদার আনুগত্য করবে, অন্যদিকে তাঁর শত্রুদেরও আনুগত্য করবে!

হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন আমরা যেন বয়আতের কর্তব্য পালনার্থে নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন আনয়নকারী হই, পৃথিবীতে থেকেও যেন ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দানকারী হই, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নির্দেশাবলী পালনকারী হই এবং বয়আতের দশম শর্তে ন্যায়সঙ্গতভাবে তাঁর আনুগত্যের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা অনুধাবন করে আনুগত্যের সেই মানদন্ডে উপনীত হই, যেন আল্লাহ্ তা’লার সেসব অনুগ্রহের উত্তরাধিকারী হতে পারি যা আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমীন।