শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১২-অক্টোবর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১২ই অক্টোবর, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবদুর রাব্বে বিন হক বিন অওস (রা.), হযরত সালামা বিন সাবেত (রা.), হযরত সিনান বিন সাইফি (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আবদে মানাফ (রা.), হযরত মুহরেস বিন আমের বিন মালেক (রা.), হযরত আয়েস বিন মায়েস (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সালামা বিন মালেক আনসারী (রা.), হযরত মাসউদ বিন খালদা (রা.), হযরত মাসউদ বিন সা’দ আনসারী (রা.), হযরত যায়েদ বিন আসলাম আনসারী (রা.), হযরত আবুল মুনযের ইয়াযিদ বিন আমের (রা.), হযরত আমর বিন সা’লাবা আনসারী (রা.), হযরত আবু খালেদ হারেস বিন কায়েস বিন খালেদ বিন মুখাল্লাদ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সা’লাবা (রা.), হযরত নাহাব বিন সা’লাবা (রা.), হযরত মালেক বিন মাসউদ আনসারী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কায়েস বিন সাখর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আবস (রা.), হযরত মুআত্তেব বিন কুশায়র (রা.), হযরত সাওয়াদ বিন রুযন (রা.), হযরত মুআত্তেব বিন অওফ (রা.), হযরত বুজায়র বিন আবি বুজায়র (রা.), হযরত আমের বিন বুকায়র (রা.), হযরত আমর বিন সুরাকা বিন মু’তামির (রা.), হযরত সাবেত বিন হাযযাল (রা.), হযরত সুবাই বিন কায়েস (রা.), হযরত খাব্বাব (রা.), হযরত সুফিয়ান বিন নাসর (রা.), হযরত আবু মাখশী আত-তাঈ (রা.), হযরত ওয়াহহাব বিন আবি সারাহ (রা.), হযরত তামীম (রা.), হযরত আবুল হামরা (রা.), হযরত আবু সাবরা বিন আবি রুহম (রা.), হযরত সাবেত বিন আমর বিন যায়েদ (রা.), হযরত আবুল আওয়ার বিন হারেস (রা.), হযরত আবস বিন আমের বিন আদি (রা.), হযরত আইয়াস বিন বুকায়র (রা.), হযরত মালেক বিন নুমাইলা (রা.), হযরত উনায়স বিন কাতাদা বিন রবীআ (রা.), হযরত হারেস বিন আরফাজা (রা.), হযরত রাফে বিন উনজেদা (রা.), হযরত খুলাইদা বিন কায়েস (রা.), হযরত সাক্‌ফ বিন আমর (রা.), হযরত সাবরা বিন ফাতেক (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজ আমি যেসব সাহাবীর স্মৃতিচারণ করতে যাচ্ছি, তাদের জীবনাচরণ ও ঘটনাবলী ইতিহাসের পাতায় বিস্তারিতভাবে সংরক্ষিত হয় নি। তাদের কেবল সংক্ষিপ্ত পরিচিতিই রয়েছে, কয়েকজন সম্পর্কেতো কেবল দু’এক লাইনের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু আমি চাই, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সাহাবীর বিবরণ একসাথে জামাতের কোন পুস্তকে যেন সংরক্ষিত হয়, তাই আমি সংক্ষিপ্ত বিবরণের এসব নামও উল্লেখ করছি। এমনিতেও এসব সাহাবীদের যে মর্যাদা ও মোকাম রয়েছে, তাদের বর্ণনা সংক্ষিপ্ত হলেও আমাদের জন্য সেই স্মৃতিচারণ বা তাদেরকে স্মরণ করা আমাদের জন্য কল্যাণের কারণ। এরা হলেন সেসব মানুষ, যারা দরিদ্র ও দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের সুরক্ষায় প্রথম সারিতে ছিলেন; শত্রুদের শক্তি-প্রতিপত্তিতে ভীত হন নি, বরং আল্লাহ্‌র সত্ত্বাতেই ছিল তাদের যাবতীয় আশা-ভরসা। মহানবী (সা.)-এর সাথে বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করার পর তা পালনের নিমিত্তে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। বিশ্বস্ততার এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার প্রতিদানে আল্লাহ্ তা’লাও তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন ও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবার ঘোষণা দেন। এরপর হুযূর আনোয়ার (আই.) একাধারে সেসব সাহাবীর স্মৃতিচারণ করেন।

হযরত আবদুর রাব্বে বিন হক বিন অওস (রা.), তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। হযরত সালামা বিন সাবেত (রা.), বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নেন, উহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের হাতে শহীদ হন, এ যুদ্ধে তার পিতা, চাচা এবং ভাইও শহীদ হন। হযরত সিনান বিন সাইফি (রা.), নবুওয়তের দ্বাদশ বর্ষে হযরত মুসআবের তবলীগে মুসলমান হন ও আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে অংশ নেন। তিনি খন্দকের যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আবদে মানাফ (রা.), বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত মুহরেস বিন আমের বিন মালেক (রা.), তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন, উহুদ যুদ্ধে রওয়ানা হবার দিন সকালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। যেহেতু যুদ্ধে যাবার নিয়্যত ছিল, সেহেতু মহানবী (সা.) তাকে উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গণ্য করেছেন। হযরত আয়েস বিন মায়েস (রা.) একজন আনসারী সাহাবী ছিলেন, তিনি বদরসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে দ্বাদশ হিজরিতে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সালামা বিন মালেক আনসারী (রা.), তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং উহুদের যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন। আরেকজন হলেন, হযরত মাসউদ বিন খালদা (রা.), কারও মতে তিনি বি’রে মাউনার ঘটনায় শহীন হন, আবার অন্য কারও মতে খায়বারের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এরপর আছেন হযরত মাসউদ বিন সা’দ আনসারী (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন, কারও মতে তিনি বি’রে মাউনার ঘটনায় শহীন হন, আবার অন্য কারও মতে খায়বারের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এরপর আছেন হযরত যায়েদ বিন আসলাম আনসারী (রা.), হযরত আবু বকর (রা.)-এর যুগে তুলাইহার সাথে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত আবুল মুনযের ইয়াযিদ বিন আমের (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।

হুযূর (আই.) আরেকজন সাহাবী হযরত আমর বিন সা’লাবা আনসারী (রা.)-এর উল্লেখ করেন, বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। এরপর আছেন হযরত আবু খালেদ হারেস বিন কায়েস বিন খালেদ বিন মুখাল্লাদ (রা.), আকাবার বয়আত ও বদরসহ সকল যুদ্ধেই তিনি অংশ নিয়েছেন এবং ইয়ামামার যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হন। হযরত উমরের যুগে সেই পুরনো আঘাত পুনরায় মাথাচাড়া দেয় এবং তিনি মৃত্যু বরণ করেন, এজন্য তাকে ইয়ামামার যুদ্ধের শহীদদের মাঝে গণ্য করা হয়। আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সা’লাবা (রা.) যিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। আরেকজন সাহাবী হযরত নাহাব বিন সা’লাবা (রা.), তিনি পূর্বোক্ত সাহাবীর ভাই ছিলেন। আরেকজন সাহাবী ছিলেন, হযরত মালেক বিন মাসউদ আনসারী (রা.), যিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর আছেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন কায়েস বিন সাখর (রা.)। তারপর আছেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আবস (রা.), মহানবী (সা.)-এর সাথে বদরসহ সকল যুদ্ধেই অংশ নিয়েছেন। এরপর আছেন হযরত মুআত্তেব বিন কুশায়র (রা.), তারপর আছেন হযরত সাওয়াদ বিন রুযন (রা.)। আরেকজন হলেন, হযরত মুআত্তেব বিন অওফ (রা.), ৫৭ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরেকজন সাহাবী হযরত বুজায়র বিন আবি বুজায়র (রা.)। আরেকজন হলেন, হযরত আমের বিন বুকায়র (রা.), তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন। এরপর আছেন হযরত আমর বিন সুরাকা বিন মু’তামির (রা.), উসমান (রা.)-এর যুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরেকজন সাহাবী হযরত সাবেত বিন হাযযাল (রা.), দ্বাদশ হিজরীতে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এরপর আছেন হযরত সুবাই বিন কায়েস (রা.)। আরেকজন হলেন, হযরত খাব্বাব (রা.), তিনি উতবা বিন গাযওয়ানের মুক্তকৃত দাস ছিলেন, ১৯ হিজরীতে ৫০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। হযরত সুফিয়ান বিন নাসর (রা.) ছিলেন একজন আনসারী সাহাবী, বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবু মাখশী আত-তাঈ (রা.)। আরেকজন সাহাবী হযরত ওয়াহহাব বিন আবি সারাহ (রা.)। আরেকজন সাহাবী হযরত তামীম (রা.), তিনি বনু গানাম আস-সিলমের মুক্তকৃত দাস ছিলেন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবুল হামরা (রা.), তিনি হযরত হারেস বিন আফরার মুক্তকৃত দাস ছিলেন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবু সাবরা বিন আবি রুহম (রা.), তিনি মহানবী (সা.)-এর ফুফাতো ভাই ছিলেন, হযরত উসমান (রা.)-এর যুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আছেন হযরত সাবেত বিন আমর বিন যায়েদ (রা.), উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবুল আওয়ার বিন হারেস (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবস বিন আমের বিন আদি (রা.), আকাবার দ্বিতীয় বয়আতে এবং বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। আরেকজন সাহাবী হযরত আইয়াস বিন বুকায়র (রা.), দারে আরকামের যুগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কারও মতে তিনি ৩৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন, অন্য কারও মতে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত মালেক বিন নুমাইলা (রা.), তার মায়ের নাম ছিল নুমাইলা, উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত উনায়স বিন কাতাদা বিন রবীআ (রা.), তিনিও উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত হারেস বিন আরফাজা (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। আরেকজন সাহাবী হযরত রাফে বিন উনজেদা (রা.), উনজেদা ছিল তার মায়ের নাম। বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। আরেকজন সাহাবী হযরত খুলাইদা বিন কায়েস (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আরেকজন সাহাবী হযরত সাক্‌ফ বিন আমর (রা.), তিনি খায়বারের যুদ্ধে শহীদ হন। সবশেষে হুযূর (আই.) হযরত সাবরা বিন ফাতেক (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন। কারও কারও মতে তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন নি, তবে ইমাম বুখারী (রহ.) তাকে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাব্যস্ত করেছেন।

হুযূর (আই.) বলেন, এই ছিল বদরী সাহাবীদের বিবরণ। এরপর হুযূর (আই.) দু’টি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা করেন, প্রথমটি মালয়েশিয়ার মোকাররম উনকু আদনান ইসমাঈল সাহেব, যিনি মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ছিলেন, গত ৮ই অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ১৯৮৬ সালে খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) তাকে মালয়েশিয়া জামাতের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব প্রদান করেন। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররমা হামীদা বেগম সাহেবার, যিনি রাবওয়ার চৌধুরী খলীল আহমদ সাহেবের স্ত্রী ছিলেন, ৫ই অক্টোবর ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ছিলেন সিলসিলার মুরব্বী মওলানা বাশারত নযীর সাহেবের মা, এছাড়াও তার এক জামাতা ও একাধিক নাতি ওয়াক্‌ফে যিন্দেগী হিসেবে জামাতের সেবায় রত রয়েছেন। হুযূর (আই.) উভয়ের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।