শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৫-অক্টোবর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৫ই অক্টোবর, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বিগত খুতবায় আমি মহানবী (সা.)-এর একজন নিষ্ঠাবান সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করছিলাম; তার ব্যাপারে কিছু তথ্য বাকি রয়ে গিয়েছিল আমি আজ তা বর্ণনা করব। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদের ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহাবীরা বলতেন, “আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ আল্লাহ্‌র তা’লার সাথে সম্পর্ক ও নৈকট্যের ক্ষেত্রে এক অনন্য মর্যাদা রাখতেন, আর মহানবী (সা.) তাঁর যেসব সাহাবীর অনুসরণ করার ব্যাপারে বিশেষভাবে উপদেশ দিতেন, তাদের মধ্যে হযরত আবু বকর ও উমর (রা.)-এর পাশাপাশি আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদের নামও বলতেন। মহানবী (সা.) বিশেষভাবে তার ওপর আস্থা রাখতেন, আর তিনিও (রা.) মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা রাখতেন। মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য তাকে এক পরম মুত্তাকী, পরহেযগার ও ইবাদতকারী ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। ইবাদতের প্রতি তার এত গভীর আকর্ষণ ছিল যে, ফরয ও তাহাজ্জুদ নামাযের মত চাশতের নামাযও নিয়মিত পড়তেন। প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন, তারপরও মনে করতেন রোযা কম রাখা হচ্ছে। তিনি স্বয়ং বলেছেন, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এর চেয়ে বেশি রোযা এজন্য রাখি না, কারণ তখন তাহাজ্জুদ নামায পড়ার সময় শারীরিক দুর্বলতা অনুভব হয়। নামাযের গুরুত্ব রোযার চেয়ে বেশি বিধায় এমনটি করি।

একবার মহানবী (সা.) লোকদেরকে সংক্ষিপ্ত ওয়াজ-নসীহত করার পর হযরত আবু বকর (রা.)-কে নসীহত করতে বলেন, তিনি (রা.) সংক্ষেপে নসীহত করেন। এরপর মহানবী (সা.) হযরত উমরকেও নসীহত করতে বলেন, তিনি আরও সংক্ষিপ্ত নসীহত করেন। এরপর তিনি (সা.) আরেকজনকে নসীহত করতে বললে, তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করেন। মহানবী (সা.) তাকে থামিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদকে নসীহত করতে বলেন। আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.) আল্লাহ্ তা’লার গুণকীর্তণ করে শুধু এতটুকুই বলেন, “হে লোকসকল! আল্লাহ্ আমাদের প্রভু, কুরআন আমাদের গ্রন্থ, কা’বা আমাদের কিবলা ও মুহাম্মদ (সা.) আমাদের নবী।” আরেক বর্ণনানুসারে তিনি বলেন, আমরা এতেই খুশি যে, “আল্লাহ্ আমাদের প্রভু-প্রতিপালক এবং ইসলাম আমাদের ধর্ম; আমি তোমাদের জন্য তা-ই পছন্দ করি যা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.) পছন্দ করেন।” মহানবী (সা.) বলেন, ইবনে মাসউদ যথার্থ বলেছে, আর আমিও আমার উম্মতের জন্য তা-ই পছন্দ করি যা ইবনে মাসউদ পছন্দ করেছে।

হযরত আলী (রা.) যখন কুফায় যান, তখন লোকজন তার কাছে আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদের খুব প্রশংসা করে। তখন আলী (রা.) সবাইকে আল্লাহ্‌র কসম দিয়ে বলেন, “সত্যি করে বল, এই সাক্ষ্য কি তোমরা মন থেকে দিচ্ছ? সবাই ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিলে তিনি (রা.) বলেন, হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাক, আমিও তার সম্পর্কে অনুরূপ মত পোষণ করি, বরং এর চেয়েও বেশি উত্তম মত পোষণ করি।”

হযরত ইবনে মাসউদ তার ধর্মভাই হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনও খুব উত্তমরূপে রক্ষা করেছেন। তার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে ওসীয়্যত করে যান, আমার যাবতীয় আর্থিক বিষয়াদির দেখ-ভাল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও তার পুত্র আব্দুল্লাহ্ বিন যুবায়ের করবে, আর পারিবারিক বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত ইবনে মাসউদ (রা.)-এর আনুগত্যের অসাধারণ ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যার উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, “একবার হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ মহানবী (সা.)-এর কাছে আসছিলেন, গলিপথে থাকা অবস্থাতেই তিনি মহানবী (সা.)-কে বলতে শোনেন- ‘বসে পড়’। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই বসে পড়েন ও বাচ্চাদের মত হামাগুড়ি দিয়ে মসজিদের দিকে এগোতে থাকেন। এটি দেখে একজন বলে বসে, ‘এ কেমন মুর্খতা! মহানবী (সা.) তো যারা মসজিদের ভেতরে ছিল তাদেরকে বসতে বলেছেন, আর আপনি গলিতেই বসে পড়লেন? আপনার উচিত ছিল মসজিদে গিয়ে তারপর বসা’। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) তাকে বলেন, ‘ঠিকই বলেছেন, সেটি করা যেত; কিন্তু যদি মসজিদে পেীঁছার আগেই আমি মারা যেতাম তাহলে তো মহানবী (সা.)-এর এই নির্দেশ আমার পালন করা হতো না!’ এই ছিল তার আনুগত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য”।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ তার আনুগত্যের আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেন, “হযরত উসমান (রা.) তার খিলাফতকালে একবার হজ্জের সময় কসরের দু’রাকাত নামাযের বদলে চার রাকাত নামায পড়িয়েছিলেন। অথচ মহানবী (সা.) এবং হযরত আবু বকর ও উমর (রা.) তাদের খিলাফতকালে হজ্জের সময় দু’রাকাতই পড়েছিলেন। এতে লোকজন উসমান (রা.)-কে গিয়ে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে, তিনি কেন এমনটি করলেন? তিনি (রা.) উত্তর দেন যে, ‘যেহেতু তখন অনেক মানুষ নতুন মুসলমান হয়েছিল এবং তাদের যথাযথ তরবীয়তও ছিল না, তাই তারা পরবর্তীতে নিজ দেশে গিয়ে ভুলবশতঃ এটি বলে বসতে পারে যে, আমরা খলীফাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দেখেছি, কাজেই দু’রাকাত পড়াই বিধেয়’। এমন ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার আশংকা থেকেই তিনি চার রাকাত পড়েছেন। তাছাড়া যেহেতু মক্কা তার শ্বশুরবাড়ি ছিল, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও তিনি কসর করার পরিবর্তে পুরো নামায পড়াই যৌক্তিক মনে করেছেন- এটিও হযরত উসমান ব্যাখ্যা করে দেন। কতিপয় বিশৃঙ্খলা-পরায়ণ লোক এ ব্যাখ্যা শোনার পরও তা ইবনে মাসউদের কাছে গিয়ে অভিযোগের সুরে বলতে থাকে। তখন ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “দেখ! বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা আমাদের কাজ না। খলীফা অবশ্যই কোন যৌক্তিক কারণে বা প্রজ্ঞার অধীনে এমনটি করেছেন; আনুগত্যের খাতিরে আমিও তার পেছনে চার রাকাতই পড়েছি, তবে নামায শেষে হাত উঠিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে এই দোয়াও করেছি, হে আল্লাহ্! এই চার রাকাত থেকে কেবল সেই দু’রাকাতই কবুল করো যা আমরা রসূলুল্লাহ্‌র সাথে পড়তাম, বাকি দু’রাকাত নয়”। এটি ছিল তার রসূলপ্রেমের ও খলীফার আনুগত্যের অবস্থা; এটি সেই আদর্শ যাতে প্রত্যেক আহমদীর জন্য পথের দিশা রয়েছে।

হযরত ইবনে মাসউদ মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসারে কেবল বৃহস্পতিবার ওয়াজ-নসীহত করতেন, আর তা অতি সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হতো। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় মহানবী (সা.)-এর কেবল একটি হাদীসই দরস হিসেবে প্রদান করতেন, আর তা বর্ণনা করার সময় তার আবেগ ও রসূলপ্রেমের ব্যাকুলতা দেখার মত হতো। বর্ণনাকারীরা বলেন, তিনি মহানবী (সা.)-এর বাণী উদ্ধৃত করার ব্যাপারে এতটা সতর্ক ও সন্ত্রস্ত থাকতেন যে, পাছে কোন শব্দ আবার ভুল না বলে ফেলেন, তাই বলতে গিয়ে তিনি কেঁপে উঠতেন ও বলে দিতেন, ‘এরকমই কিছু মহানবী (সা.) বলেছিলেন’।

হযরত আয়মন বিন হারাম (রা.) বর্ণনা করেন যে, “আমি মহানবী (সা.)-এর অনেক সাহাবীর বৈঠকে সবার সুযোগ পেয়েছি কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা.)-এর মত এরূপ জগতবিমুখ এবং পরকালের প্রতি লালায়িত আর কাউকে দেখিনি”।

হুযূর (আই.) দ্বিতীয় যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করেন তিনি হলেন, হযরত কুদামা বিন মাযউন (রা.); তিনি হযরত উসমান বিন মাযউনের ভাই ও উমরের বোন সাফিয়ার স্বামী ছিলেন। তার একাধিক স্ত্রী ছিলেন, আবু সুফিয়ানের কন্যা ফাতেমাও তার একজন স্ত্রী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। মদীনায় হিজরতের সময় তাদের পুরো পরিবার মক্কায় নিজেদের ঘরবাড়ি সব ছেড়ে হিজরত করেন। তিনি আবিসিনিয়া ও মদীনা- উভয় হিজরতেই অংশ নিয়েছিলেন। বদর, উহুদসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

হযরত উসমান বিন মাযউন (রা.) মৃত্যুর সময় এক কন্যা রেখে যান এবং তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব অর্পণ করে যান হযরত কুদামার ওপর। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.), যিনি তাদের উভয়েরই ভাগ্নে ছিলেন, কুদামার কাছে গিয়ে উসমান বিন মাযউনের কন্যাকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। হযরত কুদামা সেটি চূড়ান্ত করেন। ইতোমধ্যে মুগীরা নামক আরেক ব্যক্তি গিয়ে পাত্রীর মায়ের কাছে প্রস্তাব দেয় এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। মা-মেয়ে উভয়েই তার ব্যাপারে আগ্রহী হন। যখন বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর কাছে যায়, তখন তিনি (সা.) কুদামাকে ডাকেন। কুদামা জোর দিয়ে বলেন, সে আমার ভাতিজি, আমি তার বিয়ের ব্যাপারে কক্ষণও অবহেলা করব না, উত্তম সম্বন্ধই আমি ঠিক করেছি। কিন্তু মহানবী (সা.) বলেন, “যেহেতু সে এতীম মেয়ে, তাই তার বিয়ে তার ইচ্ছে মোতাবেক হবে। নিঃসন্দেহে তুমি সর্বোত্তম সম্বন্ধ প্রস্তাব করেছ, কিন্তু এতীম বিধায় তার পছন্দকে প্রাধান্য দিতে হবে”। এভাবে মহানবী (সা.) নারীদের মতামতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন; বিশেষভাবে এতীম মেয়েদের বেলায় লক্ষ্য রাখতে বলেছেন, যেহেতু তার বাবা বেঁচে নেই তাই তার ওপর যেন কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া না হয়। হযরত কুদামা ৩৬ হিজরিতে ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

হুযূর (আই.) দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা ধর্মের গভীর ব্যুৎপত্তি, আনুগত্য ও নিষ্ঠার খাঁটি উপমা এবং রসূলপ্রেমের অত্যুন্নত মানের অধিকারী এসব সাহাবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদেরকেও এসব নেকী ও পুণ্য অর্জনকারী হবার তৌফিক দিন, আর সর্বপ্রকার বিশৃঙ্খলার কারণ হওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) দু’টি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা করেন, প্রথমটি করাচির মোকাররমা আমাতুল হাফিয ভাট্টি সাহেবার, যিনি ২৭ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার পিতা ডা. গোলাম মালী হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররম আদনান সাহেবের, যিনি বেলজিয়ামের ন্যাশনাল সেক্রেটারি উমুরে খারেজা ছিলেন, গত ৯ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। তার পিতা রেজওয়ান সাহেব প্রথম বেলজিয়ান আহমদী ছিলেন, যিনি ষাটের দশকে বয়আত করে আহমদী হয়েছিলেন। হুযূর (আই.) উভয়ের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের মর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য দোয়া করেন।