সালানা জলসা জার্মানী ও বেলজিয়াম – ২০১৮ এর পর্যালোচনা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২১-সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে গত দু’সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জার্মানি ও বেলজিয়ামের বার্ষিক জলসা সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং কর্মীদের জন্য দোয়ার আবেদন জানিয়ে খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, সম্প্রতি আল্লাহ্ তা’লা আমাকে জার্মানি ও বেলজিয়ামের জলসায় অংশগ্রহণের সৌভাগ্য দান করেছেন; আর এমটিএ-তে সম্প্রচারের সুবাদে সবাই জানেন, উভয় জলসাই অত্যন্ত কল্যাণমন্ডিত ছিল। জার্মানির জামাত বেশ বড়, আর তাদের জলসায় খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) এবং তাঁর পর আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করার ফলে এখন তাদের জলসার আয়োজন অনেকটাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। এবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও অনেক দেশ থেকে এমনকি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকেও আহমদীরা এ জলসায় অংশ নিয়েছেন, আর বরাবরের মতই অ-আহমদী অতিথিরা অনেক সুন্দর মনোভাব ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। উভয় জলসাতেই এমনটি ঘটেছে। অমুসলমান অতিথিরা এ অভিমতই প্রকাশ করেছেন যে, আপনাদের জলসা দেখে ইসলামের খাঁটি শিক্ষা কী তা অবগত হওয়া যায়। প্রচার মাধ্যম ইসলাম সম্পর্কে যে ভয়ংকর চিত্র ফুটিয়ে তোলে তা একজন প্রকৃত মুসলমানের আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। জলসায় এসে তারা প্রত্যেক আহমদীকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যে, ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের এই অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষামালা তারা কতটা পালন করছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে জলসার প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী ও অংশগ্রহণকারী এক নীরব তবলীগের ভূমিকা পালন করে, অমুসলমানদের মন-মস্তিষ্ক থেকে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করার ও অ-আহমদীদের মন থেকে তথাকথিত আলেম-উলামা কৃর্তক সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা দূর করার কাজ করে থাকে। তাছাড়া অতিথিরা জলসার স্বেচ্ছাসেবক ও তাদের আচার-ব্যবহারেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। বেলজিয়ামের জলসায়ও এমনটি-ই হয়েছে, তাদের জলসাও অত্যন্ত কল্যাণময় ও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ছোট জামাত হলেও তারা তাদের জামাতের চেয়ে অধিক সংখ্যক অতিথির জন্য সুষ্ঠু আয়োজন করেছে, আর অমুসলমান অতিথিরা সেখানেও জামাতের অনেক প্রশংসা করেছে।

হুযূর (আই.) বলেন, জলসা যেখানেই হোক না কেন, আল্লাহ্‌র অপার কৃপায় তা অ-আহমদীদের ওপর সুপ্রভাব সৃষ্টি করে আর এভাবে তবলীগের পথ সুগম হয়। তাই প্রত্যেক সদস্যের সর্বদা একথা দৃষ্টিপটে রাখা উচিত, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার পর আমাদের নিজেদের ব্যবহারিক অবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ থেকে খোদ্দামুল আহমদীয়া, যুক্তরাজ্যের বার্ষিক ইজতেমা শুরু হতে যাচ্ছে, তাই আমি খোদ্দামুল আহমদীয়ার সদস্যদেরকেও স্মরণ করাচ্ছি, তারা যেন এমন আচার-আচরণ করে যা প্রতিবেশীদের ওপর সুপ্রভাব সৃষ্টি করবে। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এই ইজতেমাকে সবদিক থেকে কল্যাণমন্ডিত করুন এবং বৈরী আবওহাওয়া থেকে আপনাদেরকে নিরাপদ রাখুন। জলসা সার্বিকভাবে সফল হয়েছে বলে হুযূর (আই.) খোদা তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং উভয় জলসার কর্মীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কেননা, তারা জলসার অতিথিদের সর্বাত্মক সেবা করার চেষ্টা করেছে। একইসাথে হুযূর (আই.) সকল অংশগ্রহণকারীকেও কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলেন, অন্যদিকে কর্মীদেরকেও সেবা প্রদানের সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলেন এবং ভবিষ্যতে আরও সুন্দরভাবে কীভাবে কাজ করা যায় সে সম্পর্কে প্রণিধান করার আহ্বান জানান। একটি ভুলের দিকে হুযূর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পুরুষদের জলসাগাহে একটি নযম পড়া হয়েছিল যার সূর যথাযথ ছিল না বা জামাতের রীতি সম্মত ছিল না। আমাদেরকে জামাতের রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। হুযূর (আই.) বলেন, জলসার অধিবেশনগুলোতে কেবল মসীহ্ মওউদ (আ.) ও তাঁর খলীফাদের নযম-ই যেন পড়া হয়, ভবিষ্যতে এদিকে আয়োজকদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

এরপর হুযূর (আই.) কতিপয় অতিথির অভিব্যক্তি তুলে ধরেন, যা থেকে বুঝা যায় যে, জলসার কল্যাণরাজির প্রভাব কেবল আহমদীদের ওপরই পড়ে না, বরং অ-আহমদীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।

বসনিয়ার একজন অ-আহমদী মসজিদের ইমাম জলসায় এসেছিলেন, তিনি জলসার পূর্বে একটি তবলীগি অধিবেশনে যোগ দিয়ে বলেন, আমি স্বয়ং আহমদীয়া জামাতের ব্যাপারে গবেষণা করে দেখতে চাই যাতে ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে জামাত সম্পর্কে কোন মতামত দিতে পারি। জলসায় যোগদানের পর এই উদারমনা ইমাম বলেন, আহমদীদের মাঝে কিছু সময় অবস্থানের পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, আপনারাই সেসব লোক যারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সঠিকভাবে প্রচার করছেন। জলসার পর তিনি জামেয়া আহমদীয়া ঘুরে দেখার সুযোগ লাভ করেন। তিনি আহমদীদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সুব্যবস্থা দেখে প্রশংসা করেন এবং উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ মুসলমানদের উদাসীনতার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। হুযূর (আই.)-এর সাথে সাক্ষাতে তিনি বারাহীনে আহমদীয়া ও তাযকেরা পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে হুযূর (আই.) তাকে ইসলামী নীতিদর্শন ও দাওয়াতুল আমীর পড়ার পরামর্শ দেন।

বুলগেরিয়া থেকে ৫৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন অ-আহমদী। তাদের মাঝ থেকে একজন ভদ্রমহিলা বলেন, “আমি অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছি, কিন্তু আহমদীদের জলসার মত এরূপ আধ্যাত্মিক পরিবেশ কোথাও দেখিনি। খলীফার বক্তৃতা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে, বক্তৃতার সময় আমি কাঁদতে থাকি আর মনে হচ্ছিল, আমি এক নতুন জীবন লাভ করছি”।

এক খ্রিস্টান ভদ্রমহিলা স্বামী-সন্তানসহ জলসায় এসেছিলেন, তিনি বলেন, “জলসার বিভিন্ন বক্তৃতা থেকে আমি পিতা-মাতার সম্মান ও সন্তানদের তরবিয়ত সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি, এসব শিক্ষা আমি আমার পরিবারেও পালন করতে চেষ্টা করব। আহমদী পুরুষরা যেভাবে নারীদের সম্মান করে, এমনটি আমি খ্রিস্টানদের মাঝে কখনো দেখি নি”।

মুহাম্মদ ইউসুফ নামের একজন অ-আহমদী মুসলমান বন্ধু বলেন, “আমি প্রথমবার এই জলসায় অংশ নিচ্ছি, জামাতের বিরুদ্ধে অনেক কিছু শুনেছিলাম, জলসা দেখে আমার মন একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। জলসা চলাকালীনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন আমি আহমদীয়াত গ্রহণ করছি”।

লাটভিয়া থেকে আগত একজন অ-আহমদী পাকিস্তানি মুসলমান ছাত্র বলেন, “এমন ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ আমি সারা জীবনে কোথাও দেখিনি। অমুসলমানদের ওপর ইসলামের অসাধারণ ইতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখে খুবই ভাল লেগেছে। জলসার যাবতীয় কার্যক্রম, বক্তৃতা, নামায ইত্যাদি দেখে এখন আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, আমার ফিরকা সঠিক না-কি আহমদী জামাত সঠিক?”

লাটভিয়া থেকে আগত আরেক খ্রিস্টান ছাত্রী বলেন, “আমি এটি দেখে খুব আনন্দিত হই যে, এখনও পৃথিবীতে এমন একদল মানুষ আছে যারা সমগ্র জগদ্বাসীর মঙ্গল কামনা করে”।

জর্জিয়া থেকেও বড় একটি দল এসেছিল যাতে দু’জন পাদ্রি, দু’জন মুফতি, শিয়া ও সুন্নীদের কয়েকজন নেতা প্রমূখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে একজন অ-আহমদী ইমাম সাহেব বলেন, “এখানে এসে আমি ইসলাম সম্পর্কে অনেক নতুন বিষয় শিখেছি যা আগে জানতাম না”।

হাঙ্গেরী থেকে আগত এক ভদ্রলোক বলেন, “হাঙ্গেরীতে এতজন তো দূরের কথা, শ’খানেক লোক একস্থানে সমবেত হলেও সেখানে কোন না কোন লড়াই-ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের এমন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আমি আজ পর্যন্ত কোথাও দেখি নি”। মেসিডোনিয়া থেকেও বড় একটি দল এসেছিল। লিথুনিয়া থেকে ৫০ জনের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল। তাদের মাঝে একজন খ্রিস্টান লেখক ছিলেন যিনি ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করতে এসেছে। তিনি বলেন, “ইবাদত করাই সব নয়, বরং খোদাকে খুশি করাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- এই কথাটি আমার মন জয় করে নিয়েছে। আমি দেশে ফিরে গিয়ে আহমদীয়া জামাত সম্পর্কে সংবাদপত্রে লিখব, আর নিজের ম্যাগাজিনের পুরো একটি সংখ্যা এ বিষয়েই ছাপাব। আমি জানি এসব লিখলে অনেক বিরোধিতার সম্মুখীন হব, কিন্তু এরপরও আমি সত্যের পাশে থাকতে চাই। এখানে এসে আমি অত্যন্ত আনন্দিত”।

আলবেনিয়া থেকে আগত একজন মুসলমান ভদ্রলোক বলেন, “আমি আহমদীয়াতের চরম শত্রু ছিলাম, আমার ভাই ও এক বন্ধু আহমদী হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ আমাদের দু’ভাইয়ের মাঝে সিদ্ধান্ত হয়, উভয়েই দোয়া করব, যে সত্য সে জিতে যাবে। ক্রমাগত দোয়ার ফলে অবশেষে তিনি আহমদীয়াতের সত্যতা অনুধাবন করেন ও বয়আত করার সৌভাগ্য লাভ করেন”।

হুযূর (আই.) জলসার মিডিয়া কভারেজ সম্পর্কেও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। জার্মানির জলসায় বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ৬ কোটি ২৭ লক্ষ ৫৭ হাজার মানুষের কাছে আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁছেছে, যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আর বেলজিয়ামের জলসার সংবাদও প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে চল্লিশ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

খুতবার শেষ দিকে হুযূর (আই.) দোয়া করে বলেন, “আল্লাহ্ তা’লা জলসার সুদূরপ্রসারী ও পুণ্যময় প্রভাব সৃষ্টি করতে থাকুন”। (আমীন)

হুযূর (আই.) কয়েকটি গায়েবানা জানাযারও ঘোষণা করেন। প্রথম জানাযা কানাডার সৈয়দ হাসনাত আহমদ সাহেবের, যিনি গত ২৭ আগস্ট ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন; দ্বিতীয় জানাযা ইন্দোনেশিয়ার মুবাল্লিগ হাফেয কুদরতুল্লাহ্ সাহেবের স্ত্রী মোবারকা শওকত সাহেবার, যিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর ৯৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন; তৃতীয় জানাযা অস্ট্রেলিয়ার নায়েব আমীর চৌধুরী খালেদ সাইফুল্লাহ্ সাহেবের, তিনি গত ১৬ সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন; ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হওয়ার জন্য দোয়া করেন, আমীন।