সালানা জলসা বেলজিয়াম – ২০১৮

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৪-সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ব্রাসেলস, বেলজিয়াম

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরের জলসাগাহ থেকে বেলজিয়াম জামাতের ২৫তম বার্ষিক জলসা উপলক্ষে একজন আহমদী হিসেবে ধর্মকে পার্থিবতার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান ও জলসার মাধ্যমে নিজ জীবনে আধ্যাত্মিক পরিবর্তন সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে খুতবা প্রদান করেন।

হুযুর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় আজ থেকে বেলজিয়াম জামাতের বার্ষিক জলসা আরম্ভ হচ্ছে। অনেকদিন পর আমি আপনাদের জলসায় অংশগ্রহণ করছি। এই সময়ের ভেতর এখানে জামাতের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে, পাকিস্তান থেকে নতুন অনেকেই এখানে হিজরত করে এসেছেন, এছাড়া বিভিন্ন দিক দিয়ে জামাত উন্নতি করেছে যেমন মিশন হাউজ, মসজিদ, নামায সেন্টার ইত্যাদির সংখ্যা বেড়েছে। বাহ্যিকভাবে তো জামাতের বেশ উন্নতি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার এই কৃপার ফলে জামাতের সদস্যদের মাঝেও এই অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া উচিত, আমরা যেন আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলী বুঝা, অনুধাবন করা, মানা ও পালন করার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই পূর্বের চেয়ে অগ্রগামী হই। আর কেবল অগ্রসর হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং আমাদের প্রতিটি দিন ও পদক্ষেপ পূর্বের দিন ও পদক্ষেপের চেয়ে পুণ্য, তাকওয়া ও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আগমনের উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে উন্নত হওয়া উচিত। যদি আমরা এমনটি করি, তবে গিয়ে আমরা বলতে পারবো যে, আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আগমনের উদ্দেশ্য পূরণের ও তাঁর হাতে বয়আতের পালনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এই বিষয় স্মরণ করে সর্বদা আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত। বিশেষ করে এসব উন্নত দেশে এসে, যেখানে তথাকথিত স্বাধীনতার নামে ধর্মীয় অনুশাসন একেবারে শিথিল বা এর প্রতি কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। এখানে বসে আমাদেরকে এসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন; নতুবা ধর্মের কারণে এখানে এসে ধর্ম ভুলে গিয়ে পার্থিবতায় মগ্ন হয়ে যাওয়া আমাদেরকে আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টির শিকারে পরিণত করবে। এখানে আগতদের অধিকাংশই নিজ দেশে স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারছিলেন না বলে এখানে এসেছেন; এখন যদি আল্লাহ্‌র আদেশ পালন না করেন তাহলে তা খোদার অসন্তুষ্টির কারণ হবে। তবে মানুষ দুর্বল, দুর্বলতার কারণে পার্থিবতার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। একটি সীমা পর্যন্ত পৃথিবীর দিকে মনোযোগ দেয়া ও পৃথিবী অর্জন করা নিষেধ নয়, কিন্তু জগতপূজারীদের মত এতে নিমগ্ন হয়ে যেতে আল্লাহ্ তা’লা বারণ করেছেন। আর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও এ বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, খোদা তা’লা পার্থিব কাজ-কর্মকে সিদ্ধ করেছেন, কেননা তা না হলে এদিক থেকে মানুষ পরীক্ষায় নিপতিত হয়, যার পরিণতিতে মানুষ চোর, প্রতারক বা ডাকাতে পরিণত হয়। কিন্তু এরও একটি সীমা আছে, পার্থিব কাজ-কর্ম ততটুকু পর্যন্ত কর, যা ধর্মের পথে তোমাদের সহায়ক হয়, আর এর মূল ও মূখ্য উদ্দেশ্য যেন হয় ধর্ম। জীবিকা ও স্ত্রী-সন্তানদের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ উপার্জন করতে হবে, কিন্তু তাতে এতটা নিমগ্ন হওয়া উচিত নয় যে, সে ধর্মই ভুলে যাবে আর পৃথিবীকে ঘিরেই যাবতীয় চিন্তায় রত হবে। যখন কেউ পার্থিবতায় নিমগ্ন হয়ে যায়, তখন সে ধর্ম থেকেই বঞ্চিত হয়ে যায়; এমতাবস্থায় তার ধর্মের বা বয়আতের বা আল্লাহ্‌র ওপর বিশ্বাসের দাবী কেবল মৌখিক দাবী, বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই।

আরেক স্থানে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ইসলামে সন্ন্যাসব্রতকে বারণ করা হয়েছে, এটি কাপুরুষতা। মুমিন পৃথিবীর কর্মকান্ডে যতটা সম্পৃক্ত হয়, ততটাই তার মর্যাদা উন্নত হওয়ার কারণ হয়; কেননা তার লক্ষ্যবস্তু সর্বদা ধর্ম হয়ে থাকে, আর পার্থিব সম্মান ও সম্পদ ধর্মের সেবক হয়। সম্পদ এমন এক বাহন, যাতে চড়ে মানুষ ধর্মের উচ্চ শিখরে আরোহণ করবে। পৃথিবী অর্জন করে তা ধর্মের সেবায় নিয়োজিত কর, নিজে পৃথিবীর চাকর হয়ে যেও না।

তিনি (আ.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা যে এই দোয়া শিখিয়েছেন- রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসনাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাহ- এতে পৃথিবীর কথা আগে রেখেছেন। কিন্তু পৃথিবীর কোন জিনিস? পৃথিবীর কল্যাণময় বিষয়, যা পরকালের জন্য কল্যাণের কারণ হয়! তিনি (আ.) বলেন, এই দোয়ার শিক্ষা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, মুমিনকে পৃথিবী অর্জনের ক্ষেত্রে পরকালের কল্যাণকে দৃষ্টিপটে রাখতে হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, কাজেই আমাদের প্রত্যেকের এভাবে পার্থিব কল্যাণ লাভের চেষ্টা করা উচিত যেন তা পারলৌকিক মঙ্গলের কারণ হয়; আমরা যেন পৃথিবীর চাকচিক্য দেখে আসল উদ্দেশ্য ভুলে না যাই, আর পারলৌকিক মঙ্গলের পরিবর্তে আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টির লক্ষ্যে পরিণত না হই। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, পৃথিবীর আকর্ষণ মানুষের মাঝে এক রকম অপবিত্র লোভ সৃষ্টি করে তার পিপাসা বাড়িয়ে দেয়, আর এই তৃষ্ণা তার মাঝে চাহিদার এমন এক আগুন সৃষ্টি করে দেয় যা মানুষের মনকে শান্ত হতে দেয় না, বরং সর্বদা উৎকন্ঠিত রাখে। তিনি (আ.) বলেন, সম্পদ ও সন্তান এজন্যই পরীক্ষা বলে আখ্যায়িত হয়েছে, কারণ তা বান্দা ও খোদার মাঝে এক অন্তরায় সৃষ্টি করে। যখন তাকে এগুলো থেকে পৃথক করা হয়, তখন সে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। পাথরের সাথে পাথরের ঘর্ষণে যেভাবে আগুন সৃষ্টি হয়, তেমনি পার্থিবতার প্রতি মানুষের ভালোবাসার ফলে আল্লাহ্‌র ভালোবাসা পুড়ে যায়। কিন্তু এই ভালোবাসা যদি খোদার প্রতি হয়, তবে তার ঘর্ষণে আল্লাহ্ ছাড়া আর সবকিছুর ভালোবাসা পুড়ে ভষ্মিভূত হয়ে যায়, আর সেই হৃদয়ে জ্যোতি বা আলো সৃষ্টি হয় এবং তার ইচ্ছা খোদার ইচ্ছায় বিলীন হয়ে যায়।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মানার সৌভাগ্য দান করেছেন, যিনি বারংবার আমাদেরকে খোদার পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার উপায় বাতলে দিয়েছেন। আবার তিনি (আ.) আল্লাহ্‌র নির্দেশে এই জলসার আয়োজন করেছেন যেন আমরা বছরে একবার একত্রিত হয়ে নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির ব্যবস্থা করতে পারি। তাই প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে যেন আমরা আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জনকারী হই, ধর্মকে অগ্রগণ্য করি, জগতকে ধর্মের সেবকে পরিণত করি, আর নিজ সন্তানদের মাঝেও এই স্পৃহা সৃষ্টি করি।

মসীহ্ মওউদ (আ.) একবার জলসার আয়োজন করেন নি, আর এর যে কারণ তিনি বর্ণনা করেছিলেন তা হল- এই জলসার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের জামাতের লোকেরা যেন বারবার সাক্ষাতের মাধ্যমে নিজেদের ভেতর এমন এক পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করবে, যার ফলে তাদের হৃদয় পুরোপুরি পরকালের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মাঝে খোদাভীতি সৃষ্টি হবে এবং তারা খোদাভীতি, সাধুতা, নম্রতা ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য আদর্শস্থানীয় হবে। যদি এগুলো অর্জিত না হয়, তবে অযথা জলসা আয়োজন করার কোন অর্থ নেই।

হুযুর (আই.) বলেন, সেই যুগে যদি তিনি (আ.) কয়েকজনের সামান্য ত্রুটির কারণে এতটা কঠোর কথা বলে থাকেন, তাহলে আমাদেও ভেবে দেখা উচিত যে, এ যুগে আমাদের মধ্যে কতজন সেই দলের মধ্যে পড়ে! নিঃসন্দেহে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের ফলে যে প্রভাব সৃষ্টি হতো তা অনেক জলসার চেয়েও বেশি; কিন্তু এ যুগেও যেসব জলসা আয়োজন করা হয়, সেগুলোতেও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সেসব কথাই উপস্থাপন করা হয়, উপরন্তু কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যাও আলোচনা করা হয়; আর একাধিক জলসা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলোতে অংশগ্রহণও করা যায়, অনেকেই একাধিক জলসায় সশরীরে অংশ করে থাকে- কিছুটা হলেও এর ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হওয়া উচিত! হুযুর (আই.) তাই এমটিএ-র মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার, হুযুরের খুতবাসমূহ ও জলসাসমূহ দেখার-শোনার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন যেন এগুলোর মাধ্যমে মানুষ নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। আর যারা ইউরোপে চলে এসেছেন, হুযুর তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বিশেষভাবে বলেন, যেহেতু আপনারা এখানে চলে এসেছেন এবং জলসা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন, আপনাদের চেষ্টা করা উচিত- জলসা দ্বারা উপকৃত হয়ে নিজেদের জীবনে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করা। হুযুর জলসার পুরো অনুষ্ঠান মনোযোগের সাথে শোনার ব্যাপারে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কড়া নির্দেশনাও তুলে ধরেন।

হুযুর (আই.) খুতবার শেষ দিকে দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা বেলজিয়ামের জলসাকে সার্বিকভাবে কল্যাণমন্ডিত করুন, সবাই জলসার দিনগুলোতে অনেক দোয়া করুন, নামাযের প্রতি মনোযোগী থাকুন, আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দোয়ার উত্তরাধিকারী করুন, আমীন।