শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৪-আগস্ট, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৪শে আগস্ট, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আসেম বিন সাবেত (রা.), হযরত সাহল বিন হুনায়ফ আনসারী (রা.), হযরত জব্বার বিন সাখ্‌র (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, মহানবী (সা.)-এর একজন সাহাবী ছিলেন হযরত আসেম বিন সাবেত (রা.)। তাঁর পিতা ছিলেন সাবেত বিন কায়েস, মাতা শামুস বিনতে আবু আমের। মহানবী (সা.) তাকে ও হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন। উহুদের যুদ্ধে যখন এক পর্যায়ে মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দেয়, তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর পাশে দৃঢ়-অবিচল ছিলেন; উহুদের দিন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে আমৃত্যু সত্যের ওপর অবিচল থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর একজন সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। আওস গোত্রভুক্ত ছিলেন, তিনি বদরের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের দিন মহানবী (সা.) সাহাবীদের প্রশ্ন করেন, তোমরা যখন শত্রুর মুখোমুখি হবে, তখন কীভাবে যুদ্ধ করবে? তখন আসেম (রা.) উত্তর দেন, যখন তারা আমাদের তীরের নাগালে আসবে তখন তীর নিক্ষেপ করতে হবে, যখন এতটা কাছে আসবে যে পাথর নাগাল পায় তখন পাথর ছুঁড়তে হবে, যখন বর্শার নাগালে আসবে তখন বর্শা ছুঁড়তে হবে, আর যখন বর্শা ভেঙে যাবে তখন তরবারি দিয়ে তাদের হত্যা করতে হবে। একথা শুনে মহানবী (সা.) বলেন, এভাবেই যুদ্ধ করতে হয়। যারা যুদ্ধ করবে, তারা যেন আসেম বর্ণিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে।

হুযূর (আই.) বলেন, সে যুগে মুসলমানরা এভাবেই যুদ্ধ করতো, এখন তো বোমাবর্ষণ করে নিরীহ শিশু ও বেসামরিক লোকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। একজন অমুসলমান লেখক মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে লিখেন, তোমরা মুহাম্মদ (সা.)-এর যুদ্ধের ওপর আপত্তি কর; তাঁর সব যুদ্ধে তো বড়জোড় কয়েকশ’ বা হাজারখানেক লোক নিহত হয়েছিল, অথচ তোমরা উন্নত ও মানবিক হবার দাবীদাররা কেবল একটি যুদ্ধেই, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, সাত কোটির ওপর লোককে হত্যা করেছ, যাদের অধিকাংশই ছিল নিরীহ জনগণ। দুঃখজনক ব্যাপার হল, আজ মুসলমানরা এদেরই সাহায্য নিয়ে নির্বিবাদে নিরীহ মুসলমানদেরই হত্যা করছে।

বর্ণিত হয়েছে, হযরত আলীর তরবারি উহুদের দিন অতিরিক্ত লড়াইয়ের ফলে বেঁকে গিয়েছিল; তিনি সেটি ঘরে এনে হযরত ফাতেমাকে যত্ন করে রাখতে বলে বলেন, এটি আজ যুদ্ধে খুব কাজে লেগেছে। মহানবী (সা.) একথা শুনে বলেন, আজ যুদ্ধের মাঠে শুধু তুমিই নৈপুণ্য দেখাওনি, সাহল বিন হুনায়ফ, আবু দাজানা, আসেম বিন সাবেত ও হারেস বিন সিম্মাও তরবারি চালনায় নৈপুণ্য দেখিয়েছে।

বদরের যুদ্ধে আবু আয্যা নামক এক ব্যক্তি মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। সে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিজের অসহায় পাঁচ মেয়ের কথা বলে মুক্তিদানের আবেদন করে। মহানবী (সা.) দয়াপরবশ হয়ে তাকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেন। সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ভবিষ্যতে সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ করবে না এবং যুদ্ধের জন্য কাউকে সাহায্যও করবে না। কিন্তু উহুদের যুদ্ধের সময় কাফিরদের প্রলোভনে সে আবারও একাজে লিপ্ত হয়। আর যুদ্ধ শেষে সে-ই একমাত্র বন্দী হয়। এবারও সে আগের মতই মিনতি করে; কিন্তু মহানবী (সা.) বলেন, তোমার আগের বারের প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? এবার আর তোমাকে ছাড় দেওয়া হবে না, যাতে মক্কায় গিয়ে তুমি একথা বলে বেড়াতে না পারো যে, আমি দু’বার মুহাম্মদকে (সা.) ধোঁকা দিয়ে এসেছি (নাউযুবিল্লাহ্)। মহানবী (সা.) তাকে হত্যা করার জন্য আসেম বিন সাবেতকে নির্দেশ দেন।

হুযূর বলেন, এরকম ভয়াবহ প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করে শত্রুতার পর কাউকে শাস্তি দিলেও মহানবী (সা.)-এর ওপর অত্যাচারের আপত্তি তোলা হয়, যেমন হল্যান্ডের একজন রাজনৈতিক নেতা উইল্ডারস আজকাল করছে; এরা নিজেরা আগে ক্ষমার এরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক, তাহলে না হয় তাদের আপত্তি কিছুটা ঠিক বলে মানা যাবে; কিন্তু তারা তা কখনোই পারবে না।

মহানবী (সা.) ৪র্থ হিজরির সফর মাসে আসেম বিন সাবেতের নেতৃত্বে দশজন সাহাবীর একটি দলকে কুরায়শদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত করেন। কিন্তু তারা রওনা হবার আগেই আযল ও কারা গোত্রের লোকেরা তাঁর (সা.) কাছে এসে তাদের সাথে মুসলমানদের একটি তবলীগি দল পাঠানোর আবেদন করে, যার প্রেক্ষিতে তিনি (সা.) আসেমের নেতৃত্বাধীন দলটিকেই তবলীগি কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে রাজি নামক স্থানের সেই বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ বনু লহইয়ান গোত্র ষড়যন্ত্র করে এই দলটিকে হত্যা করে আর হযরত আসেমও তাতে শহীদ হন। কাফিররা প্রতিশোধ গ্রহণের নেশায় মত্ত তার লাশ ক্ষত-বিক্ষত করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভীমরুল ও মৌমাছির ঝাঁক তার লাশকে ঘিরে রাখায় তারা ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। আসেম কসম খেয়েছিলেন, কখনও মুশরিকদের স্পর্শও করবেন না, আর আল্লাহ্ আশ্চর্যভাবে মৃত্যুর পরও তাকে তা থেকে রক্ষা করেছেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, হযরত সাহল বিন হুনায়ফ আনসারী (রা.), তার পিতা ছিলেন হুনায়ফ ও মাতা হিন্দ বিনতে রাফে। মহানবী (সা.) তাকে ও হযরত আলীকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করিয়েছিলেন। তিনি বদরসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি এক মহান সাহাবী ছিলেন, কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তিনিও উহুদের দিন আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেও তিনি মহানবী (সা.)-এর সামনে দেয়ালের মত প্রতিরোধ গড়তে থাকেন ও তীর নিক্ষেপ করতে থাকেন; তীর ও বর্শা নিক্ষেপে খুবই দক্ষ ছিলেন।

খায়বার বিজয়ের পর মহানবী (সা.) কুরা নামক উপত্যকায় যান, সেখানকার ইহুদীরা আগ বাড়িয়ে তীর নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে; সেই যুদ্ধে সাহল বিন হুনায়ফও মুসলমানদের একটি পতাকা বহন করেন। যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয় ও মালে গণিমত হিসেবে বিপুল সম্পদ লাভ করে, কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের প্রতি কৃপা করেন এবং তাদের জমি-জমা তাদের কাছেই ফিরিয়ে দেন; কেবল তাদের ওপর ট্যাক্স আদায়ের জন্য একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। সিরিয়া বিজয়ের পর একদিন এক খ্রিস্টানের লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় হযরত সাহল ও কায়েস বিন সা’দ দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। এতে কেউ আশ্চর্য হয়ে এমনটি করার কারণ জিজ্ঞেস করে। তারা তখন মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও বাণী তাকে শোনান; মহানবী (সা.) বলতেন, এই ব্যক্তি কি আল্লাহ্‌র সৃষ্ট এক প্রাণ ছিল না? সিফফীনের যুদ্ধে যখন বিদ্রোহীরা পরাজয় আসন্ন দেখে কুরআনের ভিত্তিতে ফয়সালা করার দাবী জানায়, হযরত আলী (রা.) তা মেনে নেন ও যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কেউ কেউ আপত্তি করলেও হযরত সাহল সেটিকে সমর্থন করেন ও হুদাইবিয়ার ঘটনা তাদের মনে করিয়ে দেন। আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে কেউ সন্ধি করতে চাইলে মুমিনের সর্বদা সেই আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত। তবে এটি করতে গিয়ে ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়। তিনি মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে মক্কাবাসীদের কাছে এই নির্দেশনা পৌঁছিয়েছিলেন- বাপ-দাদার নামে কসম খাবে না, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার সময় কিবলার দিকে মুখ বা পেছন ফিরে বসবে না, হাড় বা গোবর দিয়ে শৌচকর্ম করবে না। উহুদের যুদ্ধে তার বীরত্বের প্রশংসা আগেই বর্ণিত হয়েছে। সিফফীন থেকে ফেরার পথে ৩৮ হিজরিতে কুফায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন, হযরত আলী (রা.) তার জানাযা পড়ান।

তৃতীয় সাহাবী হলেন, হযরত জব্বার বিন সাখ্‌র (রা.), তিনি সাখর বিন উমাইয়ার পুত্র ছিলেন। আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় বয়আত করেছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে ও মিকদাদ বিন আমরকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে বেঁধে দেন। বদরের যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৩২ বছর। মহানবী (সা.) তাকে খেজুরের ফলন হিসাব করার জন্য খায়বার ইত্যাদি স্থানে পাঠাতেন। হযরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে ৩০ হিজরিতে মদীনায় তিনি ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। বদরের যুদ্ধ অভিযানে বের হবার পর মহানবী (সা.)-এর আহ্বানে তিনি এগিয়ে আসেন এবং কুঁপ খনন ও পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে অনন্য সেবা প্রদানের সুযোগ লাভ করেন।

শা’স বিন কায়েস নামক এক বৃদ্ধ ছিল, যে ইসলামের ঘোর বিরোধী ও বিদ্বেষী ছিল। একদিন সে একদল মুসলমানকে প্রীতিময় বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে একত্রে বসে গল্প করতে দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। সে তার সাথে থাকা এক ইহুদী যুবককে সেখানে পাঠায় যেন সে পুরনো বুয়াসের যুদ্ধের ঘটনা তুলে তাদের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করে, যে যুদ্ধ আনসারদের দু’টি গোত্র অনেকদিন ধরে লড়েছিল। তার এই কূটচাল সফল হয়, কথা চলতে চলতে তা ঝগড়ার পর্যবসিত হয়। এক পর্যায়ে গিয়ে হযরত অওস বিন কায়যি ও জব্বার বিন সাখ্‌র পরস্পর লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেন। মহানবী (সা.)-এর কাছে যখন এই খবর পৌঁছায়, তখন তিনি (সা.) দ্রুত মুহাজিরদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছান এবং তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। আনসাররা বুঝতে পারেন যে, এটি একটি শয়তানি চাল ছিল, তারা সাথে সাথে পুনরায় ভ্রাতৃত্বসুলভ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ প্রেক্ষিতে কুরআনের অনেকগুলো আয়াতও নাযিল হয়। হুযূর (আই.) বলেন, এ ঘটনায় বর্তমান যুগের লোকদের জন্যও অনেক শিক্ষা রয়েছে যারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে মিথ্যা অহংকার ও আমিত্বের শিকার হয়ে যায়। সাহাবীরা যদি মুহূর্তের মাঝে অহংকার ও আমিত্ব ভুলে এক হয়ে যেতে পারেন, তবে আমরা একই জামাতের সদস্য হয়ে কেন মিথ্যা আমিত্ব বিসর্জন দিতে পারব না? আল্লাহ্ সকলকে সুবুদ্ধি দিন। (আমীন)

খুতবার শেষদিকে হুযূর বলেন, এ ছিল সাহাবীদের জীবনের কতিপয় ঘটনা। আল্লাহ্ তা’লা তাদের মর্যাদা উন্নত করতে থাকুন। (আমীন)