শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২২-জুন, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২২শে জুন, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আম্মার বিন ইয়াসের (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

তাশাহ্‌হুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর প্রথম সাড়ির একজন একনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন হযরত আম্মার বিন ইয়াসের (রা.)। তাঁর পিতা হযরত ইয়াসের (রা.)-এর আদিনিবাস ছিল ইয়েমেন। তিনি তার দু’ভাই হারেস এবং মালেকের সাথে অন্য আরেক ভাইকে খুঁজতে মক্কায় এসেছিলেন, ভাইয়েরা ইয়েমেনে ফেরত চলে গেলেও হযরত ইয়াসের (রা.) মক্কাতেই বসতি স্থাপন করেন। মক্কায় আবু হুযায়ফার সাথে তার মিত্রতা হয়; আবু হুযায়ফা নিজ ক্রিতদাসী সুমাইয়াকে তার সাথে বিয়ে দেন আর তাঁরই গর্ভে হযরত আম্মার (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের আগমন হলে হযরত ইয়াসের, সুমাইয়া, আম্মার ও তার ভাই আব্দুল্লাহ্ বিন ইয়াসের ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আম্মার স্বয়ং তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন; একদিন দারে আরকামের দরজায় সুহায়েব বিন সিনানের সাথে তার সাক্ষাত হয়, আম্মার তাকে সেখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সুহায়েব উল্টো তার কাছে তার আগমনের কারণ জানতে চান। আম্মার (রা.) বলেন, তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর কালাম শুনতে এসেছেন; সুহায়েব (রা.) বলেন যে, তার আগমনেরও একই উদ্দেশ্য। তারা দু’জনে মহানবী (সা.)-এর কাছে গেলে তিনি (সা.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন, তারা ইসলাম গ্রহণ করেন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন, পরে অন্ধকার হলে চুপিচুপি বাড়ি ফেরেন। সে সময় পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ জনের মত লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা মক্কার সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবংশের কতক লোককেও ইসলামের সেবা করার সুযোগ দিয়েছিলেন, আর গরীবদের মধ্যেও কতক সে সুযোগ লাভ করেন। হযরত আম্মার (রা.) সেসব গরীবের একজন ছিলেন যাদের আল্লাহ্ কুরআনের সেবক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে ইসলামের ওপর অবিচল থাকার জন্য মক্কার কাফিরদের চরম অত্যাচার সইতে হতো, দুপুরের প্রখর রোদে তাদেরকে তপ্ত বালুর উপর নগ্ন দেহে শুইয়ে দিয়ে তাদের বুকের ওপর গরম পাথর চাপা দেয়া হতো, পানির ভেতর মাথা চুবিয়ে রাখা হতো- এ ধরনের আরও অনেক অসহনীয় কষ্ট দেয়া হতো; আর এভাবে তাদেরকে কখনো কখনো এমন কথা বলতেও বাধ্য করা হতো বা তাদেরকে দিয়ে বলানো হতো যা তারা কোনভাবেই অন্তরে লালন করতেন না। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস বহির্ভুত কথা তাদের দিয়ে বলতে বাধ্য করা হতো। একবার মুশরিকরা হযরত আম্মারের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়; মহানবী (সা.) একথা জানতে পেরে তার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘হে আগুন! তুমি আম্মারের জন্য সেভাবে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও যেভাবে ইব্রাহীমের (আ.) জন্য হয়েছিলে।’

হযরত উসমান (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আমি ও মহানবী (সা.) মক্কার কোন উপত্যকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথ অতিক্রম করতে করতে তাঁরা হযরত আম্মারের পিতা-মাতা অর্থাৎ হযরত ইয়াসের ও হযরত সুমাইয়া (রা.)-এর কাছে গিয়ে পৌঁছান যখন তাদের ওপর চরম ও ভয়াবহ অত্যাচার চালানো হচ্ছিল। হযরত ইয়াসের নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমাদের ওপর কি এমন বর্বর অত্যাচার ও নির্যাতন চলতেই থাকবে? তখন নিরূপায় রসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেন এবং আল্লাহ্‌র কাছে তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন, আর আল্লাহ্ও সেই দোয়া গৃহীত হবার কথা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেন। আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) তাদেরকে তখন জান্নাতের সুসংবাদও প্রদান করেন। ক্রমাগত চরম অত্যাচারের ফলে একসময় হযরত ইয়াসের শাহাদত বরণ করেন, আর কাফিররা হযরত সুমাইয়াকেও তার লজ্জাস্থানে বর্শাদ্বারা আঘাত করে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে শহীদ করে। বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে দিনগুলোতে কাফিরদের অত্যাচারের চোটে একমাত্র হযরত বেলাল (রা.) ছাড়া সবাই কম-বেশি কাফিরদের কোন না কোন কথা মানতে বাধ্য হয়েছিল, যা তারা কোনভাবেই মনে-প্রাণে স্বীকার করতেন না বা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শত অত্যাচার-নির্যাতনও হযরত বেলাল (রা.)-এর বিশ্বাসে তিল পরিমান চির ধরাতে পারেনি। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, চরম কষ্ট সত্যেও তার মুখ থেকে শুধু একটি শব্দই বের হতো, আহাদ আহাদ।

হযরত আম্মার ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম নিজের বাড়িতে নামাযের জন্য মসজিদ বানিয়েছিলেন। অন্যান্য সাহাবীর মত তিনিও মদীনায় হিজরত করেন। মসজিদে নববী নির্মাণের সময় হযরত আম্মার (রা.) অসাধারণ সেবা করেন, সবাই একটি করে ইট বহন করলেও তিনি দু’টি করে ইট বহন করতেন। একসময় মহানবী (সা.) তার কাছে এসে তার মাথা থেকে ধুলো-ময়লা মুছে দিয়ে বলেন, ‘পরিতাপ! বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করবে। সে তাদেরকে আল্লাহ্‌র পানে আহ্বান করবে আর তারা তাকে আগুনের দিকে ডাকবে।’ মহানবীর এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর হযরত আম্মার দোয়া করতেন, ‘আমি বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য থেকে আল্লাহ্‌র আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি মসজিদ নির্মাণের সেবা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন নি, পরে সবার অনুরোধে মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে কাজ থেকে বিরত করেন। মোটকথা, গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও তারা ধর্মসেবা থেকে বিরত থাকতে চাইতেন না।

মসজিদে কুবা, যা হিজরতের পর মুসলমানদের প্রথম মসজিদ ছিল, সেটির ভিত্তি হযরত আম্মার-ই রেখেছিলেন এবং তিনি এই মসজিদ নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। হযরত আম্মার (রা.) বদর, উহুদ, খন্দক প্রভৃতি সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন, বয়আতে রিযওয়ানেও ছিলেন, এছাড়া অন্যান্য অভিযানেও মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তিনি বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন। ইয়ামামার যুদ্ধের সময় হযরত আম্মার উঁচু পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে মুসলমানদের একত্রিত করার জন্য ডাকছিলেন, সে সময় তার একটি কান কেটে গিয়ে ঝুলছিল। পরে অনেকেই তার কান কাটা নিয়ে ঠাট্টা করলেও তিনি ধর্মের খাতিরে এই অঙ্গ হারানোর কুরবানী করতে পেরেছেন বলে গর্ববোধ করতেন।

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ বর্ণনা করেন, একবার তার ও হযরত আম্মারের মাঝে কোন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। হযরত আম্মার এটি নিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করেন; যখন তিনি অভিযোগ করছিলেন ঠিক তখন হযরত খালিদও সেখানে গিয়ে হাজির হন এবং আম্মারকে আবারো ভর্ৎসনা করেন। মহানবী (সা.) এ সময় নীরব ছিলেন, তখন আম্মার কেঁদে ফেলে বলেন, হে আল্লাহ্ রসূল খালিদের অবস্থা দেখুন! তখন রসূল (সা.) বলেন, যে আম্মারের সাথে শত্রুতা করবে, আল্লাহ্ও তার সাথে শত্রুতা করবেন; আর যে তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবে আল্লাহ্ও তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন। এরপর হযরত খালিদ অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে আম্মারের সাথে দেখা করে ক্ষমা চান আর আম্মার (রা.)-ও তাকে ক্ষমা করে দেন।

মহানবী (সা.) হযরত আম্মারকে ‘পবিত্র ব্যক্তি’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি (সা.) বলতেন, আম্মার বিন ইয়াসের-এর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঈমান প্রবেশ করেছে। আম্মার সেসব লোকের মধ্যে গণ্য হতেন যাদেরকে আল্লাহ্ শয়তান থেকে নিরাপদ রেখেছেন। হযরত উমর (রা.) তাকে কুফার আমীর নিযুক্ত করেন, পরবর্তীতে কুফাবাসীদের কতিপয় অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে সেই পদ থেকে অপসারণও করেন। একবার হযরত উমর (রা.) তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার এই অপসারণের ফলে তুমি কি কষ্ট পেয়েছিলে? আম্মার জবাব দেন, আপনি যেহেতু প্রশ্ন করেছেন তাই বলছি, আপনি যখন আমাকে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন তখনও তা আমার ভাল লাগে নি, আর যখন পদচ্যুত করেন তখনও কষ্ট পেয়েছি; কিন্তু প্রত্যেকবারই আনুগত্যের স্পৃহায় বিনা বাক্যে তা মেনে নিয়েছি। হযরত উসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলাকারীরা যখন আন্দোলন করছিল, তখন নিজ সরলতার কারণে হযরত আম্মারও তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন; যদিও কার্যত তিনি কোন অন্যায় কাজ করেন নি। আর হযরত আলী (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি তার একান্ত অনুগত ছিলেন। তিনি হযরত আলী (রা.)-এর সাথে সিফফীন ও জামালের যুদ্ধেও অংশ নেন।

আবু আব্দুর রহমান বর্ণনা করেন যে, সিফফীনের যুদ্ধে হযরত আলী (রা.)-এর পাশাপাশি আমরা হযরত আম্মার বিন ইয়াসেরকেও দেখেছি যে, তিনি যেদিকে যেতেন বা মুখ ফিরাতেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণও তাকে অনুসরণ করতেন। মোটকথা, হযরত আম্মার যেন তাদের জন্য পতাকা সদৃশ ছিল।

সিফফীনের যুদ্ধে আমীর মুয়াবিয়ার সাথে লড়াইয়ে তিনি শাহাদতের অমীয় সূধা পান করেন, সেসময় তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর বা মতান্তরে ৯৩ বা ৯১ বছর। মৃত্যুর আগে তার শেষ পানীয় ছিল দুধ, যেমনটি মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাকে তার ওসীয়্যত অনুসারে সেই অবস্থাতেই সমাহিত করা হয়, হযরত আলী (রা.) পাঁচ-ছয় বা সাত তকবীর দিয়ে তার জানাযা পড়িয়েছিলেন, অতঃপর তার ওসীয়্যত অনুসারে সিফফীনেই তাকে সমাহিত করা হয়।

হুযূর (আই.) বলেন, এরা হলেন সেসব সাহাবী যারা সত্যের জন্য লড়াই করেছেন এবং সত্যের খাতিরে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের পদমর্যাদা উন্নীত করুন, (আমীন)