রমযানের ফযিলত এবং আল্লাহ্ তা’লার অসীম রহমত বা সীমাহীন দয়া আর তওবা ও ইস্তেগফারের দর্শন এবং গুরুত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৮-জুন, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৮ই জুন, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় রমযানের ফযিলত এবং আল্লাহ্ তা’লার অসীম রহমত বা সীমাহীন দয়া আর তওবা ও ইস্তেগফারের দর্শন এবং গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহ্‌হুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা আ’রাফের ১৫৭নং আয়াত পাঠ করেন যার বঙ্গানুবাদ হল, “আর তুমি আমাদের জন্য এ পৃথিবীতে এবং পরকালেও কল্যাণ নির্ধারণ কর। নিশ্চয় আমরা তোমার দিকে অনুতাপের সাথে ফিরে এসেছি। তিনি বললেন, ‘আমি যাকে চাই আমার আযাবে জর্জরিত করি। কিন্তু আমার কৃপা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। অতএব আমি এ (কৃপা) অবশ্যই তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমাদের আয়াতসমূহে ঈমান আনে।”

হুযূর (আই.) বলেন, বান্দার প্রতি আল্লাহ্‌র দয়া ও করুণার কোন সীমা পরিসীমা নেই। যেমনটি উক্ত আয়াতে তিনি বলেছেন, তাঁর রহমত প্রত্যেক বস্তুকে পরিবেষ্টন করে আছে। রহমত মানে হল নম্রতা, করুণা, কৃপা ইত্যাদি, অতএব এর অর্থ হল, বান্দার প্রতি আল্লাহ্ তা’লার কৃপা ও ক্ষমার কোন সীমা নেই। মানুষকে শাস্তি দেয়া আল্লাহ্‌র মূল উদ্দেশ্য নয়, শাস্তি তারাই পায় যারা অন্যায়ে সীমা ছাড়িয়ে যায়, আর সেই শাস্তিও প্রকৃতপক্ষে বান্দার সংশোধনের নিমিত্তেই দেয়া হয় এবং এক সময় তাও শেষ হয়ে যায়। কারণ হাদীসে আছে, এক সময় জাহান্নাম খালী বা শূন্য হয়ে যাবে। যেহেতু আল্লাহ্ বিচার দিবসের মালিক, তাই তাঁর পক্ষে আমাদের কোনরূপ শাস্তি না দিয়েই ক্ষমা করা সম্ভব; কিন্তু তিনি আমাদেরকে পুণ্যের পথে পরিচালিত হওয়ার উৎসাহিত করার জন্য এই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমার রহমত সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে, আর আমি সেই রহমত অবশ্যই তাদের প্রতি প্রদর্শন করব যারা তাকওয়া অর্থাৎ খোদাভীতি অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি ঈমান আনে।’ এর মাধ্যমে তিনি মূলত এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, যদি তোমরা এমনটি কর তাহলে তোমাদের প্রতি খোদা রহমত বর্ষণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

হুযূর বলেন, আমরা আল্লাহ্‌র বান্দা বা দাস; একজন দাসের তার মনিবের কাছে কী-ইবা অধিকার থাকতে পারে? অথচ আল্লাহ্ আমাদেরকে এই অধিকার প্রদান করছেন যে, সৎকর্ম করলে আল্লাহ্‌র রহমত লাভ করা বান্দার অধিকার!

তাকওয়া কী এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেন, আল্লাহ্ তা’লার আমানত ও ঈমানের সংশ্লিষ্ট অঙ্গিকারসমূহ যথাযথভাবে পূর্ণ করা এবং আপাদমস্তক যাবতীয় বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা ইন্দ্রিয়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করা ও অসঙ্গত ক্ষেত্র থেকে সেগুলোকে বিরত রাখলে পরেই মানুষ সত্যিকার অর্থে তাকওয়ার পথে পরিচালিত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আর এগুলো করতে গিয়ে বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের বিষয়টিও দৃষ্টিপটে রাখতে হবে; একজন মু’মিনের যথাসাধ্য এই বিষয়গুলো পালন করার চেষ্টা করতে হবে, তাহলে আল্লাহ্‌র রহমত লাভ তার জন্য আবশ্যক হয়ে যায়।

হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমানে যে দিনগুলো আমরা অতিক্রম করছি অর্থাৎ রমযানের এই কল্যাণমন্ডিত দিনগুলো, যা সম্বন্ধে মহানবী (সা.) বলেছেন যে, এই মাসে জান্নাতের দ্বারগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, এত্থেকে প্রকৃতপক্ষে কেবল মু’মিন ও মুত্তাকীরাই উপকৃত হতে পারে। কেননা রমযান উপলক্ষ্যে পাপীদের পাপকর্ম তো আর বন্ধ হয়ে যায় না, কাজেই, তাদের জন্য এই হাদীস প্রযোজ্য নয়। মুত্তাকীদের জন্য এই রমযান একটি মহাসুসংবাদ নিয়ে আসে যে, এখন আল্লাহ্‌র রহমত লাভের সুবর্ণ সুযোগ, তাই একে কাজে লাগাও এবং এত্থেকে লাভবান হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা কর, খোদার নির্দেশাবলী পালনের জন্য অধিকে সচেষ্ট হও। হাতে গোণা এই দিনগুলোকে হেলায় নষ্ট করো না।

এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের তাগিদে ও পুণ্যের আশায় রমযানের রাতে উঠে নামায পড়ে, তার পূর্বকৃত সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। এটি আল্লাহ্‌র রহমতের আরেকটি ঝলক। তেমনিভাবে রমযানের শেষ দশকে লায়লাতুল কদরের সন্ধান করা- এটিও আল্লাহ্‌রই এক অপার দান, যেন মানুষ আল্লাহ্‌র রহমত বা করুণাভাজন হতে পারে।

একইভাবে সেই হাদীসটিও লক্ষ্যণীয় যাতে বলা আছে, রমযানের প্রথম দশক হল রহমতের বা দয়ার, মধ্যম দশক মাগফিরাত বা ক্ষমার আর শেষ দশক হল, আগুন থেকে মুক্তির বা নাজাতের- এটিও আল্লাহ্‌র বিশেষ দয়ার পরিচায়ক; কেননা রহমত বা মাগফিরাত বা আগুন থেকে মুক্তি কেবল এই নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনেই নয় বরং খোদার নির্দেশ মেনে চললে সর্বদাই লাভ হতে পারে; এই দিনগুলোতে আল্লাহ্ তাঁর মু’মিন বান্দাদের জন্য রমযান পালনের মাধ্যমে বিশেষভাবে এই অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তাই এ বিষয়ের প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করার প্রয়োজন রয়েছে।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এ যুগে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রতি পদক্ষেপে আমাদের পথনির্দেশনা প্রদান করেছেন। কীভাবে আমরা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করতে পারি, তাঁর রহমত লাভ করতে পারি, তাঁর ক্ষমা লাভ করতে পারি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি (আ.) যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং ইস্তেগফার ও তওবার দর্শন ও এর অপরসীম গুরুত্ব সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা ও মর্মবাণী দিয়েছেন তা তাঁর বিভিন্ন নির্বাচিত উদ্ধৃতির আলোকে হুযূর তুলে ধরেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সূরা আ’রাফের ১৫৭নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এখানে আল্লাহ্ তা’লা তাকওয়াকে তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন- শির্‌ক থেকে বিরত থাকা, কুফর থেকে বিরত থাকা এবং অশ্লীলতা থেকে মুক্ত থাকা। হুযূর (আই.) বর্তমান যুগের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম যেমন টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আরও বলেন, এই আয়াত থেকে এটিও স্পষ্ট হয়, আল্লাহ্‌র রহমত সাধারণভাবে সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে রাখে, শাস্তি কেবল ক্ষেত্রবিশেষে যখন নিয়ম ভঙ্গ করা হয় বা সীমালঙ্ঘন করা হয় তখন প্রযোজ্য বা কার্যকর হয়; আল্লাহ্‌র কুদ্দুসিয়্যত বা পবিত্রতার দাবী হল, অপরাধী ও পাপীদের শাস্তি দেয়া।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ইস্তেগফারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ইস্তেগফারের অর্থ হল, ঢেকে রাখা, মানবীয় দুর্বলতা বা ত্রুটি যেন প্রকাশ না পায় আর পাপ যেন সংঘটিত না হয় সেজন্য আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাওয়া। আল্লাহ্ তা’লা খালেক অর্থাৎ তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেন এবং তিনি কাইয়্যুম, অর্থাৎ প্রত্যেকটি বস্তুকে নিজ সত্ত্বায় তিনি-ই প্রতিষ্ঠিত রাখেন; তাই এটি আবশ্যক, যিনি কাইয়্যুম তাঁর কাছে সর্বদা পাপ থেকে মুক্তির ও সৎকর্ম করার জন্য যেন শক্তি প্রার্থনা করা হয়। আর এটিই সূরা ফাতিহায় ‘ইয়্যাকা নাস্তাঈন’-এ শেখানো হয়েছে।

খুতবার শেষদিকে হুযূর দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নিষ্ঠার সাথে তাঁর পানে অগ্রসর হওয়ার তৌফিক দিন। তিনি আমাদেরকে তাকওয়ায় সমৃদ্ধ করুন আর ঈমান ও বিশ্বাসে অগ্রগামী করুন। আমরা যেন সর্বদা তাঁর কৃপাভাজন হই এবং কখনও এমন সময় যেন আমাদের জীবনে না আসে যে, আমরা তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হই ও নিজেদের অপকর্মের দরুন তাঁর শাস্তির লক্ষ্যে পরিণত হই; আল্লাহ্‌র কৃপাদৃষ্টি সর্বদা আমাদের ওপর বর্ষিত হোক, আমীন।