রোযার তাৎপর্য এবং এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৮-মে, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৮ই মে, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় রমযানকে স্বাগত জানিয়ে রোযার তাৎপর্য এবং এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা বাকারার ১৮৪ নং আয়াত পাঠ করেন। এ আয়াতে রোযার নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ্ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ অর্থাৎ, “হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের জন্য সেভাবে রোযা রাখা বিধিবদ্ধ করা হল যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।”

হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় আমরা আরও একটি রমযান মাস অতিক্রম করার সৌভাগ্য লাভ করছি যা মাত্র গতকাল থেকেই আরম্ভ হয়েছে। এ মাসে মুসলমানরা রোযা রাখে এবং মসজিদগুলোতে নামায, তারাবীহ ইত্যাদিতে অধিক মুসল্লির উপস্থিতি দেখা যায়। আমি যে আয়াতটি পাঠ করেছি, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, রোযা বিধিবদ্ধ করার মূল উদ্দেশ্য হল, তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন; পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর জন্যও এই একই উদ্দেশ্যে রোযা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। সেসব ধর্মে এখন আর প্রকৃত শিক্ষা, আচার বা তাকওয়া বিদ্যমান নেই। কিন্তু ইসলাম চিরন্তন ধর্ম আর এর শিক্ষাও চিরন্তন, আর পবিত্র কুরআন পৃথিবীর সর্বত্র আজও এর আদি ও অবিকৃত রূপে বিদ্যমান, যার শিক্ষার অনুসরণ করে সর্বদা তাকওয়ার পথে পরিচালিত হওয়া সম্ভব, আর শেষ যুগে মুসলমানদের সংশোধন, কুরআনের শিক্ষার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্ তা’লা প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁকে মানার তৌফিক দান করেছেন; তাই আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক দায়িত্ব হল, আমরা যেন রোযার সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন করি এবং রমযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্থাৎ তাকওয়া অর্জন ও তাতে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করতে থাকি।

হুযূর (আই.) বলেন, উল্লিখিত আয়াত ও এর সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোতে রোযা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে, কিন্তু সব কথার মূল বা সারমর্ম এ আয়াতে এককথায় বলে দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ রোযার মূল উদ্দেশ্য হল তাকওয়া। আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশাবলী ও তাঁর ইবাদত পালনের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে এ মাসে বিশেষ চেষ্টা-প্রচেষ্টা কর, যেন তা সবসময়ের জন্য এগুলোকে তোমাদের জীবনের স্থায়ী অংশে পরিণত করতে সাহায্য করে।

রমযানে যদি আমরা তাকওয়া অর্জনের প্রতি মনোযোগী হই, তবে ইবাদতের প্রতিও আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হবে, পাপ থেকে আত্মরক্ষার প্রতিও মনোযোগ নিবদ্ধ হবে, আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশাবলী পালনের ক্ষেত্রেও মনোযোগ নিবদ্ধ হবে। রোযা রেখেও যদি আমাদের মাঝে অহংকার, গর্ব, আত্মশ্লাঘা, আত্মম্ভরিতার বদভ্যাস বিদ্যমান থাকে তবে তা কোনভাবেই তাকওয়া নয়; রোযা রেখেও যদি ঝগড়া-বিবাদ, মিথ্যাচার ও অশান্তির পথ থেকে আমরা বিরত না থাকি তবে তা তাকওয়া নয়; রোযা রেখে ইবাদত, দোয়া ও সৎকর্মে যদি রত না থাকি তবে তা তাকওয়া নয়; এভাবে রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্যই অপূর্ণ থেকে যায়। রমযানে পাপ পরিত্যাগ করা ও পুণ্য অবলম্বন করার মাধ্যমেই রোযার আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়; আর মানুষ যখন এতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করে, তখনই কেবল সে রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হতে পারে। নতুবা সে অযথাই অভুক্ত থাকে, আর মহানবী (সা.) বলেছেন এমন ব্যক্তির অভুক্ত থাকায় আল্লাহ্ তা’লার কিছুই যায় আসে না।

হুযূর বলেন, কিছু লোক তো এমনও আছে যারা অভুক্তও থাকে না, বরং কেবল লোক-দেখানোর জন্য সেহরি ও ইফতার করে আর লুকিয়ে লুকিয়ে খাবারও খায়, এমন মানুষ রোযার তাৎপর্য কীভাবে বুঝতে পারে? এছাড়া অনেকে দিনভর উপবাস পালন করে ঠিকই, কিন্তু নামায ইত্যাদির প্রতি কোন খেয়াল রাখে না, আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধের প্রতি কোন তোয়াক্কা করে না; এমন ব্যক্তির রোযা আল্লাহ্র যে নির্দেশ ‘তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর’-এই উদ্দেশ্যকে পূরণ করছে না। তাই আমাদের আহমদীদের ওপর এক্ষেত্রে অনেক বড় গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়, আমরা যেন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মানার পর আল্লাহ্র নির্দেশমত নিজেদের রোযার দায়িত্ব যথোচিতভাবে পালন করি এবং তাকওয়া কী ও কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব তা অনুধাবনের ষোলআনা চেষ্টা করি।

হুযূর (আই.) এরপর বিভিন্ন সময়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) তাকওয়া সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, যেমন মুত্তাকী কে, সত্যিকার প্রশান্তি ও আনন্দ তাকওয়ার মাধ্যমেই লাভ হয়। কীভাবে আমাদের পুণ্য করা উচিত, প্রকৃত মুমিন হবার জন্য মানুষের প্রতিটি কর্ম আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অনুসারে করা উচিত, মানুষ যেন মারেফতের ক্ষেত্রে উন্নতি করে ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর রচনাসমগ্র হতে বিভিন্ন নির্বাচিত অংশ তুলে ধরেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজ জামাতকে তাকওয়া অবলম্বনের জোরালো নির্দেশ দিয়ে বলেন, গতকাল (অর্থাৎ ২২ জুন, ১৮৯৯ সনে) অনেকবার আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এই ইলহাম হয়েছে যে, ‘তোমরা মুত্তাকী হয়ে যাও এবং তাকওয়ার সূক্ষ্ম পথে পরিচালিত হও, তাহলে খোদা তোমাদের সাথে থাকবেন’। তিনি বলেন, এতে আমার হৃদয়ে অত্যন্ত বেদনার সৃষ্টি হয় যে, আমি কী করব যাতে আমাদের জামাতের সদস্যরা প্রকৃত তাকওয়া ও পবিত্রতা অবলম্বন করে!.যতক্ষণ পর্যন্ত কোন জামাত মুত্তাকী না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা খোদা তা’লার সাহায্য লাভ করতে পারে না। অতীতের সকল পবিত্র গ্রন্থ এবং তওরাত-ইঞ্জিলের শিক্ষার সারবস্তু হল তাকওয়া, পবিত্র কুরআনও একে এককথায় প্রকাশ করে দিয়েছে।

তিনি (আ.) বলেন, শরীয়তের যাবতীয় নির্দেশের সারকথা হল, তাকওয়া। আর তোমরা যদি চাও দোয়া গৃহীত হোক তবে তাকওয়ার পথে বিচরণ কর। মুত্তাকীদের দোয়াই কবুল হয়, যেমনটি আল্লাহ্ বলেছেন, إنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ (সূরা আল্ মায়েদা: ২৮) (ইন্নামা ইয়াতাকাব্বালুল্লাহু মিনাল মুত্তাকীন)। যে ব্যক্তি উদাসীন ও ভ্রষ্টতায় নিপতিত থেকেও চায় যে তার দোয়া কবুল হোক, সে কি নিতান্তই নির্বোধ ও মূর্খ নয়?

তিনি (আ.) বলেন, মুত্তাকীদের জন্য অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আল্লাহ্ স্বয়ং তাদের অভিভাবক হয়ে যান। তারা মিথ্যাবাদী যারা বলে, ‘আমরা আল্লাহ্‌র নৈকট্যপ্রাপ্ত’, অথচ তারা মুত্তাকী নয় এবং অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত, কেননা আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য মুত্তাকী হবার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আর এর নিদর্শন হল, আল্লাহ্ তাদের সাথে থাকেন ও তাদের সাহায্য করেন। পৃথিবীতে মানুষ বিভিন্ন রকম সমস্যা ও বিপদাপদে জর্জরিত হয়। কিন্তু মুত্তাকীদের জন্য আল্লাহ্‌র ঘোষণা হল, مَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ (সূরা আল্ তালাক: ৩-৪) (‘মাইঁয়্যাত্তাকিল্লাহা ইয়াজ’আল লাহু মাখরাজা- ওয়া ইয়ারযুকহু মিন হাইসু লা ইয়াহতাসিব’)। অর্থাৎ, মুত্তাকীর জন্য আল্লাহ্ পরিত্রাণের কোন না কোন পথ সৃষ্টি করে দেন, অদৃশ্য থেকে মুক্তির উপকরণ সৃষ্টি করে দেন, এবং এমন স্থান থেকে তাকে রিযক প্রদান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না। পার্থিব জীবনে মানুষ সর্বোচ্চ কী আকাঙ্খা করতে পারে? এটাই যে সে যেন সুখ ও প্রশান্তি লাভ করে। আর এর জন্য আল্লাহ্ তা’লা একটিই পথ বাতলে দিয়েছেন, তা হল তাকওয়ার পথ, এর আরেকটি নাম হল ‘কুরআনের পথ’, আউলিয়াগণ একে ‘সীরাতে মুস্তাকিম’ বলেন। কেউ যেন এটি না ভাবে যে, কাফিরদের কাছে তো অনেক ধন-সম্পদ ও সম্পত্তি রয়েছে এবং তারা আরাম-আয়েশ ও বিলাস-বিভবে মত্ত রয়েছে। মনে রাখবেন, তারা বাহ্যিকতার পূজারীদের দৃষ্টিতে আনন্দে রয়েছে, কিন্তু বস্তুত তারা মনে মনে এক যন্ত্রণার আগুনে পুড়ছে। জাগতিক কোন ক্ষতিতে তারা পাগলপারা হয়ে যায়। যার মধ্যে স্বল্পে-তুষ্টি ও তাকওয়া আছে এবং যে খোদার সন্তুষ্টির সন্ধানী, সে সামান্যতেই সুখে ও আনন্দে থাকে। প্রকৃত আনন্দ তাকওয়ার মাঝেই নিহিত। তাকওয়ারও অনেক সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রয়েছে, আর তা মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্ম। মুত্তাকীর জিহ্বাতেও তাকওয়া থাকে, সে অযথা ও অসঙ্গত কথা বলে না। মু’মিন মুত্তাকী তার সকল সাফল্যকে আল্লাহ্‌র প্রতি আরোপ করে ও তাঁর প্রশংসা করে, এভাবে খোদার সাথে তার সম্পর্ক নিবিড় হয়। অন্যদিকে কাফির সাফল্যকে নিজের যোগ্যতা, জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদির প্রতি আরোপ করে ও খোদা থেকে দূরে সরে যায়। মুত্তাকী তার দোয়া কবুল হলে আনন্দে আটখানা হয়ে তা বলে বেড়ায় না, বরং আল্লাহ্‌র করুণার প্রতি অধিক মনোযোগী হয় ও মারেফতে ইলাহী বা ঐশী তত্ত্বজ্ঞানে উন্নতি করতে থাকে।

তিনি (আ.) বলেন, আমার কাছে বারংবার এই ইলহাম হয়েছে, إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ (সূরা আন নাহল-১২৯) (‘ইন্নাল্লাহা মা’আল্লাযিনাত্তাকাও ওয়াল্লাযিনা হুম মুহসিনুন’) অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদের সাথে আছেন যারা মুত্তাকী এবং যারা সৎকর্মশীল। এর উদ্দেশ্যই হল, আমাদের জামাত যেন কেবল মৌখিক বয়আতেই সন্তুষ্ট হয়ে না যায়; আল্লাহ্‌র সাহায্য তখন লাভ হয় যখন প্রকৃত তাকওয়া অর্জিত হয় ও একইসাথে পুণ্য বা সৎকর্মও থাকে।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই রমযানে তাকওয়ার সাথে রোযা রাখার, ইবাদত করার ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার তৌফিক দান করুন; রমযান জামাতের সদস্যদের, সর্বোপরি মুসলমানদের ও সারা পৃথিবীর জন্য সবদিক থেকে মঙ্গলময় হোক।

হুযূর বলেন, বিশেষভাবে পাকিস্তানের জন্য দোয়া করুন, সেখানে প্রতিদিন অবস্থা যে রকম অবনতির দিকে যাচ্ছে তার যেন পরিবর্তন হয়; এছাড়া পৃথিবীও যেভাবে যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’লা যেন বিশেষভাবে আহমদীদের ও মুসলমানদের এবং সাধারণভাবে মানবজাতিকে এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন, আর যদি সম্ভব হয় তাহলে তাদের যেন সংশোধন হয়ে যায় এবং তারা আল্লাহ্‌কে চিনতে পারে ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। (আমীন)