তাক্‌ওয়া ও আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক স্থাপণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৩-এপ্রিল, ২০১৮

মসজিদে বাশারাত, পেড্রোয়াবাদ, স্পেন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ইং স্পেনের পেড্রোয়াবাদে অবস্থিত মসজিদে বাশারাত থেকে বর্তমান বিশ্ব সংকটের সময় আহমদীদের খোদাভীতি অবলম্বন এবং আল্লাহ্ তা’লার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহ্হুদ, তাআ’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, বর্তমানে গোটাবিশ্বে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান; কোথাও ধর্মের নামে অশান্তি, কোথাও বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের পেশীশক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জন্য অশান্তি সৃষ্টি করছে, কোথাও ধনী-দরিদ্রের টানাপোড়েনের কারণে অশান্তি, কোথাও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কারণে অশান্তি, কোথাও ঘরোয়া তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, কোথাওবা নিজেদের অধিকার আদায়ের নামে অন্যায় পন্থা অবলম্বনের কারণে বিশৃঙ্খলা- মোটের ওপর যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, পৃথিবী অশান্তি ও বিশৃঙ্খলায় নিপতিত। ধনী হোক বা দরিদ্র, উন্নত বা অনুন্নত- কেউই এত্থেকে মুক্ত নয়।

হুযূর বলেন, আজকের যুগে মানুষ নিজেকে অনেক উন্নত মনে করে আর ভাবে যে, এটি তো জ্ঞান-বুদ্ধি ও আলোর যুগ, অথচ সে অন্ধকারে নিমজ্জিত। খোদাকে ভুলে গিয়ে পার্থিবতার পেছনে ছুটতে থাকে এবং একেই নিজের ঈশ্বর মনে করে ধ্বংসের অতল গহ্বরের নিপতিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অমুসলমান বিশ্বের ক্ষেত্রে না হয় জাগতিকতার মোহে এরূপ নিমজ্জিত হওয়া কিছুটা হলেও বোধগম্য, কারণ তাদের ‘ধর্ম’ বিকৃতির শিকার এবং তাদেরকে আল্লাহ্‌র পানে পরিচালিত করার মত পরিপূর্ণ শিক্ষা ও সমাধান তাতে নেই; কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় মুসলমানদের দেখে, যাদের কাছে এক মহান ও পরিপূর্ণ শিক্ষাসম্বলিত ও অবিকৃত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে এবং আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি অনুসারে একজন যুগ ইমামও তাদের জন্য এসেছেন, যিনি ওলামা কর্তৃক কুরআনের তফসীরে ও ইসলাম ধর্মের মাঝে সৃষ্ট বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তি অপনোদন করতে প্রেরিত হয়েছেন, অথচ তাঁকে না মেনে তারা বিশৃঙ্খলা-পরায়ণ ওলামাদের অন্ধ অনুসরণ করেছে। আর এর ফলাফল যা দাঁড়িয়েছে তা হল, আজ মুসলমানরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অশান্তি ও বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত; পরস্পর একে অন্যের রক্তপিপাসু হয়ে উঠছে। আর এই সুযোগ লুফে নিয়ে অমুসলমান ও ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলো মুসলমানদের মাঝে বিবাদ-বিতণ্ডা বাঁধিয়ে দিচ্ছে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একদিকে তাদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করছে, অন্যদিকে নিজেদের সৈন্যবাহিনীও পাঠাচ্ছে।

এমতাবস্থায় আমরা যারা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-কে মেনেছি, আমাদের একদিকে যেমন নিজেদের ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য দোয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন, অপরদিকে আমাদের ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থাও তদ্রুপ হওয়া উচিত- যেমনটি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর অনুসারীদের মাঝে দেখতে চেয়েছেন। এমনটি না হলে আমাদের অবস্থাও অন্যান্য মুসলমানদের মত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

এরপর হুযূর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্র থেকে বিভিন্ন নির্বাচিত উদ্ধৃতির আলোকে তিনি (আ.) তাঁর এই প্রিয় জামাতের কাছে কি প্রত্যাশা করেছেন তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং জামাতকে এই বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্য খোদার প্রতি সমর্পিত হওয়ার আহ্বান জানান।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বারংবার বিভিন্নস্থানে এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যে, বয়আতের পর আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সেজন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। হুযূর (আই.) বলেন, আমি এখন এ প্রসঙ্গে তাঁর (আ.) কতিপয় উদ্ধৃতি উপস্থাপন করব যেখানে এ বিষয়ে তাঁর দিকনির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে, আর এ কারণে তা খুব মনোযোগের সাথে শুনতে হবে। এটি মনে করবেন না, এগুলো আগেও কয়েকবার শুনেছি বা পড়েছি; বারবার শুনে বা পড়েও মানুষ ভুলে যায়। মসীহ্ মওউদ (আ.) যে গুরুত্বের সাথে, বারংবার বিভিন্ন সভায় ধারাবাহিক ও বিস্তারিতভাবে এগুলো বর্ণনা করেছেন, তা থেকে বুঝা যায় যে তিনি এগুলোকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।

একস্থানে তিনি (আ.) বলেন, এই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ যুগে, যখন সর্বত্র ভ্রষ্টতা ও উদাসীনতার ঝড় বইছে, আমাদের জামাতের জন্য আবশ্যক হল, তারা যেন তাকওয়া অবলম্বন করে। জগতের অবস্থা হল, আল্লাহ্‌র নির্দেশের প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই, তারা পার্থিবতা অর্জনে সীমাতিরিক্ত ব্যস্ত। সামান্য কোন জাগতিক ক্ষতি হতে দেখলেই আল্লাহ্‌র নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বসে। কুরআন অবিকল সেটিই বিদ্যমান, অনেক হাদীসও অবিকৃত আছে, তদুপরি প্রকৃত ঈমান ও তাকওয়া অনুপস্থিত। আল্লাহ্ তা’লা আমাকে এজন্যই প্রেরণ করেছেন যেন এই জিনিসগুলো আবারও মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়। আল্লাহ্ যখন দেখেছেন যে, মুসলমানরা এগুলো হারিয়ে বসেছে, তখন তাঁর আত্মাভিমান ও ঈশ্বরত্বের এটিই দাবী ছিল যে, তিনি যেন এমন লোক সৃষ্টি করেন যারা পুনরায় ধর্মকে পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দানকারী হবে, ধর্মের প্রচার ও প্রসারকারী হবে এবং তা পালনকারী হবে। আর এজন্য কেবল এই মৌখিক ঘোষণা দেয়াই যথেষ্ট নয় যে, ‘আমরা নতুন জাতিতে পরিণত হয়েছি’, বরং এজন্য ব্যবহারিক অবস্থায় পরিবর্তন ও প্রকৃত খোদাভীতি সৃষ্টি করা আবশ্যক। তাহলেই আমরা সেই নতুন জাতি হতে পারব, যারা ইসলামের মর্ম অনুধাবনকারী ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনকারী; আর তখনই আমরা বয়আতের অঙ্গীকার পালনকারী হতে সক্ষম হবো।

ইসলামের প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য কী তা বুঝাতে গিয়ে তিনি (আ.) বলেন, আল্লাহ্‌র যাবতীয় নির্দেশের অধীন হয়ে যাবার নাম হল, ইসলাম। মুসলমান হল সে, যে কোন প্রতিদান বা পুরস্কারের আকাঙক্ষা না করে, কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিজের পুরো সত্তাকে তাঁর সকাশে সমর্পণ করে। কোন বেহেশতের লোভ বা জাহান্নামের ভয়ে নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র খাতিরেই তাঁর যাবতীয় নির্দেশ সানন্দে পালন করে, আর এ কাজে কোন কষ্ট বা ক্লান্তি বোধ করে না।

এর পাশপাশি ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির বিষয়েও তিনি (আ.) নির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, মুরীদের সাথে মুর্শিদ বা পীরের সম্পর্ক ঠিক তেমনই, যেমনটি ছাত্রের সাথে শিক্ষকের। ছাত্র যদি নিজে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা না করে, তাহলে শিক্ষক যত জ্ঞানীই হোক না কেন, তাতে ছাত্রের কোন লাভ হয় না; তেমনিভাবে বয়আত গ্রহণের পর ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও প্রত্যেককে সচেষ্ট হতে হবে। জ্ঞান যদি ক্রমাগত বৃদ্ধি না করা হয়, তবে তা লোপ পায়, যেমনটি বদ্ধপানি ধীরে ধীরে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ে। তাই মারেফত বা ধর্মীয় জ্ঞানে ক্রমাগত সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এজন্য কুরআন গভীর অভিনিবেশ সহকারে পড়া উচিত, আর যা বোধগম্য নয় তা জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া উচিত।

হুযূর (আই.) বলেন, অনুরূপভাবে খিলাফতের সাথে ঐকান্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’লা এমটিএ নামক যে নিয়ামত জামাতকে দান করেছেন তদ্বারা খলীফার সাথে মজবুত সম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যুগ-খলীফার সকল অনুষ্ঠান থেকে উপকৃত হওয়া প্রয়োজন, এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনাদের ঈমান ও বিশ্বাস দৃঢ়তা লাভ করবে এবং আল্লাহ্ তা’লা সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান আরো বৃদ্ধি পাবে।

নিজেদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি এবং পরষ্পরের অধিকার প্রদানের প্রতিও মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজ অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি (আ.) বলেন, অভ্যন্তরীণভাবে জামাতের সবাই একই পর্যায়ের হয় না। কেউ দুর্বল হয় আবার কেউ সবল; তাই আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল ভাইদের সাহায্য করে তাদেরকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। যদি দু’ভাইয়ের মধ্যে একজন সাঁতার জানে আর অপরজন না জানে, তাহলে প্রথম জনের ওপর কি এই দায়িত্ব বর্তায় না যে, সে অপর ভাইকে ডুবে যাওয়া হতে রক্ষা করবে? এজন্যই পবিত্র কুরআনে শিক্ষা দেয়া হয়েছে- “তা’আওয়ানু আলাল বিররে ওয়াত্ তাকওয়া”, পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর। দুর্বল ভাইদের বোঝা বহন করো, ঈমান ও আমল সংক্রান্ত বিষয়ে বা আর্থিক ক্ষেত্রে কিংবা শারীরিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য কর। কোন জামাত ততক্ষণ পর্যন্ত জামাত হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সবলরা দুর্বলদের সহায়তা না করে। আর এর জন্য আবশ্যক হল, তাদের দুর্বলতা ঢেকে রাখা, তা প্রচার না করা বা এটি নিয়ে সমালোচনা মুখর না হওয়া।

হুযূর (আই.) খুতবার শেষদিকে দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে প্রকৃত আহমদী হবার ও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষানুসারে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমরা যেন আল্লাহ্‌র অধিকার প্রদানকারী ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকারী হই। নিজেদের কর্মের সংশোধনকারী হই। নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হই, আর আল্লাহ্‌র বান্দাদেরও প্রাপ্য অধিকার প্রদানকারী হই। (আমীন)।

এছাড়া হুযূর বিশেষভাবে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে পাকিস্তানের সার্বিক মঙ্গলের জন্য দোয়া করতে বলেন এবং সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীর জন্য দোয়া করতে বলেন কারণ, বিশ্ব খুব দ্রুতবেগে যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার কর্মকান্ডে প্রতীয়মান হচ্ছে।

হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা মুসলমানদের সুবুদ্ধি দিন, তারা অন্যের সাহায্য নেয়ার পরিবর্তে নিজেরা পরষ্পরের প্রাপ্য অধিকার প্রদানকারী হোক। সন্ত্রাসী দলগুলোকে আল্লাহ্ ধৃত করুন, সর্বোপরি মুসলমানরা যেন যুগের ইমামকে মানার সৌভাগ্য লাভ করে, কেননা এ ছাড়া এসব বিপদ থেকে পরিত্রাণের আর কোন পথ নেই। (আমীন)।