শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৯-মার্চ, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৯ই মার্চ, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আব্বাদ বিন বাশার (রা.), হযরত হারাম বিন মিলহান (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর আনসারী (রা.), হযরত আমর বিন জামু (রা.), হযরত আবু তালহা (রা.), হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের আত্মত্যাগ, তাদের মর্যাদা এবং তাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লার পুরস্কাররাজির উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, হযরত আবু বকর (রা.) আল্লাহ্‌র পথে নিজের সব ধন-সম্পদ দান করে দিয়ে নিজে কম্বল পরে নিয়েছিলেন। কিন্তু এর প্রতিদানে আল্লাহ্ তা’লা তাকে কী দেন? তাকে সমগ্র আরবের বাদশাহ বানিয়ে দেন, আর তার হাতেই ইসলামকে নবজীবন দান করেন ও মুরতাদ আরবকে পুনরায় জয় করে দেখান এবং সেসব বিষয় দান করেন যা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। তাদের সততা ও বিশ্বস্ততা এবং নিষ্ঠা ও দয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। সাহাবীদের জীবন এমন অনুপম উদাহরণ যে অন্য কোন নবীর ক্ষেত্রে তার কোন জুড়ি পাওয়া যায় না। আসল কথা হল, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার আকাঙক্ষা ও স্বার্থ পরিত্যাগ করে খোদা তা’লার দরবারে না আসে, ততক্ষণ সে কিছুই পায় না; উল্টো নিজের ক্ষতি করে। কিন্তু যখন সে মনের যাবতীয় আকাঙক্ষা ও স্বার্থ ত্যাগ করে এবং রিক্তহস্তে স্বচ্ছ্ব হৃদয় নিয়ে খোদা তা’লার দরবারে যায়, তখন খোদা তাকে দান করেন। কিন্তু এর জন্য শর্ত হল মানুষ যেন মৃত্যুর জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায় এবং তাঁর পথে লাঞ্ছনা ও মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যায়। তিনি (আ.) বলেন, দেখ! পৃথিবী এক লয়শীল জিনিস, কিন্তু এর স্বাদ সেই ব্যক্তি পায় যে খোদার জন্য একে ছেড়ে দেয়। এই কারণেই যারা খোদার খাতিরে জগৎবিমুখ হন, খোদা জগতকে তাদের গুণগ্রাহী বানিয়ে দেন। এটিই সেই সম্মান যা পাবার জন্য জগতপূজারীরা লালায়িত থাকে এবং তার জন্য সহস্র চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। মোটকথা সকল পার্থিব সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা সেই ব্যক্তিকেই দেয়া হয় যিনি খোদা তা’লার জন্য এই সবকিছু পরিত্যাগ করেন।

হুযূর বলেন, সাহাবীদের সততা ও বিশ্বস্ততা এবং নিষ্ঠা ও দয়ার আদর্শ এত সমুজ্জ্বল যে তা দেখে মানুষ আশ্চর্য হয়ে যায়। মহানবী (সা.)-এর পবিত্রকরণ শক্তি কেবল তাদের ভালবাসার রুখ পাল্টে দেয় নি, বরং ভালবাসাকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে যার উপমা এই পৃথিবীতে ছিল না। তাদের ভালবাসা ও আত্মত্যাগের উপমা পূর্ববর্তী নবীদের জীবনেও দেখা যায় না, তাদের মান্যকারীরা তো দূরে থাক। হুযূর কয়েকজন সাহাবীর উদাহরণ উপস্থাপন করেন যে কিভাবে তারা নিজেদেরকে খোদা তা’লার নির্দেশের অধীন করে নিয়েছিলেন আর কেমন উদাহরণ তারা দেখিয়েছেন। হযরত আব্বাদ বিন বাশার নামে একজন আনসারী সাহাবী ছিলেন। পূর্ণ যুবক অবস্থায়, প্রায় ৩৫ বছর বয়সে শাহাদত লাভ করেন। তার ইবাদত ও কুরআন তেলাওয়াতের একটি ঘটনা হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন, একরাতে মহানবী (সা.) তাহাজ্জুদের জন্য উঠলে শুনতে পান মসজিদ থেকে তেলাওয়াতের শব্দ ভেসে আসছে। তিনি (সা.) বলেন, এটা কি আব্বাদের গলা না? হযরত আয়েশা বলেন, তা-ই তো মনে হচ্ছে। তখন মহানবী (সা.) দোয়া করেন, হে আল্লাহ্! আব্বাদের প্রতি কৃপা বর্ষণ কর। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) আব্বাদ (রা.)-এর একটি স্বপ্ন বর্ণনা করেন যার ভিত্তিতে জানা যায়, তিনি নিজের শাহাদাত লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। তার একাগ্র ইবাদতেরই ফলাফলে তিনি শাহাদাতের মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য পান।

আরেকজন সাহাবী হারাম বিন মিলহান (রা.), তিনি যুবক ও অন্যান্যদের কুরআন শেখানোতে এবং গরীব ও আসহাবে সুফফার সেবায় অগ্রগামী ছিলেন। বি’রে মা’ঊনার ঘটনায় যে ৭০জন সাহাবী শহীদ হন, তাদের আমীর ছিলেন হারাম বিন মিলহান (রা.)। যখন তাকে পেছন দিক থেকে ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হয় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, তখন তিনি (রা.) হাতে সেই রক্ত নিয়ে বলেন, কা’বার প্রভুর শপথ! নিশ্চয়ই আমি সফল হয়ে গিয়েছি। আল্লাহ্‌র ভালবাসায় তারা এতটাই মগ্ন ছিলেন যে তাঁর পথে যেকোন আত্মত্যাগ বা কষ্ট স্বীকারে তারা এক অসাধারণ স্বাদ পেতেন। এমনই আরেক সাহাবী ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর আনসারী (রা.), যিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি যুদ্ধে যাবার আগেই নিজের ছেলেকে ডেকে একথা বলেছিলেন যে যুদ্ধে প্রথম আমি-ই শহীদ হব, হয়তো তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে আগেই জেনে গিয়েছিলেন। তিনি ছেলেকে আরও বলেন, আমার মৃত্যুর পর তুমি তোমার বোনদের খেয়াল রাখবেদ; আর এক ইহুদীর কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছিলাম, আমার খেজুর বাগানের ফসল থেকে সেই ঋণ আদায় করবে। হযরত আব্দুল্লাহ্ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত হন নি, বরং সানন্দে তাতে অগ্রসর হয়েছেন; আর ছেলের উপর যে কাজ ন্যস্ত করে যান তা-ও মূলত আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালনের জন্যই করেন- এই ছিল তাদের নমুনা। হুযূর হযরত আমর বিন জামু (রা.), হযরত আবু তালহা (রা.), হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.) প্রমুখ সাহাবীদের আত্মত্যাগ ও আত্মবিলীনতার উদাহরণও উপস্থাপন করেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, উন্নতি ধাপে ধাপে হয়, সাহাবীদের উন্নতিও ধাপে ধাপে হয়েছিল। মহানবী (সা.) সাহাবীদেরকে দেখে চাইতেন তারা যেন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেন। এই উন্নতির জন্য সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা উন্নতির সেই শিখরে পৌঁছেন যেখানে পৃথিবী আগে কখনো পৌঁছতে পারে নি। খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সঠিকভাবে সাহাবীদের মর্যাদা বোঝার তৌফিক দান করুন এবং তাদের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে আমাদেরকে নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততায় অগ্রসর হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।