সদগুণাবলী, নৈতিকতায় উৎকর্ষ অর্জন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-মার্চ, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২রা মার্চ, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সৎগুণাবলী, নৈতিকতা এবং আদবকায়দা প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, ইসলামে উন্নত চারিত্র্য অর্জন, সর্বদা উন্নত আচরণ প্রদর্শন, নিজ ঘর ও সমাজ এবং সর্বস্তরে সদাচরণ করার এবং আপন-পর সকলের সাথে সদ্ব্যবহার করার যে পরিমাণে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, অন্য কোন ধর্মে এত বিস্তারিতভাবে তা বর্ণনা করা হয় নি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল সাধারণত মুসলমানরাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিম্নস্তরে রয়েছে বলে ধরা হয়, অমুসলিমরা তাদের দিকে আঙুল তোলে; এর কারণ হল তারা যা বলে তা করে না। মহানবী (সা.) নিজ কর্ম দ্বারাও এবং বিভিন্ন সময়ে বারংবার নির্দেশ দ্বারাও তাঁর উম্মতকে উন্নত চারিত্র্য অর্জনের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। সাধারণভাবে মুসলমানরা মহানবী (সা.)-কে ভালবাসার দাবী তো করে, কিন্তু তাঁর (সা.) কথা ও আদর্শ অনুসরণের বেলায় নেই বললেই চলে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু তাঁকেও তারা গ্রহণ করে নি, এমনকি অনেক স্থানে তাঁর চরম বিরোধিতা করা হয়েছে এবং সাধারণ ভদ্রতা তো দূরে থাক, অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের লোকদের মত চরম নোংরা ও গালিগালাজপূর্ণ ভাষা তাঁর ও তাঁর মান্যকারীদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের এরূপ আচরণ আমাদের আহমদীদের মনোযোগ এদিকে আকর্ষণ করার কারণ হওয়া উচিত যে আমরা যেন উন্নত চারিত্র্য অর্জনের জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যা ইসলামের শিক্ষা এবং যার আদর্শ মহানবী (সা.) আমাদের দেখিয়েছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন।

হুযূর বলেন, মহানবী (সা.)-এর আদর্শ দেখলে অত্যন্ত আশ্চর্য হতে হয়। ঘরোয়া বিষয়াদিতে দেখুন, একদিকে তিনি (সা.) একজন স্ত্রীর প্রতি আরেকজন স্ত্রীর সামান্য মশকরাতেও তীব্র অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ করেছেন যে কারও আবেগে আঘাত করা অনুচিত, অন্যদিকে সেই স্ত্রীকে এটি শেখাচ্ছেন যে অপর স্ত্রীর কাজে যেন তিনি অসন্তুষ্টি প্রদর্শন না করেন। ছোট শিশুদেরকেও আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করার শিক্ষা প্রদান করেছেন বা তাদেরকে সাধারণ ভদ্রতামূলক আচরণ শিখিয়েছেন, যেন বড় হয়ে তাদের মধ্যে উন্নত আচরণ দেখা যায়। তেমনিভাবে মিথ্যা যে একটি পাপ এবং সত্যবাদিতা একটি পুণ্য- এটিও শিশুদের মাঝে শৈশব থেকেই যেন সৃষ্টি হয় সেজন্য নসীহত করেছেন। একজন সাহাবী এ বিষয়ে এমন একটি ঘটনা বলেন যা তার শৈশবে ঘটেছিল এবং সেটির প্রভাবে বড় হয়েও সেই সাহাবী তা মনে রেখেছেন ও পালন করেছেন। একবার মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে এই উপদেশ দেন যে যদি তুমি সব মন্দকাজ পরিত্যাগ করতে না পার তবে কেবল একটি মন্দকাজ, মিথ্যা বলা ছেড়ে দাও। এখন মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা দেখুন, তাদের অবস্থা কেমন; আর আমাদের নিজেদের অবস্থার দিকেও তাকাতে হবে যে আমরাও কি সেরূপ সূক্ষ্মভাবে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করছি কি-না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, একবার মহানবী (সা.) ‘কবিরা গুনাহ’ বা বড় পাপ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’লার সাথে কোন কিছুকে শরীক করা ও পিতা-মাতার অবাধ্যতার উল্লেখ করেন এবং এরপর হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে বলেন, আর ভালভাবে শুন! মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া… বর্ণনাকারী বলেন, এই শেষের কথাটি তিনি (সা.) বারবার বলতেই থাকেন, এত বেশিবার বলেন যে আমাদের মনে হতে লাগল- হায়, তিনি (সা.) যদি এবার শান্ত হতেন!

অনুরূপভাবে তাঁর (সা.) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মানও দেখার মত। একবার এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করে দেয়। সবাই তাকে থামানোর জন্য ছুটে এল, কিন্তু মহানবী (সা.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও আর যেখানে সে প্রস্রাব করেছে সেখানে পানি ঢেলে দাও’। এরপর তিনি (সা.) বলেন, ‘তোমাদেরকে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের প্রতি কাঠিন্য সৃষ্টির জন্য না’। সেই বেদুইন সবসময় মহানবী (সা.)-এর এই দয়ার্দ্র আচরণের উল্লেখ করত। অথচ এখন তো মনে হয় মুসলমান দেশগুলো বা আলেম-উলামা বা সংগঠনগুলোর কাজই হল পৃথিবীতে কাঠিন্য সৃষ্টি করা। একবার তিনি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কর্মকান্ড ভাল না মন্দ তা বুঝতে হলে নিজ প্রতিবেশীর অভিমত নাও যে সে তোমার কাজের মূল্যায়ন কিভাবে করে’। ঊর্ধ্বতনদেরকে বলেন, ‘তোমাদের আচরণ তখন উন্নত বলে গণ্য হবে যখন তোমরা নিজেদেরকে জাতির সেবক মনে করবে এবং জনগণের সেবায় সাধ্যমত চেষ্টা করবে’। আজ এই আদর্শ কোথায়? আবার তাঁর (সা.) উন্নত আদর্শ আমরা দেখতে পাই মক্কা বিজয়ের সময়, বিজয়ী হয়ে তিনি প্রাণের শত্রুদেরকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার পরও ক্ষমা করে দিয়েছেন, আর এটি-ই অনেকের ইসলাম গ্রহণের কারণও হয়েছে।

মহানবী (সা.)-এর উন্নত চারিত্র্যের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লা ঘোষণা দেন- ‘ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আযীম’ অর্থাৎ নিশ্চয় তুমি এক মহান চারিত্র্যে অধিষ্ঠিত রয়েছ। এর মানে হল যত প্রকার সুন্দর মানবীয় গুণাবলি রয়েছে, সেগুলো সব সর্বোচ্চ মাত্রায় তাঁর (সা.) মাঝে বিদ্যমান। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ‘উন্নত চারিত্র্যের পরিচয় দুটি সময় পাওয়া যায়- পরীক্ষা ও কষ্টের সময় এবং শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময়। কষ্টের সময় যে ধৈর্য ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের আদর্শ দেখায় সে সেই উন্নত মানে অধিষ্ঠিত, আর বিজয় ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময় যে বিনয় ও ন্যায়বিচারের আদর্শ দেখায় সে সেই মানে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য’। আর এই উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের নেতা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ জাজ্বল্যমান। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ‘অধিকাংশ লোক যদি কোন একটি গুণে গুণান্বিত হয়ও, তবে অন্য কোন ক্ষেত্রে সে ত্রুটিপূর্ণ থাকে। কিন্তু মহানবী (সা.) সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন’। তাই একজন মুসলমানের সর্বক্ষেত্রে তাঁর (সা.) আদর্শকে দেখা ও অনুসরণ করা উচিত।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ‘উন্নত চারিত্র্য ও আদর্শ মহানবী (সা.)-এর সবচেয়ে বড় মোজেযা বা কেরামত ছিল। এটি এমন মোজেযা ছিল, যা দেখে সেসব লোকও তাঁকে (সা.) গ্রহণ করেছিল যারা অন্যান্য মোজেযা দেখা সত্ত্বেও সত্য গ্রহণ করছিল না’। তিনি (আ.) নিজ জামাতকেও উপদেশ দেন যে, ‘তোমরাও যদি কেরামতের অধিকারী হতে চাও তবে মন্দ অভ্যাস পরিত্যাগ করে উন্নত চরিত্র অর্জন কর, সেটিই কেরামত হবে’। তিনি (আ.) বলেন, ‘আখলাক বা উত্তম চরিত্র সকল নেকীর চাবিকাঠি, এটি না থাকলে বাহ্যিক ইবাদত, নামায-রোযা ইত্যাদিও একসময় অন্তঃসারশূণ্য হয়ে যায়। প্রকৃত পুণ্যবান ব্যক্তি অবশ্যই উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। বস্তুতঃ আখলাক বা চরিত্রকে পরিত্যাগ করাই পাপের কারণ, আখলাক ছেড়ে দিলে ধীরে ধীরে মানুষ পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে’।

খুতবার শেষদিকে হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের চরিত্রকে সবদিক থেকে এবং সর্বক্ষেত্রে উন্নত থেকে উন্নততর করার তৌফিক দান করুন; আমাদের চারিত্র্যের মান পৃথিবীকে প্রদর্শনের পরিবর্তে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হোক; আল্লাহ্‌র সৃষ্টজীবের জন্য আমাদের হৃদয়ে প্রকৃত সহমর্মিতা সৃষ্টি হোক; তাকওয়ার মানকে যেন আমরা উন্নত করতে পারি; আমরা যেহেতু এ যুগের ইমামকে মেনেছি তাই আমাদের সর্বদা যেন এদিকে মনোযোগ থাকে যে আমাদের কোন কাজ যেন ইসলাম, মহানবী (সা.) বা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দুর্নামের কারণ না হয়, বরং আমরা যেন ইসলামের সুন্দর শিক্ষাকে বিস্তারকারী হই ও এদ্বারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে পারি; আর সবথেকে বড় কথা হল আমরা যেন নিজেদের আখলাকের মানকে বৃদ্ধি করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকি এবং একাজে সফল হবার জন্য সর্বদা আল্লাহ্‌র দরবারে বিনত হয়ে তাঁর কাছে দোয়া করে সাহায্য প্রার্থনা করি। আমীন।

খুতবার শেষে হুযূর (আই.) করাচি নিবাসী শেখ আবদুল মজিদ সাহেবের গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন, যিনি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর মরহুমের যিকরে খায়ের করেন এবং তার পদমর্যাদা উন্নত হবার ও তার পুণ্যসমূহ তার বংশধরদের মাঝে বহমান থাকার জন্য দোয়া করেন।