আল্লাহ্‌র একনিষ্ঠ দাস: সাহেবযাদা মির্যা গোলাম আহমদ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৯-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৯ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সদ্য প্রয়াত হযরত সাহেবযাদা মির্যা আযীয আহমদ সাহেব (রা.) এর পুত্র শ্রদ্ধাস্পদ সাহেবযাদা মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব-এর জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তির জানাযা একশ’ মুসলমান মিলে পড়ে এবং সবাই তার ক্ষমার জন্য সুপারিশ করে, তাদের সুপারিশ গৃহীত হয়। আরেকটি বর্ণনায় আছে, এক ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাবার সময় লোকজন তার প্রশংসা করতে লাগল; এতে মহানবী (সা.) বললেন, তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে গেল। আজ যেহেতু আমার দু’টি জানাযার উল্লেখ করার ছিল, তাই ভেবেছিলাম জানাযা ও দাফন-কাফন বিষয়ে আরও কিছু হাদীস, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর উদ্ধৃতি এবং কিছু ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয়াদি উল্লেখ করব, তারপর মরহুমদ্বয়ের স্মরণ করব। কিন্তু তা সম্ভব না, কারণ জামাতের সেই সেবক, যিনি ওয়াকফের দায়িত্বকে নিষ্ঠার সাথে পূর্ণকারী ও খেলাফতের আনুগত্যকারী, যার যিকরে খায়ের করতে যাচ্ছি, তার সম্বন্ধে জামাতের সদস্যদের এতসব কথা সম্বলিত চিঠি এসেছে যে তা-ই বর্ণনা করে শেষ করা অসম্ভব; যা চিঠি এসেছে তার এক-পঞ্চমাংশ আমি এনেছি আর তা-ও বোধহয় সব বলে সারতে পারব না। এ বর্ণনাগুলো একজন ওয়াকেফে যিন্দেগী বা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পরিবারের সদস্যদের বা কর্মকর্তা ও সাধারণ সদস্যদের জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকে পথনির্দেশক ও অনুকরণীয় আদর্শ।

হুযূর বলেন, আপনারা জানেন ক’দিন পূর্বে জামাতের একজন একনিষ্ঠ সেবক মোহতরম সাহেবযাদা মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব, পিতা সাহেবযাদা মির্যা আযীয আহমদ সাহেব (রা.) ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি হঠাৎ হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রপৌত্র ও মীর মোহাম্মদ ইসহাক সাহেবের দৌহিত্র ছিলেন, তিনি হুযূর (আই.)-এর বোনাই ছিলেন। তবে এসব সম্পর্ক তাকে উল্লেখযোগ্য বানায় নি, বরং তিনি উল্লেখযোগ্য হয়েছেন তার গুণাবলীর কারণে। ধর্মের সেবক ছিলেন, ওয়াক্‌ফে যিন্দেগী ছিলেন, অসুস্থতা ও সম্প্রতি তার বড় ভাই মির্যা খুরশীদ আহমদ সাহেবের মৃত্যুতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু যখন হুযূর তাকে নাযেরে আলার দায়িত্ব দেন তখন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণতার সাথে সব দাপ্তরিক ও অন্যান্য কাজ করেছেন। এমনকি মৃত্যুর আগের দিনও মাদরাসাতুল হিফযের নতুন হাফেযদের সনদ-বিতরণ অনুষ্ঠান, খোদ্দামদের সভায় উপস্থিত হয়েছেন, মৃত্যুর দিন সকালেও জামাতের সদস্যদের ও কয়েকজন অসুস্থ রোগীকে দেখতে গিয়েছেন, পাঁচবেলার নামায মসজিদে মোবারকে গিয়ে জামাতে পড়েছেন। ১৯৬২ সালের মে মাসে জীবন উৎসর্গ করেন। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেন, পরে পাবলিক সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে পরে সেই চাকরি না করে ওয়াক্‌ফ করেন। এর কারণ তিনি নিজেই বলেন যে কেউ যেন একথা মনে করতে না পারে যে যাদের অন্য কোন কিছু করার যোগ্যতা নেই তারাই ওয়াক্‌ফ করে। খলীফা সানী (রা.) তাকে রিভিউ অব রিলিজিয়নের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত করেন। তার নাম প্রথমে মির্যা সাঈদ আহমদ রাখা হয়েছিল, কিন্তু তার মায়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে হযরত মুসলেহ্ মওউদ তার নাম বদলে মির্যা গোলাম আহমদ রাখেন, আর এটাও বলে দেন যে ‘তাকে আমরা শুধু আহমদ বলেই ডাকব’। ১৯৬৪ সনে হুযূর (আই.)-এর সহোদর বোনের সাথে তার বিয়ে হয়, তার তিন পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছেন। দুই পুত্র ওয়াক্‌ফে যিন্দেগী- মির্যা ফযল আহমদ রাবওয়াতে নাযের তালীম, মির্যা নাসের এনাম যুক্তরাজ্য জামেয়ার প্রিন্সিপাল; আর মির্যা এহসান আহমদ আমেরিকায় চাকুরি করছেন তবে জামাতের সেবাও করছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেক্রেটারী মাল।

সাহেবযাদা মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব বিভিন্ন পদে থেকে জামাতের সেবা করেছেন, নাযের তালীম, এডিশনাল নাযের ইসলাহ ও ইরশাদ, নাযের দিওয়ান ও নাযেরে আলা, এছাড়া খলীফা রাবের সময় ভারপ্রাপ্ত নাযেরে আলা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, বিভিন্ন সময়ে আনসারুল্লাহ্ ও খোদ্দামুল আহমদীয়ার সদরসহ বিভিন্ন পদে সেবা করেছেন। ২০১০ সালের ২৮শে মে লাহোরের শাহাদাতের ঘটনার সময় নাযেরে আলার নির্দেশে রাবওয়া থেকে প্রেরিত প্রতিনিধিদলের আমীর ছিলেন, সেখানে গিয়ে জামাতকে সাহস প্রদানের জন্য অসাধারণ সব কাজ করেছেন। তিনি গিয়েই মসজিদে নামায চালু করেন, সভা করে নতুন আমীর নির্ধারণ করেন, হাসপাতালে যান, শোক জ্ঞাপনের জন্য আসা গভর্নর সালমান তাসীরসহ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সাহসের সাথে সদুপদেশ দেন। সেখানে প্রাণের আশংকার কারণে জামাতের নির্দেশে তিনি রাবওয়ায় ফিরে গেলেও পরের জুমুআয় আবারও উপস্থিত হন যেন জামাতের সদস্যরা সাহস না হারান।

খলীফা রাবে (রাহে.) বর্ণিত বেশ কিছু ঘটনা ও স্বপ্নেরও হুযূর উল্লেখ করেন যেগুলো মরহুমের বিশেষ মর্যাদার পরিচায়ক, আর সকল খলীফাই তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দেখেছেন। তার ও তার ভাই মির্যা খুরশীদ সাহেব সম্বন্ধে খলীফা রাবে বলেছিলেন যে এরা দু’জন আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং সকল খলীফারই বিশ্বস্ত। মরহুমের স্ত্রী তার তাহাজ্জুদের নামায সম্বন্ধে বলেন যে তিনি সেজদায় এমনভাবে দোয়া করতেন যে পুরো বাড়িতে যেন একটি গুঞ্জন ছেয়ে যেত। কখনো কোন টাকা বা সম্পদ হস্তগত হলে প্রথমে চাঁদা দিতেন, তারপর অবশিষ্টটা ব্যবহার করতেন।

খেলাফতের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা এবং খেলাফতের আনুগত্যের মূর্তিমান প্রতীক ছিলেন। হুযূর মরহুমের অজস্র ঘটনাবলী থেকে কয়েকটি উল্লেখ করেন ও সবশেষে দোয়া করেন আল্লাহ্ যেন তার পদমর্যাদা উন্নত করেন, তার সন্তানদেরকেও তার পুণ্যসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ও সেগুলোর ধারা বহমান রাখার তৌফিক দিন। আল্লাহ্ তা’লা ভবিষ্যতেও জামাতকে পুণ্যবান, নেক, আত্মবিলীনতা ও নিষ্ঠার সাথে সেবাদানকারী কর্মী দান করতে থাকুন। আমীন।