আল্লাহ্‌র আশ্রয় প্রার্থনার বিভিন্ন পন্থা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২রা ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহান আল্লাহ্‌র পবিত্র গুণ ও আল্লাহ্‌র কাছে সুরক্ষা চাওয়ার পথ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা মুমিনের প্রথম চার আয়াত ও সূরা বাকারার ২৫৬নং আয়াত বা আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা’লার কতিপয় গুণাবলী এবং তাঁর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সকালবেলা এই আয়াতগুলো পড়বে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে নিরাপদ রাখা হবে, অনুরূপভাবে যে এগুলো সন্ধ্যাবেলা পড়বে সকাল পর্যন্ত তাকে নিরাপত্তা দান করা হবে। সূরা মুমিনের দ্বিতীয় আয়াত হল ‘হা-মীম’ যা ‘হামীদ’ ও ‘মাজীদ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ‘হামীদ’ শব্দের অর্থ হল যিনি প্রশংসার যোগ্য বা প্রশংসনীয় এবং প্রকৃত প্রশংসা যার প্রাপ্য। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এই শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি (আ.) বলেন, ‘হামদ’ বা প্রকৃত প্রশংসার যোগ্য কেবল ও কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লারই সত্ত্বা, তাঁকে ছাড়া অন্য যার বা যা কিছুরই প্রশংসা করা হোক না কেন, তার প্রাপকও আসলে আল্লাহ্ তা’লা-ই; কারণ প্রশংসাযোগ্য হওয়ার বা কাজ করার শক্তি ও সামর্থ্য ও সৌভাগ্য তিনিই দান করেছেন। আল্লাহ্ তা’লাকে চিনতে হয় তাঁর সিফাত বা ঐশী গুণাবলীর মাধ্যমে, আর যাবতীয় প্রশংসনীয় গুণাবলীর অধিকারী তিনি-ই- এ বিষয়টি বুঝা যাবে তখন যখন আল্লাহ্ তা’লার ‘হামীদ’ গুণটিবে বুঝা যাবে। এর পরে রয়েছে আল্লাহ্‌র ‘মাজীদ’ গুণটি, যার অর্থ হল আল্লাহ্ মহা মর্যাদার অধিকারী ও অতি পবিত্র। এরপর আল্লাহ্ বলেন যে তিনি ‘আযীয’, অর্থাৎ তিনি মহাশক্তির অধিকারী, সর্বশক্তিমান, সকল ক্ষমতার অধিকারী। এরপর আল্লাহ্ তা’লার আলীম গুণটি বর্ণিত হয়েছে যার অর্থ হল আল্লাহ্ সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং সর্বজ্ঞাতা। সেই আল্লাহ্ই এই কিতাব বা গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর বলা হয়েছে, আল্লাহ্ হলেন ‘গাফিরুয্ যামব্’ বা পাপ-ক্ষমাকারী, তাই তাঁর সমীপে নিজের পাপসমূহ ক্ষমার জন্য ঝুঁকতে হয়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যাবতীয় শারীরিক ও আধ্যাত্মিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য ইস্তেগফার বা আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। ইস্তেগফার কেবল মুখ দিয়ে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ্ আস্তাগফিরুল্লাহ্’ জপে যাওয়ার নাম নয়, বরং ‘ইস্তেগফার’ হল পাপ যেন সংঘটিত হয়ে না যায় সে জন্য আল্লাহ্‌র আশ্রয় প্রার্থনা, আর যেসব পাপ ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়ে গিয়েছে, ভবিষ্যতে যেন তা আর সংঘটিত না হয় বা তার কুফল থেকে যেন আল্লাহ্ নিরাপদ রাখেন সে উদ্দেশ্যে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা করা। এরপর আল্লাহ্‌র ‘কাবিলুত্ তাওব’ গুণটি বর্ণিত হয়েছে, যার অর্থ হল আল্লাহ্ তওবা কবুল করেন। তওবা হল কোন একটি পাপ থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাবর্তন। তওবাও কেবল মুখে বুলি আউড়ে যাওয়ার নাম নয়, বরং প্রকৃত তওবা হল একটি পাপকে চিরতরে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে পূর্বে করা সেই পাপের থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর যখন কেউ এভাবে তওবা করে তখন তার অবস্থা হাদীস অনুসারে ‘যে ব্যক্তি পাপ থেকে তওবা করে, তার যেন কোন পাপ ছিল-ই না’ হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি মুখে বার বার তওবা করে কিন্তু কার্যত পাপ থেকে প্রত্যাবর্তন করে না, তার বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লা বলেন যে তিনি শাদীদুল ইকাব বা শাস্তিদানে অতীব কঠোর।

আয়াতুল কুরসী সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যেভাবে সব বস্তু বা বিষয়ের একটি চূড়া বা সর্বোচ্চ ধাপ থাকে, কুরআনের চূড়া হল আয়াতুল কুরসী। এতে আল্লাহ্ তা’লার দু’টি বিশেষ গুণ একেবারে শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো হল ‘আল্‌-হাই’ ও ‘আল্‌-কাইয়্যুম’। ‘আল্‌-হাই’ শব্দের অর্থ হল আল্লাহ্ চিরঞ্জীব ও জীবনদাতা, অর্থাৎ তাঁর সাহায্য ছাড়া কোন কিছুই জীবিত থাকতে পারে না। আর ‘আল-কাইয়্যুম’ অর্থ হল আল্লাহ্ চিরস্থায়ী ও স্থিতিদাতা। সুতরাং যে ব্যক্তি জীবিত ও টিকে থাকতে চায়, তার জন্য এটি আবশ্যক সে যেন আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, কেননা এটি ছাড়া তার পক্ষে জীবিত বা টিকে থাকা সম্ভব নয়। এরপর আয়াতুল কুরসীতে শাফাআতের বিষয়টিও বর্ণিত হয়েছে, আর প্রকৃত শাফী হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। এই আয়াতের শেষে আল্লাহ্ তা’লার ‘আল্‌-আলী’ ও ‘আল্‌-আযীম’ গুণ দু’টি বর্ণিত হয়েছে। ‘আল্‌-আলী’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহ্ তা’লা অতীব উচ্চ এবং অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, ‘আল্‌-আযীম’ গুণ দ্বারা বুঝা যায় তিনি সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছেন এবং তিনি যাবতীয় মাহাত্ম্যের অধিকারী।

হুযূর (আই.) এভাবে আল্লাহ্ তা’লার উল্লেখিত গুণাবলীর ব্যাখ্যা করেন। হুযূর বলেন, হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেছেন, কেবল মন্ত্রের মত এই আয়াতগুলো পড়লেই হবে না, বরং এগুলোর অন্তর্নিহিত মর্ম উপলদ্ধি করে এবং এগুলোতে বর্ণিত আল্লাহ্‌র গুণাবলীর তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করে তা আত্মস্থ করলে পরে আল্লাহ্ তা’লার আশ্রয় লাভ করা সম্ভব। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই অনুসারে জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর একটি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা করেন যা মোহতরমা আবেদা বেগম সাহেবার, যিনি প্রফেসর আব্দুল কাদের সাহেবের স্ত্রী ছিলেন; তিনি ২২ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমার প্রসঙ্গে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) একবার বলেছিলেন যে তিনি আহমদীয়াতের পক্ষে এক খোলা তলোয়ার। হুযূর মরহুমার সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন ও তার মর্যাদা উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।