দোয়ার শক্তি

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-জানুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৬শে জানুয়ারী, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় দোয়ার গুরুত্ব ও কল্যাণ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একবার দোয়ার দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এক শিশু যখন ক্ষুধায় দুধের জন্য কাঁদে ও চিৎকার করে তখন মায়ের বুকে দুধ সবেগে এসে উপস্থিত হয়। শিশু তো দোয়ার নামও জানে না, কিন্তু তার ক্রন্দন কিভাবে দুধকে টেনে নিয়ে আসে? তিনি (আ.) বলেন, তাহলে আমরা যখন আল্লাহ্‌র দরবারে ক্রন্দন করি, তা কি কিছুই টেনে আনতে পারে না? আনতে পারে এবং সবকিছু আনতে পারে! কিন্তু যাদের চোখ নেই এবং বুলিসর্বস্ব দার্শনিক সেজে বসে আছে, তারা দেখতে পায় না। তিনি (আ.) বলেন, যদি শিশু ও মায়ের সম্পর্ককে দৃষ্টিপটে রেখে মানুষ দোয়ার দর্শন সম্পর্কে ভাবে তবে তা অত্যন্ত সহজে বুঝতে পারবে। হুযূর (আই.) বলেন, আমাদের আহমদীদের প্রতি আল্লাহ্‌র অশেষ কৃপা যে আমাদের ছোট-বড় অধিকাংশ সদস্যই এটি জানে, যদি কেউ ব্যাকুল হৃদয়ে, ক্রন্দন ও বিনয়ের সাথে আল্লাহ্‌র দরবারে ঝোঁকে এবং দোয়া করে তবে আল্লাহ্ তার দোয়া শোনেন, আর কখনো কখনো দোয়া গৃহীত হওয়ার এমন ঘটনা ঘটে যা অন্যদেরও আশ্চর্য করে। অনেকেই আমাকে এমন ঘটনা লিখে থাকে যে কখনো কখনো আমরা এমন বিপদে পড়েছি যা থেকে উদ্ধারের কোন পথ ছিল না, সেই পরিস্থিতিতে যখন আমরা আল্লাহ্‌র দিকে ঝুঁকেছি তখন আল্লাহ্ কৃপা করেছেন, যা আমাদের ঈমান দৃঢ় হওয়ার কারণ হয়েছে। হুযূর (আই.) এরকম কতিপয় ঘটনা তুলে ধরেন।

ভারতের হুশিয়ারপুরের একটি গ্রামে কয়েক বছর পূর্বে বৃষ্টির অভাবে গ্রামবাসী চরম কষ্টে ছিল, কুঁয়োর পানিও একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। হিন্দু অধ্যুষিত সেই গ্রামের সদস্যরা আমাদের মোয়াল্লেম সাহেবকে দোয়া করার জন্য অনুরোধ করে, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে আহমদী মোয়াল্লেম যদি দোয়া করেন তবে অবশ্যই বৃষ্টি হবে। যাই হোক, মোয়াল্লেম সাহেব প্রথমে তাদেরকে ইসলামী দোয়ার পদ্ধতি বলেন, আল্লাহ্‌র গুণাবলী সম্বন্ধে শেখান ও তাদের নিয়ে দোয়া করেন। আল্লাহ্ তা’লা স্বীয় কৃপায় দোয়া কবুল করেন এবং দু’তিন ঘন্টার মাঝেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। গ্রামের লোকদের উপর এর গভীর প্রভাব পড়ে এবং তারা প্রকাশ্যে এটি ঘোষণা দেয় যে আহমদীদের দোয়ার ফলেই বৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপ ঘটনা ফিজি দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ তামালুতেও ঘটেছে। এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সফররত তবলীগি টিমের সদস্যগণ ও জামাতের সদস্যরা এশার নামাযে সিজদায় বৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন যার ফলে আল্লাহ্‌র কৃপা বর্ষিত হয় এবং রাতেই প্রবল বৃষ্টি হয় ও পরে আরও কয়েকবার বৃষ্টি হয়, অথচ আবহাওয়া পূর্বাভাসে আরও অনেকদিন পর্যন্ত অনাবৃষ্টির সংবাদ ছিল। স্থানীয় লোকজন, এমনকি ক্যাথলিক চার্চের বিশপও এই স্বীকারোক্তি দেন যে এটি আল্লাহ্‌র কৃপাতেই হয়েছে এবং আহমদীয়া জামাতের ইমাম ও তাদের দোয়ার ফলে হয়েছে। আর শুধু বৃষ্টি হওয়াই নয় বরং দোয়ার ফলে বৃষ্টি থেমে যাওয়াও কখনো কখনো নিদর্শন হয়েছে। গিনিতে একজন মোয়াল্লেম আব্দুল্লাহ্ সাহেব কোন একটি গ্রামে তবলীগে যান। তবলীগ চলাকালীন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয় যার শব্দে তবলীগ ব্যাহত হচ্ছিল এবং লোকজন চলে যেতে উদ্যত হয়। মোয়াল্লেম সাহেব দোয়া করেন যেন বৃষ্টি থেমে যায় এবং তিনি আল্লাহ্‌র প্রেরিত মসীহ্‌র সংবাদ সবাইকে শোনাতে পারেন। আল্লাহ্ কৃপা করেন এবং প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টি থেমে যায়। উপস্থিত সকলের উপর এর গভীর প্রভাব পড়ে, যার ফলে সেখানে উপস্থিত দেড়শ’ ব্যক্তির সকলেই তবলীগ শেষ হওয়ার পর বয়আত গ্রহণ করেন। হুযূর (আই.) বলেন, লোকেরা বলে ‘খোদাকে কিভাবে দেখা যায়?’ খোদা তা’লা এভাবে তাঁর নিদর্শন দেখিয়ে দৃষ্টিগোচর হন! এমনি একটি ঘটনা বান্দান্দোতেও ঘটেছে। আরেকটি স্থান লেকভিলে জামাত মসজিদ বানানোর জন্য জায়গা কিনেছে, সেখানে ইসলামের শান্তির পরিচিতির জন্য বৃক্ষরোপনের একটি কর্মসূচী রাখা হয় যাতে অনেক অতিথিকে দাওয়াত দেয়া হয়। প্রোগ্রামের দিন আবহাওয়া পূর্বাভাস ছিল তীব্র বৃষ্টি হবার, তাই আহমদীরা হুযূরকে বারবার অনেক চিঠি লিখে দোয়ার জন্য যেন বৃষ্টি না হয়। প্রোগ্রামের দিন বৃষ্টি শুরুও হয়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রোগ্রাম শুরুর ঘন্টাখানেক আগেই তা হঠাৎ থেমে গিয়ে সূর্য উঁকি দেয়। এই ঘটনা আমন্ত্রিতদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে, স্থানীয় কাউন্সিলের সভাপতি বলেই বসেন, ‘আপনারা কি আবহাওয়াও অর্ডার দিয়ে বদলে নেন নাকি?’ ফলে আহমদীরা দোয়া ও দোয়ার কবুল হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরার সুযোগ পান। এভাবে আহমদীদের দোয়া তাদের ঈমান দৃঢ় করার পাশাপাশি অ-আহমদী ও অমুসলিমদেরও আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের নিদর্শন দেখায়।

প্রাকৃতিক এসব ঘটনা ছাড়াও আরও অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে ঈমানের দৃঢ়তার কারণ হয়ে থাকে। বেনিনের এক নতুন বয়আতকারী ব্যক্তির স্ত্রীর সন্তান হবার সময়ের এমনই এক ঘটনা সেখানকার মুরব্বী সাহেব লিখে পাঠিয়েছেন। সেই মহিলার ইতোপূর্বে দু’বার একই রকম অবস্থা ঘটেছে এবং প্রত্যেকবারই সন্তান মারা গিয়েছে। কিন্তু এবার দোয়ার ফলশ্রুতিতে সেই মহিলাও সুস্থ হয়েছেন আর তারা পুত্রসন্তানও লাভ করেছেন। এর ফলে সেই নতুন আহমদী দোয়ায় পূর্ণ বিশ্বাসী হয়েছেন এবং নিয়মিত দোয়াকারীতে পরিণত হয়েছেন। একইভাবে কেনিয়া, বেলজিয়াম, ভারতসহ বিভিন্ন স্থানের কয়েকটি ঘটনা হুযূর বর্ণনা করেন যেখানে ডাক্তার কোন রোগীর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন যে তাদের কোন আশা নেই, কিন্তু পরবর্তীতে হুযুরের দোয়ার প্রেক্ষিতে তারা বিস্ময়করভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এগুলো ছাড়াও হুযূর দোয়া গৃহীত হওয়ার আরও কতিপয় ঘটনা উল্লেখ করেন যেগুলো জামাতের সদস্যদের জন্য জামাত ও খেলাফতের সাথে সম্পর্ক ও আল্লাহ্‌র উপর ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়েছে। এ সকল ঘটনাবলী বর্ণনার পর হুযূর (আই.) বলেন, মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, প্রকৃতির নিয়মে দোয়া গৃহীত হওয়ার উপমা রয়েছে, এই নিয়মের অধীনেই আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক যুগে তাজা নিদর্শন দেখান। আর যদি দোয়া গৃহীত হবার জীবন্ত নিদর্শন কেউ দেখতে চায়, তবে কিছু আবশ্যক শর্তও পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম হল আমলে সালেহা বা সৎকর্ম এবং বিশ্বাস সৃষ্টি। যে ব্যক্তি নিজের বিশ্বাস ও কর্মকে সংশোধন ও উন্নত করে না, তা সত্ত্বেও দোয়া করে- সে যেন আল্লাহ্‌কে পরীক্ষা করে। আর আমলে সালেহা বা সৎকর্মের মধ্যে আল্লাহ্‌র হক ও সৃষ্টির হক- দু’টিই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ইবাদত ও সৃষ্টির সেবা দু’টি ক্ষেত্রেই উন্নতি অর্জন করতে হবে। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকলকে তাঁর নির্দেশানুসারে নিজেদের জীবন গড়ার তৌফিক দিন এবং সর্বদা ইবাদত ও দোয়ার হক আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

খুতবার শেষে হুযূর দু’টি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। প্রথমটি মোকাররম চৌধুরী নেয়ামতুল্লাহ্ সাহেবের যিনি ১৫ জানুয়ারি কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় জানাযা শেখুপুরার জাফরুল্লাহ্ খান সাহেবের যিনি ৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর উভয় মরহুমের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন ও তাদের মর্যাদা উন্নত হওয়ার জন্য দোয়া করেন।