আদর্শ মানব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৫-ডিসেম্বর, ২০১৭

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “আদর্শ মানব”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর, সূরা তওবার ১০০নং আয়াত তেলাওয়াত করেন যার অনুবাদ হল: ‘আর মুহাজির ও আনসারদের প্রথম সারির অগ্রগামীদের ওপর এবং সেইসব লোক যারা উত্তমরূপে তাদের অনুসরণ করেছে তাদের ওপরও আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য এমন সব জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন যার পাদদেশ দিয়ে নদনদী বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ-ই হল মহা সফলতা।’

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এই আয়াতে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের বর্ণনা রয়েছে যারা অগ্রগামী, আধ্যাত্মিকতায় সবচেয়ে উচ্চ এবং ঈমান ও আল্লাহ্‌র আদেশ পালনের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ছিলেন। তারাই প্রথমে ঈমান এনেছেন এবং পরবর্তীদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’লা এই আয়াতে সাহাবাদেরকে পরবর্তীতে আগমনকারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, আর এই ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি তাদের ঈমানের আদর্শ ও কৃতকর্মের জন্য তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টিকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আর যারা তাদের আদর্শকে অনুসরণ করবে, তারা আল্লাহ্‌র পুরস্কারসমূহ লাভ করতে থাকবে। মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীসে কুদসীতেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, আমি আল্লাহ্‌র কাছে আমার সাহাবীদের মতভেদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম। আল্লাহ্ ওহী করেন, ‘হে মুহাম্মদ! তোমার সাহাবীদের মর্যাদা আমার কাছে আকাশের তারাদের মত, কতক অপর কতকের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল, কিন্তু প্রত্যেকেই উজ্জ্বল। যে তাদের কোন একজনকেও অনুসরণ করবে, আমার কাছে সে হেদায়েতপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে।’ তাদের মহান মর্যাদা প্রসঙ্গে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, তারা আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-এর পথে সেই বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছেন যার ফলশ্রুতিতে তাদের জন্য ‘রাযিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাযূ আনহু’ ঘোষণা এসেছে। এই মর্যাদার বৈশিষ্ট্য ও পূর্ণতা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। তোমরাও চেষ্টা কর যেন আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তোমরাও তাঁর মাঝে তুষ্ট হয়ে যাও, অর্থাৎ তাঁর প্রতি কোন অভিযোগ-অনুযোগ না থাকে; তাহলে পরে তিনি তোমাদের শরীরে ও কথায় বরকত সৃষ্টি করে দেবেন। হুযুর (আই.) বলেন, যদি আমরা আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জন করতে চাই তবে সাহাবীগণ আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের প্রসঙ্গে এই সতর্কবাণী প্রদান করে গিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে যেন খোদাভীতি অবলম্বন করা হয়, তাদেরকে যেন অপমানের লক্ষ্য না বানায়; যারা তাদের প্রতি ভালবাসা দেখাবে তা আমার প্রতি ভালবাসার কারণেই করবে, আর যে তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে সে আসলে আমারই প্রতি বিদ্বেষ থেকে তা করবে; যে তাদের দুঃখ দিল, সে যেন আমাকেই দুঃখ দিল, আর যে আমাকে দুঃখ দিল সে আসলে আল্লাহ্কেই দুঃখ দিল। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তারা আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-এর জন্য অজস্র ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এসমস্ত ক্ষেত্রে তারা অতুলনীয়। আর এখন প্রতিশ্রুত মসীহ্‌র জামাতকেও তাদের অনুরূপ হতে হবে, কেননা আল্লাহ্ বলেছেন যে মসীহ্‌র সঙ্গীরা সাহাবীদের তুল্য হবে; কিন্তু আপনারা কি সেই অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন?

হুযুর (আই.) সাহাবীদের (রা.) কয়েকজনের কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর সেবার একটি ঘটনা তো হল তিনি (রা.) ধর্মের প্রয়োজনের সময় একবার বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তার বিনয়ের একটি ঘটনাও হুযুর উদ্ধৃত করেন। একবার হযরত উমরের সাথে তার কোন বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বাকবিতন্ডা হয়। কিছুক্ষণ পরে তিনি (রা.) হযরত উমরের কাছে গিয়ে এ কারণে ক্ষমা চান, কিন্তু উমর (রা.) তর্কের জেরে ক্ষমা করতে অস্বীকার করেন। তখন হযরত আবু বকর মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা বলে তাঁর (সা.) কাছে ক্ষমা চান, মহানবী (সা.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ ক্ষমা করুন। একটু পরে উমর (রা.)-ও অনুতপ্ত হয়ে আবু বকরের কাছে ক্ষমা চাইতে তার বাড়িতে যান, পরে তাকে না পেয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে হাজির হন। উমরকে দেখে মহানবী (সা.)-এর চেহারা অসন্তুষ্টিতে রক্তিম হয়ে যায়। এটি দেখে আবু বকর (রা.) হাঁটু গেড়ে বসে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিবেদন করেন, ভুল আমি করেছি, আপনি উমরকে ক্ষমা করে দিন। এটি ছিল তার বিনয়ের অবস্থা। হযরত উমর (রা.)-ও বিনয়ে কম ছিলেন না। একবার কেউ তাকে বলে, আপনি তো আবু বকরের চেয়ে উত্তম। এটি শুনে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, খোদার কসম! আবু বকরের একটি রাত ও একটি দিনই উমর ও তার সন্তানদের সারা জীবনের চেয়েও উত্তম। সেই রাতটি হল যে রাতে মহানবী (সা.) হিজরত করেন তখন আবু বকর তার সঙ্গী হন, আর দিনটি হল মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর যখন সমগ্র আরব নামায ও যাকাত অস্বীকার করে বসে আর আবু বকর আমার পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের সিদ্ধান্ত নেন, আর আল্লাহ্ তাকে সফল করে প্রমাণ করেন যে তিনি সঠিক ছিলেন। হযরত উসমান (রা.)-এর সেবারও অজস্র ঘটনা রয়েছে; মসজিদে নববী সম্প্রসারণের সময় এর জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে জমি ক্রয় করা বা মুসলমানদের পানির সংকটের সময় মাত্রাতিরিক্ত মূল্য দিয়ে রূমা কূপ ক্রয় করে তা ওয়াকফ করে দেয়া ইত্যাদি। একইভাবে হযরত আলী (রা.)-ও অত্যন্ত সাহসী, শক্তিশালী ও বীর ছিলেন; ন্যায়বিচারক, প্রজ্ঞাবান, পার্থিবতাবিমুখ, ইবাদতকারী, ক্রন্দনকারী ইত্যাদি অজস্র গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন, যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন স্বয়ং আমীর মুয়াবিয়া, যিনি হযরত আলীর বিরোধী ছিলেন।

হুযুর (আই.) হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ, সাদ বিন ওয়াক্কাস, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ্, আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ, বেলাল, সাদ বিন মুআয প্রমুখ সাহাবীদেরও বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেন। খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) বলেন, আমাদের চেষ্টা করা উচিত নিজেদের সংশোধন করার ও নিজেদের হৃদয়ের পাত্রকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার। যেহেতু আমরা মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রেমিক মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মেনেছি, তাই আমাদের সেই সমস্ত বিষয়ও মানা উচিত যা মসীহ্ মওউদ (আ.) বর্ণনা করেছেন- যে আদর্শ প্রথমে তো মহানবী (সা.) স্বয়ং প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর পরবর্তীতে তাঁর সাহাবীগণ (রা.) আমাদের সেগুলোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রদর্শন করেছেন; তাহলেই আমরা প্রকৃত মুসলমান হতে পারব। হুযুর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমীন।