আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৮-ডিসেম্বর, ২০১৭

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৮ই ডিসেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর, সূরা আলে ইমরানের ১৫নং আয়াত তেলাওয়াত করেন যার অনুবাদ হল: ‘মানুষের কাছে স্বাভাবিক কামনার বস্তুগুলো, অর্থাৎ নারীদের, সন্তান-সন্ততির, কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা-রূপার এবং বিশেষভাবে চিহ্ণিত অশ্বরাজির, গবাদি পশুর এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তিকে সুন্দর করে দেখান হয়েছে। এগুলো হল পার্থিব জীবনের সাময়িক ভোগ্যসামগ্রী। অথচ আল্লাহ্‌র কাছেই রয়েছে সর্বোত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এই আয়াতে সেসব লোকের চিত্র তুলে ধরেছেন যারা তাঁকে ভুলে গিয়ে পার্থিবতাতেই নিমগ্ন হয়ে পড়ে। মানুষ যখন আল্লাহ্‌কে ভুলে যায় তখন শয়তান তাকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। যদিও এসব বস্তু আল্লাহ্‌রই সৃষ্ট ও তাঁর নেয়ামত এবং এগুলো দ্বারা উপকৃতও হওয়া উচিত, কিন্তু এগুলোতে মগ্ন হয়ে যাওয়া অনুচিত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও বলেছেন, আল্লাহ্ কখনই এটি চান না তোমরা পৃথিবী একেবারেই পরিত্যাগ কর, বরং তাঁর ইচ্ছা হল ‘কাদ আফলাহা মান যাক্কাহা’ অর্জন অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তি সফল হয়েছে যে তার আত্মাকে পবিত্র করেছে’। পার্থিব কাজ কর, কিন্তু আত্মাকে আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখ, আর এমনভাবে একে পবিত্র কর যেন পার্থিব কাজ তোমাদেরকে আল্লাহ্‌র ব্যাপারে উদাসীন করে না দেয়। তাই একজন মুমিনের একথা সদা-সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, দুনিয়ার ভালবাসা যেন আল্লাহ্‌কে ভুলিয়ে না দেয়।

আলোচ্য আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ ‘শাহাওয়াত’-এর অর্থ হল কোন বস্তুর তীব্র ও উদগ্র বাসনা ও সর্বদা সেটির চিন্তায় মগ্ন থাকা; অর্থাৎ এমন বস্তু বা উদ্দেশ্য যা কেবল প্রবৃত্তির কামনা থেকে উদ্ভূত বা নোংরা ইচ্ছা ইত্যাদি। এই কামনা আল্লাহ্‌র সৃষ্ট নয়, বরং এটি শয়তানের সৃষ্ট; এখানে আল্লাহ্‌র নেয়ামতরাজি থেকে উপকৃত হওয়ার কথা বলা হয় নি বরং এখানে সেই উদগ্র বাসনার উল্লেখ করা হয়েছে যা অর্জনের জন্য মানুষ সবসময় উতলা থাকে ও এগুলো অর্জনের জন্য সিদ্ধ-নিষিদ্ধ সব উপায়ই অবলম্বন করে। এগুলো তো আমরা জগতপূজারীদের মধ্যে দেখেই থাকি; সম্পদ, জাগতিক সম্মান, নারীর লোভ ইত্যাদির জন্য এরা সব সীমা অতিক্রম করে বসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আল্লাহ্ তা’লা মুসলমানদেরকে এসব বিষয় থেকে বাঁচার জন্য এত সুন্দর ও পবিত্র শিক্ষা দেয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের অধিকাংশ এগুলোর পেছনেই পড়ে রয়েছে এবং নিজেদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে বসে রয়েছে। আলেম-উলামা, দেশের নেতৃবৃন্দ এবং যারা সুযোগ পাচ্ছে, তারাই পরকাল ভুলে গিয়ে এই জগৎ অর্জনের নেশায় মাতছে। যখন দেশের নেতৃবৃন্দের মাঝে এমন নেশা সৃষ্টি হয় তখন দেশ ও জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। আজকাল মুসলমান দেশগুলোতে যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে তার কারণও এটিই। নেতারা দেশের ও জনগণের সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ায় ব্যস্ত, উলামারাও জনগণের ধর্মের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ ও সম্পদের চিন্তাতেই বেশি ব্যস্ত, নেতারা ক্ষমতার গদিতে বসে থাকার জন্য জনগণকে আলু-পটলের মত হত্যা করতেও কুন্ঠা বোধ করে না। কতিপয় মুসলমান দেশের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও গরীবরা আরও গরীব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ সৌদি আরবকে যদিও অনেক ধনী দেশ মনে করা হয়, কিন্তু সেখানে গরীবদের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হচ্ছে; সম্পদ বাড়লে বাড়ছে রাজপুত্র, বড়লোক ও নেতাদের। এরা সম্পদ গড়ে অন্যায় ও অন্যের অধিকার খর্ব করে, আর সম্পদ ওড়ায়ও অন্যায়ভাবে। হুযুর দোয়া করেন, আল্লাহ্ এসব স্বার্থপর শাসকবর্গকে বুদ্ধি দিন যেন তারা সম্পদ কুক্ষিগত করার চেয়ে সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে। এর ফলে একদিকে যেমন তারা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করবে, অন্যদিকে জাগতিকভাবেও তারা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অমুসলিম শক্তিগুলো তাদেরকে নিজেদের হাতের পুতুল বানানোর বা তাদেরকে চোখ রাঙানোর পরিবর্তে তাদের কথা শুনবে। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেরুযালেমকে ইস্রাইলের রাজধানী হিসেবে যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটি নিয়ে অনেক হৈচৈ চলছে। কতিপয় দেশ এর বিরোধিতা করছে, কিন্তু এর পেছনে মূল কারণ হল মুসলমান দেশগুলোর দূর্বলতা। মুসলমান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে য্দ্ধু ও দেশের ভেতর চলমান অবস্থা অমুসলিম শক্তিগুলোকে এমনটি করার সাহস যুগিয়েছে। এই ঘোষণায় সৌদি আরব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু তা ফলতঃ কার্যকর হবে না। কারণ কিছুদিন পূর্বেই আমেরিকা যখন ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তখন সৌদি আরব তাদের সুরে গলা মিলিয়েছিল। যদি তখন তারা বলত, ‘আমরা সবাই মুসলমান দেশে গুলোর পাশেই আছি’, তবে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হতো না।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যারা সর্বদা পার্থিব কামনা-বাসনা নিয়ে পড়ে থাকে তাদের উপমা দিয়েছেন চুলকানিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে; তারা চুলকালে আনন্দ পায়, এমনকি চুলকাতে চুলকাতে ক্ষতও করে ফেলে এবং নিজেকে রক্তাক্ত করে ফেলে। এটিতে সাময়িক আরাম হলেও এটি কখনোই অসুখ দূর করে না। কুরআনেও আল্লাহ্ তা’লা এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাই একজন মুমিনের কাজ হল পার্থিবতায় নিজের যাবতীয় শক্তি ও চেষ্টা নিয়োগ না করে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা করা। পার্থিব জীবনের আকাঙ্খা যতই পূরণ করার চেষ্টা করুক না কেন, তা ক্রমাগত বেড়েই চলে। এটিকে দূর করার উপায় হল স্বল্পে তুষ্টি। একবার এক অশ্বারোহী ব্যক্তি পথের মাঝে বসে থাকা ছিন্নবস্ত্র এক গরীব লোককে দেখে তার অবস্থা জানতে চাইলে গরীব লোক জবাব দেয়, যার সব ইচ্ছাই পূর্ণ হয়ে গেছে তার অবস্থা আর কেমন হবে? আমার কোন ইচ্ছাই নেই, তাই আমার সব ইচ্ছাই পূরণ হয়ে গেছে। জীবন ধারনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়া অতিরিক্ত জিনিসের চাহিদা পরিত্যাগ করাই হল আসল উপায়। নতুবা চাহিদা নামক বস্তুটির কখনো কোন শেষ নেই।

মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যে ব্যক্তি খোদার হয়ে যায়, খোদাও তার হয়ে যান। কিন্তু এতে ধোঁকাবাজি করলে কোন লাভ হয় না, কেননা খোদা তা’লা হৃদয়ের কথা জানেন। পার্থিব সৌন্দর্যের ভালবাসা সকল দুষ্কর্মের মূল, এর মোহে অন্ধ মানুষ আর মানুষ থাকে না। তাই একজন মুমিনের উচিত পৃথিবীর মোহে না পড়ে নিজের পরকাল সুন্দর করার ও আল্লাহ্‌র সাথে ভালবাসা সৃষ্টির চেষ্টায় রত থাকা। পার্থিব বিষয়াবলীকে আল্লাহ্‌র নেয়ামত মনে করে সেগুলো ব্যবহার তো করবে, কিন্তু সেগুলোকে যেন নিজের খোদা বানিয়ে না বসে; সেগুলোর ব্যবহারে মাত্রা যেন রাখে। মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’লা কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘ওয়াল্লাযীনা আমানূ আশাদ্দু হুব্বান লিল্লাহ্’ অর্থাৎ মুমিনরা সবচেয়ে বেশি ভালবাসে আল্লাহ্‌কে। আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসাই মানুষের মাঝে খোদাভীতিও সৃষ্টি করে এবং তাকে স্বল্পে তুষ্টিও শেখায়। আল্লাহ্ তা’লার আত্মাভিমান একথা সহ্য করে না যে একজন মুমিন তাঁর চেয়ে অন্য কোনকিছুকে বা কাউকে ভালবাসবে। যারা আল্লাহ্‌র ভালবাসায় বিলীন হয়, আল্লাহ্ও তাদের হয়ে যান- এটিই আল্লাহ্‌কে ও আল্লাহ্‌র ভালবাসা পাওয়ার মাধ্যম। তাই নিজের মাঝে খোদাভীতি ও স্বল্পেতুষ্টি সৃষ্টি করা একজন মুমিনের জন্য একান্ত আবশ্যক। মহানবী (সা.)-ও বলেছেন, খোদাভীরু হও, তবে সবচেয়ে বড় ইবাদতকারী হতে পারবে। যদি স্বল্পেতুষ্ট হও তবেই আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পারবে। মহানবী (সা.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি তুষ্ট চিত্তে ও সুস্থ শরীরে জেগে ওঠে এবং তার কাছে একদিনের আহার মজুদ থাকে, ধরে নাও সে সারা পৃথিবী ও সকল নেয়ামত পেয়ে গেছে। এটি হল একজন মুমিনের জন্য স্বল্পে তুষ্টির মান। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের মাঝে স্বল্পে তুষ্টি সৃষ্টি করুন, খোদাভীতি সৃষ্টি করুন, পার্থিব সামগ্রীর পরিবর্তে আল্লাহ্‌র ভালবাসা অর্জন আমাদের লক্ষ্য হোক আর আমরা যেন আল্লাহ্‌র ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আমীন।

হুযুর (আই.) এ বিষয়ের জন্যও দোয়া করার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন যে, মুসলমান দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ যারা পার্থিব কামনা-বাসনার অনুসরণ করছে ও কার্যত আল্লাহ্‌র পরিবর্তে জাগতিক শক্তিগুলোকে নিজেদের খোদা ভেবে বসে আছে, আল্লাহ্ যেন তাদেরকে বুদ্ধি দান করেন ও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়, নিজেদের আভ্যন্তরীন যুদ্ধ শেষ করে যেন ইসলামের শত্রুরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে না পারে; আর সবচেয়ে বেশি যে দোয়া করা দরকার তা হল মুসলমানরা যেন আল্লাহ্‌র প্রেরিত প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদীকে চিনতে পারে, যার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তারা নিজেদের মাঝেও ও পৃথিবীতেও শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমীন।