তাহরীকে জাদীদের ৮৪তম বছরের সূচনা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-নভেম্বর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৩রা নভেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “তাহরীকে জাদীদের ৮৪তম বছরের সূচনা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর, সূরা আলে ইমরানের ৯৩নং আয়াত তিলাওয়াত করেন যার অর্থ হল: “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত পুণ্য অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা কিছু ভালবাস তা থেকে আল্লাহ্‌র পথে খরচ করবে। আর তোমরা যা-ই খরচ কর আল্লাহ্ সেই বিষয়ে নিশ্চয় সম্পূর্ণরূপে অবগত।”

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা সেই বিষয় বর্ণনা করেছেন যা সর্বদা আল্লাহ্‌র পথে কুরবানীকারী মুমিনগণই ভালভাবে বুঝেছেন। এটিকে সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন তো করেছেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবাগণ, যারা নিজেদের প্রাণ, সম্পদ, সময় ধর্মের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাঁরা ‘আলবির’ তথা পুণ্যের সেই প্রকৃত রূপকে চিনেছিলেন এবং পুণ্যের সেই পরম উৎকর্ষ ও মান অর্জনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। কেবল পুণ্যই নয়, তাকওয়া ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তাদের এই চেষ্টা ছিল। আর আল্লাহ্‌র কৃপায় এই যুগে সর্বপ্রকার কুরবানীর জ্ঞান মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রেমিক মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মান্যকারীদেরই রয়েছে, আর এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আহমদীরাই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। পৃথিবী যেখানে অর্থ-সম্পদ কামানোর দৌড়ে ছুটছে, সেখানে আহমদীদের অধিকাংশের অবস্থা হল যে তারা সম্পদ বানায়, আর যখনই আর্থিক কুরবানীর দিকে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় তখনই তারা তা দান করে দেয়। এটি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ক্রমাগত প্রশিক্ষণেরই ফলাফল। তিনি (আ.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে আর্থিক কুরবানীর বিষয়টি আমাদেরকে বুঝিয়েছেন এবং তা করার জন্য উপদেশ দান করেছেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৩নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়েও তিনি বলেছেন, এই বিষয়টি এজন্য আবশ্যক কারণ আল্লাহ্‌র সৃষ্ট জীবের সেবা তথা হক্কুল ইবাদের দায়িত্ব পালনের জন্য সম্পদ প্রয়োজন। আর সৃষ্টির সেবা বা তাদের প্রতি সহমর্মিতা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমানের অত্যাবশ্যক অঙ্গ, এটি না থাকলে ঈমান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ কারণেই হযরত আবু বকর (রা.) নিজের ঘরের সবকিছু আল্লাহ্‌র পথে খরচের জন্য নিয়ে এসেছিলেন, অনুরূপভাবে হযরত উমর (রা.) ও অন্যান্য সাহাবারাও নিজেদের সম্পদ খরচ করতেন। সাহাবাদের (রা.) এই স্পৃহা ও আদর্শই মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর জামাতের সদস্যদের মাঝে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন- যে আল্লাহ্‌র পথে খরচ করবে, আল্লাহ্ তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তা ফেরত দিবেন। হাদীসেও এটি বর্ণিত হয়েছে যে পবিত্র উপার্জন থেকে কেউ যদি একটি খেজুরও আল্লাহ্‌র পথে খরচ করে, তবে আল্লাহ্ তা ডান হাতে গ্রহণ করেন এবং তা বৃদ্ধি করতে করতে পাহাড়সম করে দেন। হুযুর (আই.) বিশেষভাবে স্মরণ করান যে, আল্লাহ্‌র পথে খরচ করতে হয় পবিত্র উপার্জন থেকে, অবৈধ উপার্জন হতে দান আদৌ গৃহীত হয় না। হুযুর (আই.) বলেন, আহমদীরা যে আল্লাহ্‌র পথে খরচ করে, তার প্রতিদানও তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর বর্ণনানুসারে লাভ করে থাকে। সুতরাং এগুলো কোন ফাঁকা বুলি বা কল্পকাহিনী নয়, বরং আজকের এই যুগেও এর সত্যতার প্রমাণ আহমদীরা দেখে আসছে। হুযুর (আই.) এরকম কিছু ঘটনাও উল্লেখ করেন। যেমন: ক্যামেরুনের এক আহমদী যিনি গত বছর বেকার ও আর্থিকভাবে খুব দৈন্যের মধ্যে ছিলেন, তিনি জুমুআর পরে তাহরীকে জাদীদের চাঁদার ঘোষণা শুনে সঙ্গে থাকা ১০হাজার ফ্রাংক চাঁদা দিয়ে দেন। পরের জুমুআতে এসেই তিনি জানান যে আল্লাহ্ তার চাঁদা কবুল করেছেন, কারণ চাঁদা দিয়ে ফেরত যাবার পরই তার খুব ভাল একটি চাকরি হয়েছে যার বেতন প্রতি মাসে তার দেয়া চাঁদার দশগুণ। এমনিভাবে কঙ্গোর একজন নতুন বয়আতকারী যুবকেরও আর্থিক অবস্থা করুণ ছিল, তাকে প্রথমে জুমুআয় নিয়মিত করা হয় এবং এরপর আর্থিক কুরবানীর কথা বলা হয় যে এটি আর্থিক সচ্ছলতা লাভের মাধ্যম। সেই যুবক সেদিনই একশ ফ্রাংক চাঁদা দিয়ে বাড়ি ফেরেন, আর বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই তার এক প্রতিবেশি, যিনি তাদের উঠানে বেশ কিছুদিন যাবৎ কাঠ রেখেছিলেন, সেই কাঠ রাখার জন্য ৪হাজার ফ্রাংক উপহার দেন। যুবক খুশি হন যে চাঁদা দেয়ার সাথে সাথেই তা ৪০গুণ বেশি করে আল্লাহ্ ফেরত দিয়েছেন। এমন আরও বেশ কিছু ঘটনা হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্‌র ফযলে এরকম ঘটনাবলী নতুন ও পুরনো- সব আহমদীই দেখে থাকেন, আর তাদের মাঝে আর্থিক কুরবানীর স্পৃহাও অবশ্যই রয়েছে। আহমদীরা যেহেতু জানেন- এই যুগ ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্রে পূর্ণতার যুগ, আর জামাত কুরআন-হাদীস ও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বইপুস্তকসহ অন্যান্য পুস্তকাদি প্রকাশের মাধ্যমে, মসজিদ-মিশন হাউজ নির্মানের মাধ্যমে, জামেয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইত্যাদি নানা প্রকারে এই প্রচারের কাজ করে চলেছে, তাই তারা চাঁদা প্রদানের ক্ষেত্রে কখনো কুন্ঠাবোধ করেন না। যদি কোন কমতি থেকেই থাকে, তবে তা ব্যবস্থাপনার কারণেই হয়ে থাকে- তারা যথাযথভাবে সদস্যদের স্মরণ করান না বা উদ্বুদ্ধ করেন না। অথচ স্মরণ করানো ও উদ্বুদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব, আর এর ফলে ছোট শিশুরাও এদিকে মনোযোগী হয়ে যান, যার দু’টি উদাহরণও হুযুর (আই.) উপস্থাপন করেন ও দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন যেন কেয়ামত পর্যন্ত জামাতে এমন শিশু ও সাবালক সৃষ্টি হতে থাকে যাদের মাঝে আল্লাহ্‌র খাতিরে কুরবানী করার উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে এবং তারা তাদের অঙ্গীকার পূর্ণকারী হবে। (আমীন)

অতঃপর হুযুর (আই.) তাহরীকে জাদীদের ৮৪তম বছর সূচনার ঘোষণা দেন এবং ৮৩তম বছরের বেশ কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এ বছর তাহরীকে জাদীদ খাতে ১কোটি ২৫লক্ষ ৮০হাজার পাউন্ড চাঁদা আদায় হয়েছে, যা পূর্বের বছরের তুলনায় ১৫লক্ষ ৪৩হাজার পাউন্ড বেশি। চাঁদা আদায়ের দিক থেকে পাকিস্তান বরাবরের মত শীর্ষে রয়েছে, এরপর প্রথম স্থানে রয়েছে জার্মানি, দ্বিতীয় যুক্তরাজ্য, তৃতীয় আমেরিকা, ৪র্থ কানাডা, ৫ম ভারত, ৬ষ্ঠ অস্ট্রেলিয়া, ৭ম ইন্দোনেশিয়া, ৮ম ও ৯ম স্থানে মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি জামাত, ১০ম স্থানে রয়েছে ঘানা। হুযুর জার্মানির বিশেষ প্রশংসা করেন, তারা অন্যান্য অনেক আর্থিক কুরবানী সত্ত্বেও এই খাতে চাঁদা আদায়ে এই অর্জন লাভ করেছে; অথচ তাদের মধ্যে সেরকম ধনী ব্যক্তিও তেমন একটা নেই। হুযুর (আই.) পাকিস্তানেরও বিভিন্ন জামাতের ক্রমধারা ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন, একই সাথে আরও বিভিন্ন পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন এবং দোয়া করেন, আল্লাহ্ যেন তাদের সকলের সম্পদ ও জনবলে বরকত দেন। (আমীন)

হুযুর (আই.) এরপর আরও একটি বিষয়ে চাঁদার তাহরীক করেন। সেটি হল প্রায় দু’বছর পূর্বে বায়তুল ফুতুহ্‌’র একটি ভবন পুড়ে গিয়েছিল, সেটির স্থলে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই নির্মাণকাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ১১ মিলিয়ন পাউন্ড। হুযুর (আই.) যুক্তরাজ্যের সদস্যদেরকে সাধারণভাবে এবং বাকি আহমদীদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদেরকে এই কাজের জন্য চাঁদার ওয়াদা করতে বলেন। হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন, যেহেতু যুক্তরাজ্য জামাত নিয়মিতভাবে যুগ-খলীফার কাছে আগতদের ক্রমাগতভাবে আতিথেয়তার দায়িত্ব পালন করে আসছে, তদুপরি নির্মিতব্য ভবন অতিথিদের জন্যও ব্যবহৃত হবে, তাই বিশ্বব্যাপি সঙ্গতিশীল জামাত ও অঙ্গ-সংগঠনগুলোর এই তাহরীকে অংশ নেয়া উচিত। তিন বছর সময়সীমার জন্য ওয়াদা করা যাবে, তবে ওয়াদার এক-তৃতীয়াংশ শীঘ্র আদায় করে দিতে হবে। মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রায়শঃ বাদশাহ আলমগীরের একটি ঘটনা শোনাতেন, তার শাসনামলে একবার শাহী মসজিদে আগুন লেগে যায়। সবাই যখন ব্যস্ত হয়ে তাকে এই খবর শোনাল, তখন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞতা আদায় করেন। সবাই এতে আশ্চর্য হয় যে এই দুঃসংবাদ শুনে কৃতজ্ঞতা কেন, তখন তিনি বলেন যে তার খুব শখ ছিল এই বিশাল মসজিদ যা অগুণিত মানুষের কল্যাণের কারণ হচ্ছে, তাতে তারও কিছু করার। এতদিন সেই সুযোগ ছিল না, আজ সে সুযোগ হাতে এসেছে। হুযুর (আই.) বলেন, তাই আহমদীদেরও জন্যও আজ এটি সুবর্ণ সুযোগ।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) ইয়েমেনের বাসিন্দা মোকাররম আদিল মাহমুদ নাখুযা সাহেবের গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন, যিনি গত ১৪ অক্টোবর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাত্র ৪০বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হুযুর (আই.) মরহুমের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের ও তার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেন।