মহানবী (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২০-অক্টোবর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২০শে অক্টোবর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “মহানবী (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, গত শুক্রবার আমি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতি পড়েছিলাম যার মাঝে তিনি (আ.) মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন যে যদি তাদের অবস্থা এরূপ না হতো ও তারা ইসলাম থেকে একেবারে দূরে সরে গিয়ে না থাকতো, তবে তাঁর (আ.) আসার কী-ই বা দরকার ছিল? এদের ঈমানের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছে এবং তারা ইসলামের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একেবারেই অনবগত। এরা ভাবে যে তাদের মাঝে তো ইসলাম ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত আছে, তারা কলেমা, নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদি সবই পালন করে; কিন্তু আসলে তারা এগুলো সৎকর্মের শর্তানুসারে পালন করে না, কারণ সৎকর্মের ফলে পবিত্র পরিণতি সৃষ্টি হয়, যা তাদের কাজে হচ্ছে না। হুযুর (আই.) বলেন, আজও আমরা তা-ই দেখছি; আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খল অবস্থা মুসলমান দেশগুলোরই, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের গলা কাটছে, তার অধিকার হরণ করছে, তার ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করছে। এটিই কি কুরআনের শিক্ষা, এটিই কি মহানবী (সা.)-এর আদর্শ? এখন তো আমরা সর্বত্রই জগতপূজার প্রাধান্য দেখি। ধর্মের কথা যদি বলেও তবে তা রাজনৈতিক স্বার্থে বা তাদের নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য বলে।

হুযুর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর আদর্শ সম্পর্কে হযরত আয়েশার মন্তব্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে যে ‘কানা খুলুকুহুল কুরআন’ অর্থাৎ ‘তাঁর জীবনী ও আদর্শ সম্পর্কে যদি জানতে চাও তবে কুরআন পড়, কুরআনই হল তাঁর জীবনী ও আদর্শ’। তিনি (সা.) এই আদর্শ এজন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেন মুমিনগণ তা অনুসরণ করে; আর আল্লাহ্ তা’লাও কুরআন শরীফে এটিই বলেছেন যে আমার সাথে প্রকৃত সম্পর্ক কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বললেই হয়ে যাবে না, বরং আমার ভালবাসা অর্জন করতে হবে, আর এর জন্য আমার প্রিয় রসূলের (সা.) অনুসরণ কর-তার আদর্শ আত্মস্থ কর- তবে গিয়ে তোমরা আমার প্রিয় হতে পারবে। আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিঊনি ইয়ুহ্বিবকুমুল্লাহু ওয়া ইয়াগফির লাকুম যুনূবাকুম-ওয়াল্লাহু গাফুরুর রাহীম’ অর্থাৎ “তুমি বল, ‘তোমরা যদি আল্লাহ্‌কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসবেন, আর তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন, আর আল্লাহ্ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়” (সূরা আলে ইমরান:৩২)। হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ যাদের ভালবাসেন তাদের অবস্থা কি এমনটিই হয়, যেমনটি আজকালকার মুসলমানদের হয়েছে? নামসর্বস্ব আলেমদের কারণে উম্মতের আজ করুণ অবস্থা, তাদের কারণেই সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাদের এই অবস্থাই দাবী করে যে কুরআন ও সুন্নতের বাস্তব রূপ শেখানোর জন্য যেন কেউ আসে। আল্লাহ্ তা’লা তো যথাসময়ে সেই ব্যক্তিকে প্রেরণ করে দিয়েছেন, কিন্তু আলেমরা নিজেও তার কথা শুনে না, আর মানুষকেও তা শুনতে দেয় না; উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে কুফরি ফতোয়া জারি করে সার্বিকভাবে উম্মতের মাঝে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর উপর অহরহ এই অপবাদ আরোপ করা হয় যে, তিনি পার্থিব লোভ-লালসা ও ব্যক্তিগত সম্মান লাভের জন্য এই জামাত প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাহোক, আমরা তো জানি যে তিনি (আ.) মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রেমিক, আর মহানবী (সা.)-এর শরীয়তকে পূর্ণতা দেয়ার জন্যই আল্লাহ্ তাঁকে (আ.) পাঠিয়েছেন, কুরআনে জ্ঞান ও তত্ত্বকথা আমরা তাঁর মাধ্যমেই উপলদ্ধি করতে পেরেছি। তিনি (আ.) সর্বক্ষেত্রে কুরআনের শিক্ষানুসারে আমাদের পথনির্দেশনা দিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াত অর্থাৎ সূরা আলে ইমরানের ৩২নং আয়াতেরও তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, আর এগুলোই সেই বিষয় যা আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য দান করে, তাঁর প্রিয় বানিয়ে বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচাতে পারে। অতঃপর হুযুর (আই.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মসীহ্ মওউদ (আ.) বিভিন্ন স্থানে যেসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, তার মধ্য থেকে কতিপয় উদ্ধৃতি তুলে ধরেন।

এক স্থানে তিনি (আ.) বলেন যে, মুসলমানদের আভ্যন্তরীন ঝগড়া-বিশৃঙ্খলার মূল কারণ তাদের জগতপ্রেম। যদি তারা মহানবী (সা.)-কে মানত ও অনুসরণ করত, তাহলে তো তারা ধর্মকে জগতের উপর প্রাধান্য দিত। কিন্তু মুসলমানদের আজ যে অবস্থা, তা দেখেই বোঝা যায় যে, তারা আল্লাহ্ থেকে কত দূরে। ইরান মুসলমান দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা যখন ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে, তখন সৌদি আরব তাদেরকে সমর্থন দেয়। মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রকৃত পুণ্যলাভের উপায় কী তা তুলে ধরতে গিয়েও আলোচ্য আয়াতটির উল্লেখ করেন যে প্রকৃত পুণ্য লাভ করার জন্য মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ ও আনুগত্য আবশ্যক। এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি (আ.) এটিও লিখেছেন যে মহানবী (সা.)-এর ভালবাসা পাপ ক্ষমার কারণ হয়ে থাকে, যদি কেউ মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ না করে তবে আল্লাহ্‌র ক্ষমা লাভ করতে পারবে না। প্রকৃত ইবাদতও আমরা তাঁর (সা.) কাছ থেকেই শিখেছি; ইসলাম মানেই সবকিছু আল্লাহ্‌র পথে উৎসর্গ করে দেয়া এবং নিজেকে কুরবানীর পশুর মত আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থাপন করা- এটিও শিখেছি। যাবতীয় উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলী তাঁর (সা.) কাছ থেকেই শিখেছি। প্রকৃত একত্ববাদী ও একত্ববাদ প্রতিষ্ঠকারী তিনিই ছিলেন। মসীহ্ মওউদ (আ.) আরও বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষেই আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব না, এজন্য মাধ্যম দরকার হয়। মহানবী (সা.) হলেন সেই মাধ্যম, তাঁকে অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব। আল্লাহ্‌কে খুশি করার জন্য, পাপে পূর্ণ জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, আল্লাহ্‌র প্রিয়ভাজন হবার জন্য- এই সবকিছুর জন্যই মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ ও আনুগত্য প্রয়োজন। হুযুর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.) কিভাবে খ্রীষ্টানদের সামনে মহানবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন তার উদাহরণ তুলে ধরেন, আর এটিও উল্লেখ করেন যে কিভাবে অ-আহমদীরাও তাঁর এই কাজের স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি দিয়েছে। মসীহ্ মওউদ (আ.) কিভাবে মহানবী (সা.)-এর জীবিত থাকা ও ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু প্রমাণ করে দিয়েছেন তা-ও হুযুর (আই.) তুলে ধরেন। মোটকথা তিনি (আ.) মহানবী (সা.)-এর পরিপূর্ণ প্রেমিক ও অনুসরণকারী ছিলেন, এজন্যই আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী ও আনুগত্যকারী নবীর পুরস্কার দান করেছেন।

খুতবার শেষদিকে এসে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের পর এই বয়আতের মর্যাদা রাখার তৌফিক দান করুন, আমাদেরকেও মহানবী (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্যকারী বানান, আমাদের প্রত্যেককে তার সাধ্য ও অবস্থানুসারে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন, আর মুসলমানদেরকেও তৌফিক দিন যেন তারা মহানবী (সা.)-এর এই প্রকৃত প্রেমিককে চিনতে ও মানতে পারে। আমীন।