খাতামান্নাবীঈন-এর প্রকৃত তাৎপর্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৩-অক্টোবর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৩ই অক্টোবর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “খাতামান্নাবীঈন-এর প্রকৃত তাৎপর্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর, আয়াতে খতমে নবুওয়ত বা সূরা আহযাবের ৪১নং আয়াত পাঠ করেন, যার অনুবাদ হল: “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মাঝে কারো পিতা নয়, কিন্তু সে আল্লাহ্‌র রসূল ও খানবীগণের মোহর, আর আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ে পুরোপুরি অবগত।”

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিবিদ ও উলামারা আহমদীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসছে। তাদের ধারণায় এটি হল জাতিকে নিজের পক্ষে টানার, নিজের পিছনে চালানোর ও বিখ্যাত হবার সবচেয়ে সহজ উপায়। আর মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ-উত্তেজনাকে উস্কানোর সবচেয়ে উপযুক্ত অস্ত্র হল ‘খতমে নবুওয়ত’। যখনই কোন রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে বা বিরোধী দলকে ঘায়েল করার প্রয়োজন হয় তখনই তারা এই ধুয়া তোলে যে ‘দেখ, ওরা বাইরের শক্তির কথামত আহমদীদেরকে মূলধারার মুসলমানদের সাথে এক করতে চায় বা করছে!’। এদের মতে আহমদীরা খতমে নবুওয়তের অস্বীকারকারী। তারা বলে, ‘আমরা কক্ষনো রসূলের সম্মানে কোন আঁচ লাগতে দেব না, আর এমন অন্যায় হতে দেব না! কত্তবড় অন্যায় যে আহমদীরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে!’ আর এর জবাবে বিরোধী দল সংসদে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘প্রশ্নই আসে না! আমরা তো চাই আহমদীদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক গণ্য করে যেসব অধিকার দেয়া হচ্ছে, তা-ও কেড়ে নেয়া হোক’। উদ্দেশ্য হয়ে থাকে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন বা ব্যক্তিগত লাভ, অথচ কোন কারণ ছাড়াই আহমদীদেরকে এর মাঝে টেনে আনা হয়; কারণ এটি হল সবচেয়ে সহজ উপায়। যে আহমদীদের নিয়ে এসব কথা, সেই আমরা না কখনো কোন বিদেশী শক্তিকে এই অনুরোধ করেছি যেন পাকিস্তানে আমাদেরকে মুসলমান ঘোষণা করা হয়, আর না আমরা মুসলমান হবার জন্য সেখানকার এসেম্বলীর বা রাষ্ট্রের স্বীকৃতির কোন পরওয়া করি। আমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলি, কারণ আমরা জানি যে আমরা মুসলমান; আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ (সা.) আমাদের মুসলমান বলেছেন, আমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ কলেমা পড়ি, যাবতীয় ইসলামী নিয়ম-কানুন মানি, আমরা কুরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখি, আমরা মহানবী (সা.)-কে খাতামান্নাবীঈন বলে মান্য করি। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) অসংখ্য স্থানে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে লিখে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি খতমে নবুওয়তের অস্বীকারকারী সে আহমদী হওয়া তো দূরের কথা, ইসলামের গন্ডিরই বাইরে। অতএব, আমাদের বিরুদ্ধে এই যে অপবাদ আরোপ করা হয় যে আমরা মুসলমান না এবং আমরা খতমে নবুওয়তের অস্বীকারকারী- এটি অত্যন্ত জঘন্য ও মিথ্যা অপবাদ, যা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে আরোপ করা হচ্ছে।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.) এ বিষয়টি সম্পর্কে একবার বলেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে খতমে নবুওয়ত না মানার যে অপবাদ দেয়া হয়, তার জবাবে আমরা যখন বলি যে এটি কিভাবে সত্য হতে পারে, আমরা তো কুরআন পড়ি ও মানি, যাতে স্পষ্টভাবে মহানবী (সা.)-কে খাতামান্নাবীঈন আখ্যা দেয়া হয়েছে- তখন এর জবাবে তারা বলে যে আহমদীরা কুরআন মানে না, বরং মির্যা সাহেবের ইলহামসমূহকে কুরআনের চেয়ে বড় মনে করে ও সেগুলো মানে। এমনিভাবে আরও অনেক মিথ্যা আমাদের প্রতি আরোপ করে, যেগুলো যাচাই করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ মোল্লাদের মিথ্যাবাদীতা বুঝতে পারে ও আহমদীয়াতের সত্যতা অনুধাবন করে তা গ্রহণ করে। সুতরাং একদিক থেকে মোল্লারা এসব মিথ্যাচারের মাধ্যমে আহমদীয়াতেরই তবলীগ করে যাচ্ছে।

এটি কিভাবে সম্ভব যে আমরা মহানবী (সা.)-কে খাতামান্নাবীঈন মানব না বা কুরআন মানব না, যেখানে কিনা স্বয়ং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ইলহামে কুরআনকে আল্লাহ্‌র কালাম ও শ্রেষ্ঠ বাণী এবং সকল কল্যাণের উৎস বলা হয়েছে, এবং মহানবী (সা.)-কে খাতামান্নাবীঈন বলা হয়েছে। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ইলহাম রয়েছে যে ‘আলখাইরু কুল্লুহু ফিল কুরআন’ অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণ কুরআনের মাঝে রয়েছে; তিনি (আ.) এ-ও লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনকে সম্মান করবে সে আকাশে সম্মান লাভ করবে’। একইভাবে মহানবী (সা.)-এর খাতামান্নাবীঈন হওয়ার ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে ইলহাম হয়েছে। আর তিনি (আ.) তাজাল্লিয়াতে ইলাহিয়া পুস্তকে একথাও লিখেছেন যে ‘যদি আমি মহানবী (সা.)-এর উম্মত না হতাম ও তাঁর অনুসরণ না করতাম, তবে পৃথিবীর সমস্ত পাহাড়ের সমান পুণ্য করলেও আমি ঐশী বাক্যালাপের এই মর্যাদা পেতাম না’।

মোটকথা মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজেও মহানবী (সা.)-এর অনুসারী, আর তাঁর ইলহামসমূহও কুরআনের অনুসারী। যদি আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ইলহামকেই বেশি গুরুত্ব দিতাম, তাহলে নিজেরা আর্থিক কুরবানী করে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ না করে সেসব ইলহামকেই প্রকাশ করতাম। এখন পর্যন্ত ৭৫টি ভাষায় কুরআনের সম্পূর্ণ ও ১১১টি ভাষায় আংশিক অনুবাদ আমরা প্রকাশ করেছি, ঐসব বড় বড় ধনী মুসলিম রাষ্ট্র বা সংগঠনগুলো বলুক যে তারা কয়টি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ ও প্রচার করেছে! মহানবী (সা.)-কে প্রকৃত অর্থে খাতামান্নাবীঈন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা এবং পৃথিবীজুড়ে এই বিষয়টিকে বিভিন্ন ভাষায় প্রচার ও প্রতিষ্ঠা আমরাই করছি, তারা নয়; তারপরও আমাদেরকেই তারা কাফের বলে এবং খতমে নবুওয়তের অস্বীকারকারী বলে অপবাদ দেয়। হুযুর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন উদ্ধৃতি তুলে ধরেন, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সাব্যস্ত করে যে তিনি (আ.) মহানবী (সা.)-কে কত সূক্ষ্ম ও গভীর অর্থে খাতামান্নাবীঈন বলে মানতেন এবং তা মানার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর (আ.) লেখনী থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তিনি কত গভীর আবেগ, ভালবাসা ও আনুগত্য মহানবী (সা.)-এর প্রতি রাখতেন এবং কোন উচ্চ মর্যাদায় তাঁকে (সা.) স্মরণ করতেন। নিজেকে তিনি মহানবী (সা.)-এর তুলনায় কত তুচ্ছ ও তাঁর (সা.) চাকর বলে মনে করতেন, এবং নিজের যাবতীয় উৎকর্ষকে কেবল মহানবী (সা.)-এর কল্যাণে প্রাপ্ত উপহার বলে জ্ঞান করতেন- এ সবকিছুই তাঁর (আ.) লেখনীর আলোকে হুযুর (আই.) তুলে ধরেন। অতঃপর হুযুর (আই.) বলেন, এই সব কিছুর পরও আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা আমাদেরকে কাফের আখ্যা দেয়, অথচ তারা ভুলে যায় যে মহানবী (সা.)-এর হাদীস অনুসারে মুসলমানকে কাফের আখ্যাদানকারী নিজেই কাফের সাব্যস্ত হয়। তাই এসকল কলেমা পাঠকারী মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতার সাথে আমরা এই আহ্বানই জানাবো যে ‘নিজেদের প্রতি দয়া কর, আর দেখ ও বুঝার চেষ্টা কর যে খোদা তা’লা কী চান ও কী বলেন’। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এই কয়েকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করলাম; হায়, এগুলো যদি ভদ্র প্রকৃতির মুসলমানদের হেদায়েতের কারণ হতো আর তারা আমাদের উপর অপবাদ দেয়ার বদলে নিজেদের অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিত!

এরপর হুযুর (আই.) সম্প্রতি পাকিস্তানের সংসদে একজন সংসদ সদস্যের দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক ও বিনা কারণে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও উস্কানিমূলক বক্তৃতার জবাব প্রদান করেন। হুযুর (আই.) বলেন, তার এই বক্তব্য শুধু সংসদ সদস্যদেরকেই উস্কানোর জন্যে নয়, বরং দেশজুড়ে একটি উত্তেজনা সৃষ্টির এবং আহমদীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনে জনগণকে উস্কানি দেয়ার উদ্দেশ্যে ছিল, একইসাথে নিজেকে জাতির অত্যন্ত বিশ্বস্ত নেতা সাব্যস্ত করার এবং তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করার জন্য ছিল। হুযুর (আই.) তার প্রতিটি আপত্তির অকাট্য ও দাঁতভাঙা জবাব প্রদান করেন। শেষদিকে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, প্রত্যেক পাকিস্তানি আহমদীর আবশ্যক কর্তব্য হল তারা যেন দোয়া করে যে আল্লাহ্ তা’লা এই দেশকে, যার জন্য আহমদীরা অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ত্যাগ স্বীকার করছে, তিনি যেন সেই দেশকে নিরাপদে রাখেন, আর অত্যাচারী নেতৃবৃন্দ ও স্বার্থলোভী মোল্লাদের হাত থেকে একে রক্ষা করেন, এবং পাকিস্তান যেন পৃথিবীর স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে গণ্য হয়। আমীন।