আহমদীয়াত গ্রহণের বা গ্রহণ করার পরের আধ্যাত্মিক ঈমানোদ্দীপক ঘটনাবলী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৬-অক্টোবর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৬ই অক্টোবর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “আহমদীয়াত গ্রহণের বা গ্রহণ করার পরের আধ্যাত্মিক ঈমানোদ্দীপক ঘটনাবলী”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আমি বিভিন্ন সময়ে এমন সব ঈমানোদ্দীপক ঘটনাবলী বর্ণনা করে থাকি যাতে বিভিন্ন লোকের আহমদীয়াত গ্রহণের বা গ্রহণ করার পরের আধ্যাত্মিক ও আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতার বর্ণনা কিংবা জামাতের উপর আল্লাহ্‌র কৃপার ও এর পরিণামে জামাতের সদস্যদের ঈমানে উন্নতি ও দৃঢ়তার বর্ণনা থাকে। অনেকেই আমার কাছে লিখেন যে এমন ঘটনাবলী শুনার ফলে আমাদের শিশু ও তরুণদের ঈমানে উন্নতি সাধিত হয়, আমাদেরকেও তা নিজেদের কর্ম ও দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী করার মাধ্যমে উপকারী সাব্যস্ত হয়, তাই অনুগ্রহপূর্বক এমন ঘটনাবলী খুতবায় উল্লেখ করতে থাকুন। জন্মগত আহমদীরাও লিখেন যে এসব ঘটনাবলী শুনে মাঝে মাঝে লজ্জিত হই যে নবাগতরা ঈমান-আমলে কত দ্রুত উন্নতি করছে আর আমাদের কী করা উচিত, অন্যদিকে নবদীক্ষিতরাও লিখেন যে এসব শুনে তাদেরও ঈমান বৃদ্ধি পায়। অথচ কিছু আহমদী এমনও আছে যারা এসব ঘটনা শুনে আপত্তির সুরে বলে যে ‘এসব বয়আত ও ঈমানে উন্নতির ঘটনা কেবল আফ্রিকা বা এশিয়াতেই কেন ঘটে? কেন ইউরোপ বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এমন ঘটে না; কেউ স্বপ্নে বা জামাতের বই পড়ে বা কোন নিদর্শন দেখে পথনির্দেশনা পায় না?’ হুযুর (আই.) বলেন, এসব লোক নিজেদের খুব শিক্ষিত ও উন্নত ভাবে; পাকিস্তান থেকে এসব দেশে আসে আর পরে পার্থিবতায় এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে ধর্ম-কর্ম বা আল্লাহ্‌র স্মরণ ইত্যাদির কোন তোয়াক্কাই করে না। তারা জামাতের সাথে খুব একটা সম্পৃক্তও হয় না, আর আহমদী হিসেবে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে থাকে। এদের আপত্তির জবাবে হুযুর (আই.) বলেন, প্রথম কথা হল ইউরোপে বসবাসকারী যারা ধর্মের প্রতি মনোযোগী তাদেরকেও আল্লাহ্ নিদর্শন দেখান, তাদের ঈমানে উন্নতির উপকরণ সৃষ্টি করেন। যুক্তরাজ্যেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, নবদীক্ষিত বা কিছুদিনের পুরনো আহমদী নর-নারী উভয়ই রয়েছেন; এমটিএ-তেও অনেকে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। মোটকথা পাশ্চাত্যেও যারা ধর্মের প্রতি মনোযোগী, তাদেরকে আল্লাহ্ নিদর্শন দেখান ও আহমদীয়াতের সত্যতা তাদের কাছে প্রকাশ করে দেন। আবার একটি শ্রেণী এমনও আছে যারা আহমদীয়াত তো গ্রহণ করে না, কিন্তু আহমদীয়াতের কল্যাণে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তারা স্বীকার করে। কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি স্মরণ রাখা দরকার তা হল, আল্লাহ্ তা’লা তাকেই পথপ্রদর্শন করেন যে তা লাভের জন্য আল্লাহ্‌র প্রতি ঝুঁকে। যদি কেউ পার্থিবতায়ই মগ্ন থাকে আর ধর্ম ও খোদা তা’লার সাথে কোন সম্বন্ধই না রাখে, তবে আল্লাহ্ও এমন ব্যক্তির কোন পরোয়া করেন না এবং সে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আবার নবীগণের ইতিহাসও এ কথার সাক্ষী যে ধর্মের প্রতি মনোযোগী ও তা গ্রহণকারী সাধারণত দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষই হয়ে থাকে। বিনয়ী ও মিসকিনদের মাঝেই আল্লাহ্‌র দিকে যাওয়ার উদ্বেলতা ও খোদাভীতি দেখা যায়। আর দুনিয়াদার লোকেরাও এই আপত্তিই করে যে নবীর মান্যকারীরা আমাদের দৃষ্টিতে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট লোক। দুনিয়াদাররা তো প্রচন্ড অহংকারী হয়ে থাকে; তাদের অহংকার, পার্থিবতায় নিমগ্নতার কারণে ধর্মের কথা ভাবার তাদের সময়ই হয় না। আর পাশ্চাত্যের অধিকাংশ লোকই আজকাল নাস্তিকে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তাদের আল্লাহ্‌র কোন পরোয়া নেই, তাই আল্লাহ্ও তাদের কোন পরোয়া করেন না ও তাদেরকে পথপ্রদর্শন করেন না। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) দুনিয়াদার কাফেরদের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে কুরআনে বর্ণিত উদাহরণ তুলে ধরেন যে এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতই আহার-নিদ্রা-কামে নিমগ্ন। তিনি (আ.) বলেন, যদি কোন কৃষকের হালের গরু কেবল খাওয়ার বেলায় থাকে আর হাল টানার বেলায় বসে পড়ে, তবে এমন গরুকে কৃষক সোজা কসাইয়ের কাছে নিয়ে বেচে দেয়। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহ্‌ নির্দেশের কোন তোয়াক্কা করে না ও পাপাচারে নিমগ্ন থাকে, আল্লাহ্ও তাদের কোন পরোয়া করেন না। অন্যদিকে আল্লাহ্‌ এই ঘোষণাও রয়েছে যে যারা আল্লাহ্কে পাবার জন্য চেষ্টা করে, তাদেরকে তিনি তাঁর কাছে পৌঁছাবার পথ দেখান, তাদের পুণ্যের কারণে তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন ও নিদর্শন দেখান। হুযুর (আই.) বলেন, আমি যেসব ঘটনাবলী শুনাই তা এমন লোকদেরই হয়ে থাকে।

হুযুর (আই.) এরপর ঈমান ও নিষ্ঠায় উন্নতি করার এরূপ কতক ঘটনা খুতবায় তুলে ধরেন। এর মধ্যে বুর্কিনাফাসোর এক বৃদ্ধা রয়েছেন যিনি বয়আত গ্রহণের পর আহমদী মোয়াল্লেম সাহেবের আহ্বানে প্রতি শুক্রবার পাশের গ্রামে আহমদী মসজিদে জুমুআর নামাযে যেতেন। বর্ষার সময় জায়নামায নিয়ে জুমুআর জন্য রওয়ানা হতেন, পথিমধ্যে পানিভরা খাল থাকায় তিনি সেখানে থেমে গিয়ে ঐস্থানেই নামায পড়তেন ও দোয়া করতেন যে এই নামায যেন আহমদী জামাতের সাথে হয়। পরবর্তীতে মোয়াল্লেম সাহেব ঐ ঘটনা শুনে বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনদের যখন এটি বর্ণনা করেন, তা শুনে তাদেরও চোখ খুলে যায় এবং আরও ত্রিশ ব্যক্তি বয়আত করেন। আবার ফ্রান্সের এক ভদ্রমহিলা ইন্টারনেটে নতুন চ্যানেল খুঁজতে গিয়ে ‘আলহিওয়ারুল মুবাশির’ অনুষ্ঠান দেখে খুব আকৃষ্ট হন, পরে তিনি পূর্বে দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজে পান। স্বপ্নে তিনি দেখেছিলেন যে তিনি একটি কুঁয়ায় পড়ে যাচ্ছেন, কোনমতে কুঁয়ার কিনারা ধরে ঝুলে আছেন, আর কয়েকটি অচেনা খুব সুন্দর পাখি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। অনুষ্ঠানের প্যানেলের সদস্যদের দেখে তিনি বুঝতে পারেন এরাই সেই অচেনা পাখি যারা তাকে বাঁচাতে চাইছে। পরবর্তীতে তিনি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বই-পুস্তক পড়ে সত্য অনুধাবন করেন ও সত্য গ্রহণ করেন। বেনিনে একটি নতুন গ্রামে গিয়ে অ-আহমদী মসজিদে আমাদের জামাতের মোবাল্লেগ সাহেবের সূরা ফাতিহার তফসীরের উপর করা বক্তৃতা শুনে মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ সবাই বয়আত করে আহমদী হয়ে যায়। আরেকটি স্থানে জামাতের উন্নতি দেখে সুন্নী মৌলভীরা জামাত সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচার করে লোকদেরকে আহমদীয়াত থেকে বিরত করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি মুনাযারা বা তর্কসভার আয়োজন করা হয়, অন্য সবাই এলেও সেই মৌলভীদের একজনও উপস্থিত হয় নি। এভাবে লোকজন বুঝে যায় যে মোল্লাদের কাছে কোন যুক্তি-প্রমাণ নেই, এভাবে সেখানে আহমদীয়াত আরও বৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কোন কোন স্থানে জামাতের বিরোধিতাও পরবর্তীতে আহমদীয়াতের অধিক উন্নতি ও বৃদ্ধির কারণ হয়েছে। কোথাও এমটিএ-এর মাধ্যমে, কোথাও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকের মাধ্যমে, কোথাও কোন আহমদী মোবাল্লেগ বা মোয়াল্লেমের বা কোন আহমদী সদস্যের মাধ্যমে সত্যের প্রচার হয়েছে ও মানুষ তা গ্রহণ করেছে, আবার কোথাও কোন আহমদীর তবলীগ করা আদালতে তার কেস জেতারও কারণ হয়েছে। মোটকথা যারা আল্লাহ্‌র সন্ধানে ব্যাপৃত তাদেরকে আল্লাহ্ পথ দেখান ও দেখাচ্ছেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কাছে ১৮৮৩ সনে এই ইলহাম হয়েছিল যে ‘ফাআনা আন তু’আনা ওয়া তু’রাফু বাইনান্নাস’ অর্থাৎ সেই সময় আসতে যাচ্ছে যখন তোমাকে সাহায্য করা হবে ও মানুষ-জন তোমাকে চিনবে; পরবর্তীতে আরও দু’বার তাঁর উপর এই ইলহাম হয়েছে। এটি সেই সময় করা হয়েছে যখন তাঁকে কেউ-ই চিনত না। তিনি (আ.) বলেছেন, এটি কি কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? এটি কেবল আল্লাহ্‌রই কাজ যা আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত পূর্ণ হয়ে চলেছে। আল্লাহ্‌র কৃপায় ও দয়ায় আজ পৃথিবীর ২১০টি দেশে মসীহ্ মওউদ (আ.), আহমদীয়া মুসলিম জামাত ও ইসলামের নাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। সেই কোন এক গন্ডগ্রামের কোনা থেকে উঠা শব্দ আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। হুযুর (আই.) দেশের সংখ্যা প্রসঙ্গে অনেকের ভুল ধারণাও শুধরে দেন। অনেকে মনে করেন যে জামাত যে ২১০টি দেশের কথা বলে-এটি বুঝি অতিরঞ্জন, কারণ পৃথিবীতে তো এতগুলো দেশই নেই! জাতিসংঘের সদস্য দেশের সংখ্যাই ১৯০-৯৫। বাস্তবিক পৃথিবীতে মোট দেশের সংখ্যা ২২০ এর কাছাকাছি, কেননা বিগত দিনগুলোতে বিবিসি কোন একটি খেলা প্রসঙ্গে এই ঘোষণা দিয়েছিল যে সেই ম্যাচ পৃথিবীর ২২০টি দেশে দেখা যাবে। তাই যাদের মনে এই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে জামাত বুঝি অতিরঞ্জন করে বা নিজে থেকে দেশ বানিয়ে নেয়-তারা এই ভুল ধারণা ঠিক করে নিক। হুযুর দোয়া করেন যে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা পৃথিবীতে যে বাণী ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পণ করেছেন, তা পালন করার তৌফিক তিনি আমাদের দান করুন। আমীন। সুম্মা আমীন।