আহমদীয়া জামা’তের সত্যতার প্রমাণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৫-সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “আহমদীয়া জামা’তের সত্যতার প্রমাণ”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আজকাল পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এই প্রশ্ন করে যে ‘তোমরা তো ইসলামের শান্তিপ্রিয় শিক্ষার কথা বল, কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী তো এই কথা বলে না, আর তারা তোমাদেরকে মুসলমান বলে স্বীকারও করে না; অন্যান্য মুসলমানদের তুলনায় আহমদীদের সংখ্যাও নিতান্ত নগণ্য। এমতাবস্থায় আহমদীরা কিভাবে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অনুসরণকারী হবার দাবী করতে পারে?’ হুযুর (আই.) বলেন, সাম্প্রতিক জার্মানি সফরেও এই প্রশ্ন করা হয়েছে। আবার এই প্রশ্নও করে যে ‘বাকী মুসলমানদের তোমরা কিভাবে এই শিক্ষার অনুসরণকারী বানাবে?’ হুযুর (আই.) বলেন, আমাদের উত্তর এটিই হয়ে থাকে যে আমরা ইসলামের যে শিক্ষার কথা বলি তার প্রমাণ কুরআন শরীফ, হাদীস ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নত থেকে প্রদান করি। অমুসলিমদের প্রভাবিত করার জন্য আমরা ইসলামের নাম দিয়ে কোন ভ্রান্ত কথা বলি না, ইসলাম যে চরমপন্থা সমর্থন করে না- একথা আমরা বর্তমান যুগের পরিস্থিতি দেখে নিজেরা বানিয়ে নিই নি। আমরা এটি প্রমাণ করি যে ইসলামের শিক্ষা বরাবরই আল্লাহ্‌র হক ও বান্দার হক আদায় করার শিক্ষা। আর এই প্রশ্ন যে অন্য মুসলমানদেরকে আমরা এই শিক্ষা কিভাবে মানাবো, এর উত্তর হল- মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মুসলমানদের এমন ভ্রষ্টতার যুগে প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী আসার কথা ও মুসলমানদের সংশোধন করার কথা, আর বাকী পৃথিবীর কাছেও ইসলামের বাণী পৌঁছানোর কথা। মহানবী (সা.)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পূর্ণ হয়েছে, প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.) এসে আমাদেরকে ইসলাম ও কুরআনের প্রকৃত শিক্ষার সন্ধান দিয়েছেন; আর আমরা যারা তাঁর (আ.) মান্যকারী আহমদী মুসলমান, আমরা এই শিক্ষা মুসলমানদেরকেও এবং অমুসলিমদেরকেও বলে যাচ্ছি। আমাদের কাজ হল তবলীগ বা প্রচার করা, এটি আমরা করে যাচ্ছি ও করে যাব, ইনশাআল্লাহ্। ঐশী জামাত বা নবীদের জামাত রাতারাতি বিস্তৃত হয় না, বরং ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়। তোমরা প্রশ্ন করছ যে আমরা অন্যদেরকে কিভাবে এপথে আনব? আহমদী জামাত যা আজ কোটি কোটি সংখ্যায় পৌঁছে গিয়েছে তা তো অন্যান্য ফিরকা থেকে আগত মুসলমানদের মাধ্যমেই হয়েছে, একইভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও রয়েছে। অতএব, যখন অন্যরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দাবীর সত্যতা ও মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর মর্ম বুঝতে পারবে, তখন এই সংখ্যালঘু দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হবে। এটি আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি, তা পূর্ণ হবেই, আর এর উদাহরণ আমরাও এখন দেখতে পাই। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আহমদীয়াত গ্রহণ করছে, তার মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। আমাদের তবলীগের মাধ্যম, মোবাল্লেগদের সংখ্যা ইত্যাদি কম হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা’লার আশ্চর্যজনক করুণার ফলে অসাধারণ ফল লাভ হচ্ছে, বরং অনেক ক্ষেত্রে তো কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লার পথনিদের্শনার ফলে মানুষ আহমদী হচ্ছে। কেউ কেউ স্বপ্নের মাধ্যমে জামাতের সন্ধান লাভ করে বা সত্যতা জানতে পারে, কেউ আবার জামাত সম্পর্কে হয়তো জানতো, পরে ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে নির্দেশনা লাভ করে; কেউ কেউ জামাতের তবলীগ শুনে সত্য লাভ করে, কেউ কেউ জামাতের বিরোধিতা ও বিরোধীদের পরিণাম দেখে সত্য বুঝতে পারে, কাউকে বা আল্লাহ্ কোন নিদর্শন দেখান- এভাবে মানুষকে আল্লাহ্ এই জামাতে শামিল করছেন। আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে ইলহাম করেছিলেন যে ‘আমি তোমাকে সম্মান দান করব ও বৃদ্ধি করব’, যে যুগে তাঁর মসীহ্ বা মাহদী হবার কোন দাবীও ছিল না আর গুটিকতক লোক তাঁর সাথে ছিল সেই সময়েই ইলহাম করেছিলেন ‘কাতাবাল্লাহু লাআগলিবান্না আনা ওয়া রুসুলী’ অর্থাৎ আল্লাহ্ এই সিদ্ধান্ত করে রেখেছেন যে অবশ্যই আমি ও আমার রসূলগণ বিজয়ী হব, ‘লা মুবাদ্দিলা লিকালিমাতিহি’ অর্থাৎ খোদার কথাকে বদলানোর সাধ্য কারোও নেই- এভাবে আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতির ফলে একজন ব্যক্তি থেকে পৃথিবীব্যাপী এক জামাত সৃষ্টি হয়েছে।

এরপর হুযুর (আই.) এরূপ বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করেন যারা স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে দিকনির্দেশনা লাভ করেছেন। কাগানে এক ব্যক্তি তবলীগের ফলে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন, তিনি নিজে বর্ণনা করেন যে তার বয়আত গ্রহণের কারণ হল তিনি স্বপ্নে দেখেন যে সিরিয়াতে দুই দল মুসলমান পরস্পর লড়াই করছে, এমতাবস্থায় তৃতীয় একটি দল এসে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দেয় ও তারা যুদ্ধ বন্ধ করে কোলাকুলি শুরু করে; যখন জানতে চাই এই তৃতীয় দল কারা তো জানানো হয় এরা আহমদী। এভাবে আরও একটি স্বপ্ন তিনি দেখেন, যার পরে তিনি বয়আত গ্রহণ করে নেন। আবার ফ্রান্সের এক মহিলা যিনি জানতে পারেন যে অনেকেই নাকি স্বপ্নের মাধ্যমে সত্য জানতে পেরে আহমদীয়াত গ্রহণ করেছে, তিনি নিজেও দোয়া করেন এবং এর ফলে পরপর তিন রাত তিনি স্বপ্নে আহমদীয়াতের সত্যতার ব্যাপারে নির্দেশনা লাভ করেন ও বয়আত গ্রহণ করেন। একইভাবে আইভরি কোস্টেও এক ভদ্রলোক স্বপ্নে তাদের গ্রামে এক ভিন্ন ধরনের আরব লোকদের এসে তবলীগ করতে দেখেন, বাস্তবে যখন জামাতের তবলীগী দল সেখানে যায় এবং তিনি স্বপ্নের সাথে বাস্তবের মিলে যাওয়া দেখেন- তখন তিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করে নেন। কিরগিস্তানের এক জন্মগত মুসলিম ব্যক্তি, যিনি ধর্ম বিষয়ে উদাসীন ছিলেন, নিজের আহমদী সহকর্মীর কাছ থেকে ধর্মের আবশ্যকতা, খাঁটি ইসলামী শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় জানতে পারেন ও অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পান। অবশেষে স্বপ্নের মাধ্যমে সত্যতার চূড়ান্ত প্রমাণ লাভ করে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। মিসরের এক ব্যক্তি আবদুল হাদী সাহেবও স্বপ্নের মাধ্যমে আহমদীয়াতের সত্যতার নিদর্শন লাভ করে বয়আত গ্রহণ করেন। হুযুর (আই.) বলেন, এই ঘটনাগুলো পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে ঘটলেও পথনির্দেশনার ধরন কিন্তু একই রকম। এগুলো থেকে প্রমাণ হয় যে আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং সারা পৃথিবীতে মানুষকে আহমদীয়াতের দিকে পথপ্রদর্শন করছেন।

আলজেরিয়ার ডাক্তার এজায করীম সাহেব প্রচলিত ইসলাম ও মোল্লাদের তফসীর ইত্যাদির কারণে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, পরে যখন মসীহ্ মওউদ (আ.) ও জামাতের সাহিত্য পড়েন তখন বুঝতে পারেন সত্য এখানে আছে; এরপর তিনি ইস্তেখারা করলে স্বপ্নে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করেন ও সত্য গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি এই কারণে আল্লাহ্‌র পথে বন্দীও রয়েছেন, কিন্তু ঈমানে অবিচল রয়েছেন। সেনেগালে একটি এলাকায় তিনটি গ্রামে জামাত প্রতিষ্ঠিত হলে মোল্লারা ও গ্রামের চীফ মিলে প্রকাশ্যে দোয়া করে আহমদীয়াতের ধ্বংস কামনা করে। এরপর একে একে প্রধান মোল্লা ও চীফ নিজেই সাপের কামড়ে মারা যায়। লোকজন বুঝতে পারে যে এটি আহমদীদের জন্য বদদোয়া করার ফলশ্রুতি। মোল্লারা লোকদের উল্টোপাল্টা বলে আহমদীয়াত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু যখন নতুন চীফও একইভাবে মারা যায় তখন লোকেরা সত্য বুঝে যায় এবং আহমদীয়াত গ্রহণ করে এবং এখন তিনটি গ্রামের সাতশ’ লোক সবাই আহমদী। বুর্কিনা ফাসোতে এক ওয়াহাবী ইমামের পুত্র অ-আহমদীদের সাথে আহমদীদের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। যখন সে দেখে যে অ-আহমদীরা আহমদীদের যুক্তি-প্রমাণের জবাব দিতে না পেরে মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে গালিগালাজ করে, তখন সে আহমদীয়াত সম্পর্কে অধিক গবেষণা করে ও সত্য গ্রহণ করে। তার পিতা তাকে তাড়িয়ে দেয়; পরে ষড়যন্ত্র করে তাকে ডেকে এনে অত্যাচার শুরু করে, কিন্তু এই ছেলে স্বপ্নে নির্দেশনা লাভ করে যে, প্রকৃত মুক্তির উপায় হল আহমদীয়াতে প্রতিষ্ঠিত থাকা। অতঃপর সে এতেই অবিচল থাকে। সিয়েরা লিওনে একজন অ-আহমদী ইমাম যখন সত্য গ্রহণ করেন তখন গ্রামে তার বিরোধিত শুরু হয়, তিনি লোকদেরকে বলে দেন যে তিনি মসজিদ, ইমামতি সব ছেড়ে দিচ্ছেন, কিন্তু সত্য তথা আহমদীয়াত তিনি ছাড়তে পারবেন না। এরকম আরও অনেক ঘটনা হুযুর (আই.) খুতবায় উল্লেখ করেন যা থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং মানুষকে ইসলামের খাঁটি শিক্ষার দিকে টেনে আনছেন, আর একদিন মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মাধ্যমে খাঁটি ইসলাম পৃথিবীতে বিজয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ্। হুযুর (আই.) দোয়াও করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন প্রত্যেককে এই কল্যাণে শামিল হবার জন্য স্থায়ীভাবে তবলীগ করার ও এদিকে মনোযোগী হবার তৌফিক দান করেন। আমীন।

খুতবার শেষে হুযুর (আই.) মোকাররমা খুরশীদ রুকাইয়া সাহেবা ও মোকাররম ডা. সালাহউদ্দীন সাহেবের গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন ও তাদের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন এবং তাদের পদমর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।