এম.টি.এ-র বরকত ও সালানা জলসা জার্মানি – ২০১৭

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০১-সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “এম.টি.এ-র বরকত ও সালানা জলসা জার্মানি – ২০১৭”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা নিজ কৃপায় এমটিএ-র মাধ্যমে আহমদী বিশ্বকে এভাবে সংযুক্ত করে দিয়েছেন যে, এখন খলীফায়ে ওয়াক্তের সফর ও জামাতি অনুষ্ঠানসমূহের খবর শোনার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার বা জামাতি পত্র-পত্রিকার জন্য বসে থাকার প্রয়োজন হয় না, বরং সাথে সাথেই সব খবর পাওয়া যায়; সব অনুষ্ঠান দেখা যায়, এমনকি জলসা চলাকালীন সময়েই অনেকের মন্তব্য বা অনুভূতি পৌঁছে যায়। কয়েক দিন আগেই জার্মানির জলসা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সম্পর্কে অনেকে আমাকে লিখেছেন। এগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির উল্লেখ থাকে, আল্লাহ্ তা’লার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ থাকে যে আল্লাহ্ তা’লা এম.টি.এ নামক এই নেয়ামতের মাধ্যমে কিভাবে বিশ্বব্যাপী মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জামাতকে একই সময়ের অধীনে এনে দিয়েছেন এবং ‘একই সুতোয় গাঁথা মালা’র বাস্তব চিত্রায়নেরও কী সুন্দর উপকরণ তৈরি করে দিয়েছেন। এজন্য আমাদের একদিকে যেমন আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত, অন্যদিকে এম.টি.এ-রও সকল স্বেচ্ছাসেবী ও নিয়মিত কর্মীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত। আল্লাহ্ তা’লা তাদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুন, চিঠি-পত্র যারা লিখেন তারাও এম.টি.এ-র কর্মীদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন ও এই দোয়া করেন যে আল্লাহ্ যেন তাদের উপর ফযল করেন। একইভাবে অন্যান্য বিভাগের কর্মীরাও রয়েছেন যারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে জলসায় আগত অতিথিদের সেবা প্রদান করে থাকেন; এদের সংখ্যাও কয়েক সহস্র, তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিশু-তরুণ সবাই রয়েছেন। তারা এমন এক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে কাজ করে যার উদাহরণ কেবলমাত্র আহমদীয়া জামাতেই দেখা যায়। এই দৃশ্য কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমরা যুক্তরাজ্যের জলসা সালানায়ও দেখেছি, আর এখন জার্মানির জলসাতেও দেখেছি। তাই যেভাবে আমি সবসময় বলে থাকি, জলসায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের দায়িত্ব হল এই স্বেচ্ছাসেবীদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা, যারা এক উদ্দীপনার সাথে নিঃস্বার্থভাবে কেবল আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকেন। আর তাদের এমন কাজ জলসার সময় এক নীরব তবলীগের কারণ হয়ে থাকে। এম.টি.এ বিভিন্ন অনুষ্ঠান তো প্রস্তুত করে থাকে, সেগুলোর সম্পর্কে লোকজন চিঠিতে লিখেও থাকেন, সেগুলো উপভোগও করেন ও তার মাধ্যমে উপকৃতও হন; কিন্তু জলসায় আগত অতিথিদের অভিব্যক্তি, কর্মীদের কাজ দেখে বা জলসায় অংশগ্রহণকারী আহমদীদের আচরণে প্রভাবান্বিত হয়ে তাদের যে অনুভূতি- তা তো এম.টি.এ-র অনুষ্ঠানে জলসা চলাকালীন তুলে ধরাও সম্ভব না বা জানাও সম্ভব হয় না। যেহেতু জলসার প্রভাব তুলে ধরার জন্য এসব অভিব্যক্তিও সকলের জানা দরকার, তাই আমি সেগুলোর মধ্য থেকে কিছু তুলে ধরছি, যেন সারা পৃথিবীর আহমদীরা জানতে পারেন যে কিভাবে জলসার প্রভাব অ-আহমদীদের উপরও পড়ে থাকে; আর জলসায় অংশগ্রহণকারী ও কর্মীরা যেন বুঝতে পারেন যে কিভাবে তাদের কর্মকান্ড নীরবে অ-আহমদীদেরকে ইসলাম ও আহমদীয়াতের কাছে টেনে আনার কারণ হয়।

হুযুর (আই.) এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অ-আহমদী অতিথিদের কিছু অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। আরব বংশোদ্ভূত এক মুসলিম বন্ধু বলেন, আমার অমুসলিম বন্ধুরা ইসলাম সম্পর্কে যে নেতিবাচক কথা বলত, মুসলমানদের আভ্যন্তরীন মতভেদ, অনৈক্য ও দলাদলি দেখে আমি তার জবাব দিতে পারতাম না। কিন্তু আজ জলসায় এসে এরূপ ঐক্যবদ্ধ, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, শান্তিপ্রিয়, সুশৃঙ্খল জামাত দেখে গর্বে আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি যে, এবার আমি গিয়ে আমার ইসলাম-বিদ্বেষী বন্ধুদেরকে আহমদী জামাতের উদাহরণ দেখিয়ে ইসলামের পক্ষে যুক্তি দিয়ে লড়তে পারব। আরেকজন জার্মান বন্ধু বলেন, খবরের কাগজে পড়তাম যে আহমদীরা নাকি শান্তিপ্রিয় মুসলিম; ভাবতাম এটা তো সবাই দাবী করে। কিন্তু জলসায় এসে বুঝতে পারলাম যে শান্তিপ্রিয়তার দাবী ও কাজের মাধ্যমে তার সাক্ষ্য দেয়ার দাবীদার কেবল আহমদীরাই রয়েছে। মেসিডোনিয়ার তিনজন অ-আহমদী মুসলিম মহিলা জলসা দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে তারা বলেন, ভবিষ্যতে তারা সাথে করে আরও অতিথি নিয়ে আসবেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে তারা মুসলিমদের মাঝে আহমদী জামাতের প্রচার করবেন। অতিথিদের কেউ মন্তব্য করেছেন যে, জলসার কারণে তারা খাঁটি ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন এবং এখন তাদের অভিমত হল পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে খাঁটি ইসলামী শিক্ষা প্রচার ও কার্যকর করতে হবে। কর্মী ও অংশগ্রহণকারীদের হৃদ্যতা ও ভালবাসাপূর্ণ ব্যবহারে অভিভূত হয়ে কোন অতিথি মন্তব্য করেছেন যে, যদি তাদেরকে মাটিতেও শুতে বলতো বা শুকনো রুটি খেতে বলতো, তবে তারা তা-ই করতো, কারণ তারা তাদেরকে গভীর ভালবাসার সাথে সব বলছিল। একজন অতিথি মন্তব্য করেন, কেউ যদি জান্নাতে যেতে চায় তবে তার উচিত প্রথমে পৃথিবীতেই জান্নাতের নমুনা দেখে নেয়া, যা রয়েছে আহমদীদের এই জলসায়। বুলগেরিয়া থেকে আগত এক ভদ্রমহিলা মন্তব্য করেন, কেউ যদি তার জীবন বদলাতে চায় তবে তার জলসায় আসা উচিত। এখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি, তার মধ্য থেকে দুটির উল্লেখ অবশ্যই করতে চাই। এখানে যা শেখানো হয় তার একটি হল আল্লাহ্‌কে ভালবাসা, অন্যটি হল একে অন্যকে ভালবাসা ও সম্মান করা। প্রসঙ্গত হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন যে, বুলগেরিয়া হল সেই দেশ যেখানে মোল্লাদের প্রভাবে সরকার আমাদের জামাতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে, দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ সেখানকার অবস্থা বদলে দেন ও নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সেখানে আহমদীয়াতের তবলীগ হয় (আমীন)। আফ্রিকান এক যুবক ৪০ হাজার মানুষের এতবড় এক সমাবেশ কিভাবে কোন পুলিশ ছাড়াই এত সুশৃঙ্খলভাবে চলছে- এটি দেখে আশ্চর্য ও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। মেসিডোনিয়ান অমুসলিম এক সাংবাদিক হুযুরের ভাষণসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন, বিশেষভাবে মহিলা অধিবেশনে মহিলাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ইসলামের নারীসংক্রান্ত শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেন। হাঙ্গেরী থেকে আগত এক খ্রীষ্টান ভদ্রমহিলাও আহমদীদের নারীদের সাথে উন্নত আচরণের প্রশংসা করে বলেন যে, খ্রীষ্টানদের জলসায় এসে শেখা উচিত যে কিভাবে অন্যদের সাথে মিশতে হয় ও কেমন ব্যবহার করতে হয়। মোটকথা প্রত্যেকেই তাদের অভিব্যক্তিতে জলসার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন যা তাদের অভিভূত করেছে। হুযুর (আই.) প্রাসঙ্গিকভাবে আহমদীদেরকেও বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং নিজেদের আচরণকে আরও পরিশীলিত ও উন্নত করতে বলেছেন যেন কেউ আমাদের মাঝে কোন খুঁত বের করতে না পারে। হুযুর (আই.) স্মরণ করান, যেখানে অ-আহমদীরা এভাবে জলসার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে উপকৃত হচ্ছে, সেখানে যেই আহমদীদের জন্য এই জলসা- তাদের কত বেশি এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার যেন তারা এত্থেকে আধ্যাত্মিকভাবে উপকৃত হয়। হুযুর (আই.) জলসার মিডিয়া কাভারেজ সম্পর্কেও সংক্ষিপ্তভাবে বলে দেন এবং বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে যে সংখ্যক লোকের কাছে ইসলাম ও আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁছেছে তার সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। হুযুর (আই.) জলসায় যেসব খুঁটিনাটি ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে সেগুলোরও উল্লেখ করে দেন যেন ভবিষ্যতে সেগুলো দূর করে জলসা আরও সুন্দর ও সুচারু করা যায়। এছাড়া জার্মানিতে একটি নতুন মসজিদের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানেরও সংক্ষিপ্ত বিবরণ হুযুর প্রদান করেন এবং মিডিয়া কাভারেজের মাধ্যমে মানুষের কাছে ইসলাম ও আহমদীয়াতের বাণী পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন।

হুযুর (আই.) খুতবার একেবারে শেষে এসে দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন জার্মানির জামাতকে ভবিষ্যতে এরচেয়েও অনেক বেশি ইসলামের বাণী প্রচার করার তৌফিক দান করেন এবং এখন পর্যন্ত যে পরিচিতি জামাত লাভ করেছে, সেই পরিধিকে আরও বিস্তৃত করার তৌফিক দান করেন। আমীন।