সালানা জলসা জার্মানি – ২০১৭

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৫-আগস্ট, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৫শে আগস্ট, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার কার্লস্‌রূহ, জার্মানীতে থেকে “সালানা জলসা জার্মানি – ২০১৭”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আজ আমরা সবাই এখানে জলসায় অংশগ্রহণের জন্য একত্রিত হয়েছি। আমাদের এখানে একত্রিত হওয়া কোন পার্থিব হৈ-চৈ, আনন্দ-উল্লাস বা অন্য কোন পার্থিব উদ্দেশ্যে নয়, বরং এখানে আসার উদ্দেশ্য হল এখানে এসে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশে অবস্থানের মাধ্যমে নিজেদের আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধি করা, জ্ঞানগত, বিশ্বাসগত ও কর্মগত দিক থেকে উন্নতি করা, খোদাভীতিতে উন্নত হওয়া এবং আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দাদের অধিকার প্রদান করা। হুযুর বলেন, একজন অ-আহমদী একথা বলতে পারে যে ‘আল্লাহ্‌র অধিকার কী বা বান্দার অধিকার কী তা আমার জানা নেই’; কিন্তু একজন আহমদীর একথা বলার কোন সুযোগই নেই, কেননা তার সামনে বারংবার একথাগুলো বর্ণনা করা হয়ে থাকে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের প্রতি অনেক বড় দয়া করেছেন যে এ বিষয়গুলোর বর্ণনার এত বড় এক ভান্ডার আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন যা কখনো শেষ হবার নয়। একজন যখন মনে করে যে ‘আমি তো এটি পড়েছি বা শুনেছি’, আর এরপর পুনরায় তা পড়ে বা শোনে; প্রত্যেকবার নতুন কোন না কোন বিষয় সে উপলদ্ধি করে বা নতুন কোন দিক তার দৃষ্টিগোচর হয়। আর প্রত্যেক বয়আতকারীর জন্যই বয়আতের শর্তাবলীতে এসব অধিকার ও আমাদের দায়িত্ব মসীহ্ মওউদ (আ.) কর্তৃক সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। তাই জলসায় অংশগ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। এরপর হুযুর (আই.) এ বিষয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরেন।

মানুষের আকীদা বা ধর্মবিশ্বাস যে তার কর্মের উপর প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ইসলামের দু’টি অংশ; একটি হল আল্লাহ্‌র সাথে কোন অংশীদার দাঁড় না করানো ও তাঁর অপার করুণার বিনিময়ে তাঁর পূর্ণ আনুগত্য করা, দ্বিতীয়টি হল সৃষ্টির অধিকার জেনে তা যথাযথভাবে আদায় করা। বড় বড় পাপ যেমন চুরি, ব্যভিচার, গীবত, মিথ্যা ইত্যাদিতে আক্রান্ত জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, কেউ কেউ এগুলোর যেকোন একটির কারণেই ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীয়ার উপর যেহেতু আল্লাহ্‌র অনেক দয়া, তাই অজস্র পাপ সত্ত্বেত তিনি একে ধ্বংস করে দেন নি। যদি আকীদা সঠিক হয় ও উদ্দেশ্য সৎ হয়, তবে তার সম্পাদিত কর্মও ভাল হয়। তিনি বলেন, যে মানুষ সত্য ও ত্রুটিহীন বিশ্বাস পোষণ করে ও খোদার সাথে কোন শরীক দাঁড় করায় না, তার মাধ্যমে আপনাআপনিই সৎকর্ম সম্পাদিত হয়। মুসলমানরা যখন থেকে সত্য ও সঠিক বিশ্বাস থেকে সরে গেল তখন এক পর্যায়ে গিয়ে দাজ্জালকেই খোদা মানতে শুরু করল। কেননা তারা যাবতীয় ঐশ্বরিক গুণাবলী দাজ্জালের মধ্যে আছে বলে মনে করে। যাবতীয় ঐশ্বরিক গুণাবলী যেহেতু ঈসার প্রতি আরোপ করছ, তাহলে যারা তাকে খোদা বলছে তাদের দোষ কোথায়? হুযুর (আই.) বলেন, পৃথিবীতে আমরা এখন দেখতে পাই যে অনেক বড় বড় রাষ্ট্রও পার্থিব শক্তিধরদের খোদা মনে করে, তাদের সামনে ঝুঁকে।

এই জামাত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী সে সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এর উদ্দেশ্য হল যেন খোদা তা’লা সম্পর্কে মারেফত বা তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা যায় এবং দোয়া ও ইবাদতের গূঢ়তত্ত্ব জানা যায়। যেভাবে সেই ব্যক্তি যে কেবল দোয়া করে কিন্তু কোন চেষ্টা করে না-সে ভ্রান্ত; তেমনি যে ব্যক্তি কেবল চেষ্টা-তদ্বিরকেই সব মনে করে সে-ও ধর্মহীন। দোয়া ও চেষ্টা- উভয়টিকে মিলিয়ে দেয়া হল ইসলাম; নিজের যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং একইভাবে অনেক দোয়া করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে এসব চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফল তো সৃষ্টি করবেন আল্লাহ্- এটি হল ইসলাম। এজন্যই পাপ থেকে বাঁচতে হলে যাবতীয় উপায়ে সর্বাত্মক চেষ্টাও করতে হবে, এরপর আপ্রাণ দোয়াও করতে হবে। এই দর্শনের দিকেই সূরা ফাতেহার আয়াত ‘ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তা’ঈন’-এ ইঙ্গিত রয়েছে।

এই জামাত প্রতিষ্ঠার পেছনে আল্লাহ্ তা’লার উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, কেবলমাত্র প্রথাগত বয়আত করে নেয়া বা আমাকে ইমাম মেনে নেয়ার মাধ্যমে নাজাত বা মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। নাজাত পেতে হলে যা করতে হবে তা হল প্রথমতঃ খাঁটি মনে আল্লাহ্ তা’লাকে এক-অদ্বিতীয় বিশ্বাস করা, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্য নবী বলে বিশ্বাস করা ও কুরআন শরীফকে আল্লাহ্‌র সত্য ও শেষ গ্রন্থ বলে মান্য করা। অন্য মুসলমানদের মধ্যে এগুলো গতানুগতিকভাবে রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা এগুলো মান্যকারী নয়। এজন্যই আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদকে পাঠিয়েছেন। অতএব মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্‌ তা’লার সাথে প্রকৃত সম্পর্ক সৃষ্টি করানো, মহানবী (সা.)-এর মহত্বও মর্যাদার সাথে পরিচিত করানো, কুরআনের নির্দেশাবলীকে ব্যক্তির উপর কার্যকর করানো। তাই আমরা যারা তাঁর মান্যকারী, আমাদেরকে আকীদার দিক থেকেও এবং আমলের দিক থেকেও সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করতে হবে। যদি প্রচলিত ইবাদত, যিকরে ইলাহী, দোয়া ইত্যাদিতে অন্যান্যদের সাথে আমাদের এক দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য না থাকে, তবে তা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। আমাদের ইবাদত নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ্ তা’লাকে এক-অদ্বিতীয় বলে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণের মাধ্যমে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য হওয়া আবশ্যক। ইবাদতের সাথে সাথে সৃষ্টির অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও মহানবী (সা.)-এর উন্নত আদর্শও আমাদের অনুসরণ করতে হবে। সামাজিক, পারিবারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর (সা.) আদর্শ আমাদের অনুকরণ ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, এই যুগ যা মানুষকে আল্লাহ্ তা’লা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে এবং উন্নতির নামে প্রত্যহ আরও দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টায় রত রয়েছে, এই দুঃসময়ে আহমদীদের আবশ্যক দায়িত্ব হল তারা যেন আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক ও আল্লাহ্‌র মারেফত অর্জনের পূর্ণ প্রচেষ্টা চালায় এবং প্রতিদিন এতে উন্নতি করতে থাকে; মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালবাসার কেবল যেন মৌখিক দাবীদার না হয় বরং নিজ জীবনে তাঁর (সা.) আদর্শ আত্মস্থ করার মাধ্যমে প্রকৃত ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, কুরআনের আদেশ-নিষেধ পালন করে এবং সর্বদা এই চেষ্টায় রত থাকে যে আমাদের প্রত্যেকটি কাজ যেন পুণ্যকাজ হয় ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ হয়।

হুযুর (আই.) ইবাদত তথা আল্লাহ্‌র অধিকার প্রদান এবং বান্দার অধিকার প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখনীর আলোকে তুলে ধরেন। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই মানদন্ডে উপনীত হওয়ার তৌফিক দান করুন; মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করে তাঁর (আ.) আবির্ভাবের উদ্দেশ্যকে বুঝবার ও তা পূর্ণ করার জন্য নিজেদের সকল চেষ্টা ও সামর্থ্যকে নিয়োজিত করার এবং পৃথিবীকে এই সত্য জানাবার তৌফিক দান করুন। হুযুর (আই.) জলসায় অংশগ্রহণকারীদেরকে জলসার কার্যক্রম শোনার ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করেন এবং সার্বিকভাবে অংশগ্রহণকারী ও কর্মীদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।