ক্ষমা ও সন্ধি স্থাপন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৮-আগস্ট, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৮ই আগস্ট, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “ক্ষমা ও সন্ধি স্থাপন”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তক কিশতিয়ে নূহ থেকে একটি উদ্ধৃতি পাঠ করেন যেখানে তিনি (আ.) বলেন, “খোদা তা’লা চান তোমাদের জীবনে যেন আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি তোমাদের নিকট এক মৃত্যু চান যার পর তিনি তোমাদেরকে এক নতুন জীবন দান করবেন। তোমরা শীঘ্র পরস্পর বিবাদ মীমাংসা করে ফেল এবং আপন ভাইদের অপরাধ ক্ষমা কর। কারণ যে ব্যক্তি আপন ভাইয়ের সাথে বিবাদ মীমাংসা রাজী নয় তাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে, কেননা সে বিভেদ সৃষ্টি করে। তোমরা নিজ প্রবৃত্তির বশবর্তিতা সর্বতোভাবে পরিহার কর এবং পারস্পরিক মনোমালিন্য পরিত্যাগ কর। সত্যবাদী হয়েও মিথ্যাবাদীর মত বিনয়ী হও যেন তোমাদেরকে ক্ষমা করা হয়। রিপুর স্থূলতা বর্জন কর; কারণ যে দরজার দিকে তোমাদেরকে আহ্বান করা হয়েছে তা দিয়ে কোন স্থূলরিপু ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারবে না।… তোমাদের মধ্যে অধিক মহৎ ব্যক্তি সে, যে নিজ ভাইয়ের অপরাধ অধিক ক্ষমা করে।”

হুযুর (আই.) বলেন, এই উদ্ধৃতিটি প্রায়শঃই বক্তৃতা, দরস ইত্যাদির মাধ্যমে জামাতের সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। আর ‘সত্যবাদী হয়েও মিথ্যাবাদীর ন্যায় বিনয়ী হও’- এই বাক্যটি তো জামাতের সদস্যদের মুখে মুখে ফিরে, অনেক সময় কোন ঝগড়া-বিবাদ হলে তার বিস্তারিত আমার কাছে লিখতে গিয়ে কেউ কেউ বলেও থাকেন যে ‘আমরা তো এই নীতি অবলম্বন করেছি, কিন্তু অপরপক্ষ তা সত্ত্বেও আমাদের সাথে অত্যাচারীসুলভ আচরণ করেছে’। হুযুর (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি কাযা বিভাগ ও ঝগড়াসংক্রান্ত মামলা বিষয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এই কথাগুলো, যা তিনি (আ.) তাঁর শিক্ষার মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এগুলো তিনি তাঁর মান্যকারীদের কাছ থেকে যে আশা রাখেন ও তাদের জন্য আন্তরিক বেদনা রাখেন, তারই বহিঃপ্রকাশ। মানুষ যখন কিশতিয়ে নূহ থেকে ‘আমাদের শিক্ষা’ অংশটুকু পড়ে তখন হকচকিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে কতক এমন আছে যারা ক্ষমা করতে ও সন্ধির জন্য বাড়ানো হাতকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। যেমনটি কেউ কেউ লিখেন, যদি সত্যিই এমনটি হয় যে অপর পক্ষ তাদের সন্ধির হাতকে ফিরিয়ে দেয়, তবে আমি বলব-এদের বিষয় আল্লাহ্‌র উপর ছেড়ে দিন, কারণ মসীহ্ মওউদ (আ.) বলে দিয়েছেন যে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে, আর পরে এ-ও বলেছেন: ‘হতভাগ্য সে ব্যক্তি, যে জেদ করে এবং ক্ষমা করে না’। একথাটি যারা জেদ করে, তাদের জন্য অনেক বড় সতর্কবাণী। তাদের ভাবা উচিত যে একদিকে আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করে এই অঙ্গীকার করছি যে বিশৃঙ্খলা করব না, প্রবৃত্তির উত্তেজনা থেকে আত্মরক্ষা করব; অন্যদিকে সন্ধি করতেও অনীহা-এটি বয়আতের অঙ্গীকার পালন করা নয়, বরং তা থেকে দূরে সরে যাওয়া। তিনি (আ.) বলেছেন, যে আমাদের জামাতের কেবল কথার খই ফোটালে চলবে না, বরং বয়আতের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করতে হবে। আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন করতে হবে, কেবল মাসলা-মাসায়েল দিয়ে আল্লাহকে খুশি করা যাবে না। তিনি (আ.) স্পষ্টভাবে একথা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বয়আতে উদ্দেশ্যকে পূর্ণ না করলে আল্লাহ্ তা’লা খুশি হন না, আর আল্লাহ্ তা’লাকে খুশি করার জন্য আল্লাহ্‌র বান্দাদের হক আদায় ও তাদের সাথে শান্তি ও সন্ধিও আবশ্যক। তিনি (আ.) এদিক থেকে তাঁর নিজের অবস্থা কেমন তা তুলে ধরতে গিয়ে কসম খেয়ে বলেন, যে ব্যক্তি সহস্রবার তাঁকে গালাগালি করেছে, দাজ্জাল-মিথ্যাবাদী বলেছে ও অভিশাপ দিয়েছে, সে-ও যদি সন্ধি করতে চায় তবে সে কী করেছে বা বলেছে তা বিন্দুমাত্রও আমার মনে আসে না। তিনি নসীহত করেন যে দু’টি বিষয় স্মরণ রাখবে, একটি হল খোদা তা’লাকে ভয় করবে, দ্বিতীয়টি হল নিজ ভাইদের সাথে সেরূপ সহমর্মিতা রাখবে যেমনটি নিজের প্রতি রাখ। যদি কারও দ্বারা কোন অন্যায় বা ভুল সংঘটিত হয়ে যায় তবে তাকে ক্ষমা করা উচিত, তার সাথে কঠোরতা ও বিদ্বেষের আগুন দেখালে চলবে না। হুযুর (আই.) বলেন, তাই আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে এই যুগে চতুর্দিকে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান, আর আমরা যারা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের কারণে নিজেদেরকে এই অবস্থা থেকে পৃথক ও নিরাপদ মনে করি, আমরা তখন প্রকৃত অর্থে এর থেকে মুক্ত হতে পারব যখন আমরা সর্বদা অন্যদের সাথে বৈষয়িক ক্ষেত্রে নম্রতা অবলম্বন করব ও সন্ধির ভিত্তি রাখব। সৃষ্টির প্রতি সহমর্মিতা ও সন্ধি এমন গুণ, যা আত্মস্থ করার জন্য মসীহ্ মওউদ (আ.) বারবার আমাদেরকে নসীহত করেছেন।

হুযুর (আই.) মহানবী (সা.)-এর হাদীসের উল্লেখ করেন যে প্রকৃত বীর ও পালোয়ান হল সেই ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। হুযুর (আই.) হযরত আলী (রা.)-এর ঘটনা উল্লেখ করেন, যেখানে তিনি (রা.) ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে আঘাত করার আশঙ্কায় সম্পূর্ণ পরাভূত করা সত্ত্বেও এক কাফেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, প্রকৃত বীর হল সে যে আত্মসংশোধনের সামর্থ্য লাভ করে। তিনি (আ.) বলেন, আমার মতে যে ব্যক্তি বাজে ও নিন্দনীয় চরিত্রকে বর্জন করে উন্নত চরিত্র অর্জন করে, এটিই কেরামত বা মোজেযা। বস্তুতঃ এটি অনেক বড় এক মোজেযা, কারণ এর প্রভাব স্থায়ী ও অনেক সুদূরপ্রসারী। অনেক বড় বড় পাপীর এই ঘটনা রয়েছে যে তারা অতিপ্রাকৃত মোজেযা দেখেও ঠিক হয় নি, কিন্তু চরিত্র পরিবর্তনের মোজেযা দেখে মাথা নত করেছে। স্বয়ং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাথে দুই শিখ চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করার পরও তিনি তাদের কিছুই বলেন নি ও ক্রোধান্বিত হন নি, বরং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন। তিনি (আ.) বলেন, মানুষের ভেতর থেকে যদি আত্মগরিমার পোকা বের না হয়, তাহলে সে খাঁটি একত্ববাদীও হতে পারে না; আর এই পোকা আল্লাহ্‌র করুণা ব্যতীত দূর করা সম্ভব নয়। যারা আত্মগরিমার পোকায় আক্রান্ত থাকে, তারা বাহ্যত অনেক জ্ঞানী ও ধর্মীয় আলেমও হয়ে থাকে; কিন্তু নিজের স্বার্থের বেলায় অন্যের হক আদায় করে না, ক্রোধের শিকার হয়, আর এভাবে আল্লাহ্‌র একত্ববাদকে ভুলে যায়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর ‘ইসলামী নীতিদর্শন’ পুস্তকে অকল্যাণ পরিত্যাগ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটি বিষয় এই বর্ণনা করেন যে অন্যদেরকে যুলুমের দ্বারা কষ্ট না দেয়া, সম্পূর্ণ ক্ষতিহীন হওয়া ও সন্ধিসুলভ জীবন যাপন করা। হুযুর (আই.) এই বিষয়টি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখনী ও কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যার মাধ্যমে তুলে ধরেন।

নিজ চরিত্রকে উন্নত করা ও অপছন্দীয় ও নিন্দনীয় বিষয়সমূহ দূর করার ক্ষেত্রে কিভাবে পরিশ্রম করতে হয়, সে প্রসঙ্গে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ধোপার কাপড় ধোয়ার যে উদাহরণ দিয়েছেন তা হুযুর (আই.) তুলে ধরেন। যেভাবে ধোপা কাপড়কে সাবান-পানিসহ চুলায় গরম করে, এভাবে কিছু ময়লা দূর হয়; এরপর পানিতে নিয়ে পাথরে আছড়ে আছড়ে ধোয়ার ফলে বাকি ময়লা দূর হয়, তেমনিভাবে নিজের স্বভাব থেকে বাজে বিষয়গুলোকে দূর করতে হবে ও উন্নত গুণাবলী আত্মস্থ করতে হবে-এই শিক্ষাই মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের দান করেছেন। আর এটিই পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘কাদ আফলাহা মান যাক্কাহা’ অর্থাৎ সেই ব্যক্তি সফল হয়েছে যে আত্মাকে পরিষ্কার করেছে।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের তৌফিক দান করুন যেন আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা পালনপূর্বক মানবজাতির প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনকারী হই, শান্তি-সন্ধির ভীত রচনা করি, আল্লাহ্‌র একত্ববাদের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনকারী হই, এবং সমাজে ভালবাসা ও সম্প্রীতির প্রসারকারী হই; জাগতিক কামনা-বাসনা যেন আমাদের উপর ছেয়ে যেতে না দেন, বরং সর্বদা যেন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির সন্ধানে থাকি এবং এটিই আমাদের জীবনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হয়। আমীন।